Ajker Patrika

মেধার বিকাশ ও কর্মসংস্থান দরকার

আব্দুর রাজ্জাক 
কয়েক শ গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেলে এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা কী হবে সেটা ভাবাই যায় না। ফাইল ছবি
কয়েক শ গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেলে এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা কী হবে সেটা ভাবাই যায় না। ফাইল ছবি

গত বছর জুলাইয়ের আন্দোলনে একটি স্লোগান শুনে আমি পুলকিত বোধ করেছিলাম। স্লোগানটা ছিল—‘কোটা না মেধা মেধা, মেধা মেধা’। এই স্লোগানের আরেকটি সমার্থক প্রবাদ বাক্য আছে আমাদের সমাজে—‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’। আপনি কার ছেলে বা মেয়ে, কার নাতি বা নাতনি অর্থাৎ পিতা-মাতা বা দাদা-দাদির পরিচয় সূত্রে আপনি সমাজের ভালো আসন পাবেন, এটা কাম্য হতে পারে না। তাই তো সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ কোটা না, মেধাকে প্রাধান্য দিয়েছিল। রেজিম পরিবর্তন হয়েছে, আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা একাত্মতা পোষণ করেছিলেন, তাঁরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন—এ জাতি মেধার মূল্যায়ন করতে জানে—এই কথা ভেবে।

উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের সেই আশা ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এইচএসসি পরীক্ষা না দিয়ে অটোপাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই যে, এটাকে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ মেনে নিতে পারেনি সেই সময়। অটোপাসের এই ধারা অব্যাহত রাখতে পরবর্তী সময়ে আরও কিছু স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আন্দোলন করতে দেখা গেছে, অবশ্য সেটা ছিল স্বল্প পরিসরে। মেধাবী ছাত্রদের আন্দোলন সফল হয়েছিল, আমরা যারা অভিভাবক পর্যায়ের আছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের বুকে আশার সঞ্চার হয়েছিল, এখন থেকে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বক্ষেত্রে মেধার অগ্রাধিকার হবে। মেধা যদি সব জায়গায় প্রাধান্য পায় তাহলেই মেধার বিকাশ ঘটবে।

পৃথিবীতে সব সময় সব জায়গায় মেধা ছিল, আছে, থাকবে। মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতির মাধ্যমে। মেধার বিকাশের পরিবেশ দুই রকম হতে পারে। এক. মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে মানবকল্যাণে ভালো শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটানো যায়। দুই. নেতিবাচকভাবেও মেধার বিকাশ ঘটানো যায়, যেটা সমাজকে পেছন দিকে নিয়ে যায়। এক বছর হতে চলল আমরা নতুন বাস্তবতায় বসবাস করছি। এখন পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখছি না যে, ইতিবাচকভাবে মেধার বিকাশ ঘটছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি যে মেধার বিকাশ ঘটানোর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফল দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায়, ছাত্রছাত্রীরা মনোনিবেশ করতে পারেনি তাদের পাঠক্রমে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে অবস্থা, যাঁরা এর সংস্পর্শে আছেন অথবা যেসব অভিভাবক পর্যবেক্ষণ করছেন যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা বর্তমানে কী শিক্ষা পাচ্ছে, একটু সচেতনভাবে তাকালে দেখতে পাবেন, খুব একটা সামনের দিকে আমরা এগোতে পারছি না। প্রায় ক্ষেত্রেই গতানুগতিক অথবা তার চেয়ে একটু পেছনের দিকে যাচ্ছি। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। যা হওয়ার কথা ছিল সেটা হলো না কেন, তা নিয়ে সমাজচিন্তকেরা একটু ভেবে দেখতে পারেন। গবেষকেরা গবেষণা করে দেখতে পারেন—কেন এমনটা ঘটছে, আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে বহির্বিশ্ব থেকে কেন পেছনের দিকে যাচ্ছি? এ রকম চলতে থাকলে একসময় আমরা কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হব, যার থেকে বের হয়ে আসতে কয়েক যুগ লাগতে পারে। ইতিমধ্যেই পৃথিবী সামনের দিকে অনেক অগ্রসর হবে, চলমান পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনগ্রসর জাতি হিসেবে আমরা পরিগণিত হব।

সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে দরকার নতুন নতুন কর্মসংস্থান। প্রতিবছর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হচ্ছে কয়েক লাখ শিক্ষিত তরুণ। তা ছাড়া শ্রমবাজারে তৈরি হচ্ছে আরও কয়েক লাখ শ্রমজীবী মানুষ। গড়ে প্রতিবছর কম করে হলেও ১০ লাখ কর্মজীবী মানুষ কর্মক্ষম হয়, শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। ধারণা করি, সরকারি খাতে বড়জোর প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করা যায়। আমি একটু বাড়িয়ে বললাম, বাস্তবে এর চেয়ে হয়তো কম হবে। বাকি শ্রমজীবী মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়তো কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে অথবা বিদেশে পাড়ি জমায়। যেসব কর্ম ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করলাম, প্রায় ক্ষেত্রেই বর্তমানে বন্ধ্যত্ব দেখা যাচ্ছে। বেকার হয়ে পড়ছে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী।

এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক তাদের পর্যালোচনামূলক একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, ইতিমধ্যে ২৭ লাখ মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে। যেখানে ১০ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সেটা না হয়ে নতুন করে এই ২৭ লাখ কর্মজীবী মানুষের বোঝা জাতির ঘাড়ে চেপেছে। নতুন বাস্তবতায় লক্ষ করা যাচ্ছে যে, কর্মচ্যুত হওয়ার সঙ্গে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হওয়ার কোনো পরিকল্পনা আমাদের সামনে নেই। নতুন করে শিল্পকলকারখানা স্থাপনের তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিদেশমুখিতাও অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এরপর যদি কয়েক শ গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যায়, এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা কী হবে, সেটা ভাবাই যায় না।

নতুন করে যদি আরও কর্ম-উপযোগী মানুষ কর্মচ্যুত হয়, তারা বিভিন্ন কলকারখানায় ভিড় করবে, সেখানে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এই ফাঁকে মালিকপক্ষ সঠিক পারিশ্রমিকের পরিবর্তে শ্রমিকদের শোষণ করার একটা হাতিয়ার পেলেও পেতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা যেতে পারে আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে।

এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এখনই দরকার নতুন নতুন পরিকল্পনা। অনতিবিলম্বে নতুন কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করা উচিত। কর্মসংস্থানের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করা উচিত। নতুন বিনিয়োগের আহ্বান করা উচিত। একটু ছাড় দিয়ে হলেও জাতীয় স্বার্থে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে।

শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে, মেধার বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে, শক্তভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কড়া নজরদারি করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিতে চাই। ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। পরীক্ষা পদ্ধতি ও মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা অবলম্বন হয়নি। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পরেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর প্রথমে নজর দিয়েছিলেন। আগে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকেরা গাফিলতি করেছিলেন, তাঁদের আইনের আওতায় এনেছিলেন। বহু শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, ফ্যাকাল্টির ডিনদের শাস্তির আওতায় এনেছিলেন। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চাই সেই রকম একটি ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা অবলম্বন করে মেধার বিকাশ ঘটিয়ে সঠিক শিক্ষা পায় আমাদের ভবিষ্যতের সুনাগরিকেরা।

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত