Ajker Patrika

বই দিয়েও ছড়িয়ে যাক জুলাই

রাজ্জাক রুবেল
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জুলাইয়ের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এই আন্দোলন কেবল রাজপথের ঘটনা ছিল না; এর পেছনে ছিল এক গভীর সাংস্কৃতিক জাগরণ। অথচ আজ, এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তিতে আমরা এক বিষণ্ন চিত্র দেখছি। যে রাষ্ট্র এই আন্দোলনের ফসল, সেই রাষ্ট্রই যেন বই, লেখক আর পাঠকের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছে। বই, লেখক বা পাঠককে ঘিরে নেই কোনো উৎসব, নেই কোনো প্রণোদনা।

আরও অবাক করা ও হতাশাজনক ব্যাপার হলো, জুলাইকে স্মরণ করতে রাষ্ট্র সিনেমা বা ডকুফিল্মকে যতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, বই বা বইমেলার আয়োজন ও প্রচারে ঠিক ততটাই উদাসীন। সিনেমা

বা ডকুফিল্মের গুরুত্ব ও আবেদন অনস্বীকার্য, কিন্তু এটাই যদি সংস্কৃতি রক্ষার একমাত্র মাধ্যম হয়, তবে তা খুবই বিপজ্জনক। কারণ, আবেগ দিয়ে তাৎক্ষণিক ইতিহাসকে ধারণ করা গেলেও চিন্তার গভীরতা আসে কেবল পাঠের মাধ্যমে।

বই হলো জাতির বিবেক, চিন্তার ধারক। বই পাঠকের নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলোকে জাগিয়ে তোলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, ইতিহাসকে বিচার করতে শেখায়। একটি জাতির যুক্তিবাদী চিন্তা আর গভীর উপলব্ধি আসে একমাত্র বইয়ের মাধ্যমেই। বারবার পাঠ করার সুযোগ, ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা আর বিতর্কের উন্মুক্ত ক্ষেত্র বই ছাড়া আর কিসে সম্ভব? তাই বই কেবল একটি মাধ্যম নয়, চিন্তাকে শাণিত করার এক অবিরাম প্রক্রিয়া।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ ছিল এক হতাশাজনক অভিজ্ঞতা। প্রকাশকেরা ৩০ দিনের খরচটুকুও ঘরে তুলতে পারেননি, বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনার কথা তো ভাবাই যায় না। যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গত বছরগুলোতে চিন্তাশীল বই প্রকাশ করেছে, যারা লেখকদের পাশে দাঁড়িয়েছে, পাঠকের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, বিগত সরকারের বিভিন্ন সেন্সরশিপের মুখেও নির্ভয়ে বই প্রকাশ করেছে—তারা আজও উপেক্ষিত। বরং যারা অতীতে স্বৈরাচারী শাসকের ঘনিষ্ঠ ছিল, তারাই এখনো রাষ্ট্রের কৃপাদৃষ্টি পাচ্ছে।

যদি রাষ্ট্র এখনই বইয়ের গুরুত্ব না বোঝে, তবে আমাদের এই অভ্যুত্থানের গভীর চেতনা আগামী প্রজন্মের কাছে ফিকে হয়ে যাবে। পাঠহীন জাতি যুক্তিহীন, আত্মবিস্মৃত এবং এক দুর্বল জাতিতে পরিণত হতে বাধ্য।

উন্নত বিশ্বে বইয়ের ওপর ব্যাপক ভর্তুকি থাকে, লেখকদের জন্য থাকে বিশেষ তহবিল, আর পাঠকদের জন্য থাকে উৎসাহমূলক কর্মসূচি। আমরা যখন ‘রিডিং সোসাইটি’ গড়ার স্বপ্ন দেখি, তখন রাষ্ট্রের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া উচিত।

আজ এই চরম হতাশায় দাঁড়িয়ে আমরা আবার রাষ্ট্রের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি—এই অবহেলা বন্ধ হোক। কারণ, এই অবহেলা শুধু একটি শিল্পকে ধ্বংস করছে না, এটি একটি জাতিকে পাঠকশূন্য, যুক্তিহীন এবং দায়িত্বহীন করে তুলবে। প্রকাশনাশিল্পকে রক্ষা করা মানে শুধু কিছু বইয়ের দোকান বাঁচানো নয়, এটি একটি জাতিকে তার আত্মপরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেওয়া। এই নীরবতা ভেঙে রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, বইয়ের বিপ্লব আসুক আমাদের প্রতিটি ঘরে।

প্রস্তাবসমূহ

১. বইভিত্তিক রাষ্ট্রীয় বর্ষপঞ্জি ঘোষণা: অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঘিরে প্রতিবছর বইমেলা, বই পুরস্কার, লেখক সমাবেশ ইত্যাদি আয়োজন করা।

২. প্রকাশনাশিল্পে অনুদান ও ভর্তুকি: নতুন ও ছোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা।

৩. স্কুল-কলেজে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা: প্রতি জেলায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা’, ‘লেখকের সঙ্গে একদিন’ ইভেন্ট চালু করা।

৪. আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজন: ফ্রাঙ্কফুর্ট, কলকাতা বা লন্ডনের আদলে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন, যেখানে স্থানীয় প্রকাশকদের বই বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করা যায়।

৫. রাষ্ট্রীয় ক্রয়ে সৃজনশীল বই অন্তর্ভুক্তি: সরকার যে বই ক্রয় করে, তাতে চিন্তাশীল, সৃজনশীল ও প্রগতিশীল বই অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো।

৬. ‘পড়ুয়া জাতি গড়ে তুলুন’ জাতীয় ক্যাম্পেইন: বই পড়ার প্রচার চালানো।

৭. প্রকাশকদের জন্য সফট লোন ও ইনকিউবেশন সেন্টার: যাঁরা পেশাগতভাবে প্রকাশনায় আসতে চান, তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা।

৮. জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়ন: প্রকাশনাশিল্পের জন্য ‘জাতীয় গ্রন্থনীতি’ প্রণয়ন করা, যাতে করে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।

৯. ডাকঘরের মাধ্যমে দেশ এবং দেশের বাইরে পাঠকের হাতে স্বল্প মূল্যে বই পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আমরা চাই, সরকার এই সমালোচনাগুলো গঠনমূলকভাবে গ্রহণ করে উদ্যোগী ভূমিকা নেবে। জুলাই আন্দোলনকে নিয়ে যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর প্রচার-প্রসারের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অনুরোধ থাকবে জুলাইকে ছড়িয়ে দিতে ডকুফিল্ম নির্মাণের পাশাপাশি পাঠকসমাজ গঠনে রাষ্ট্রের উদ্যোগী হওয়ার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত