মহিউদ্দিন খান মোহন
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গত বছরের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের সূচিত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। যার পরিণতি ঘটে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে। সে গণ-অভ্যুত্থানে পতনের মুখে দেশ থেকে সপারিষদ পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান হয় তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশ শাসনের। সরকারের যাঁরা পালিয়ে যেতে পারেননি, তাঁদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এসব খবর এখন পুরোনো।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে কোটাপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এমনটাই ধারণা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কোটা হটানোর আন্দোলনের ফসল ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ পুনরায় কোটা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি তরুণদের জন্যও কোটা চায়। কমিশন এদের জন্য ১০ শতাংশ মনোনয়নের সুপারিশ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তা স্বাক্ষরকারী ভোটাররা একক কিংবা যৌথ হলফনামার দ্বারা নিশ্চিত করবেন।
সংসদ নির্বাচনে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের এই সুপারিশ জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে—কোটা হটিয়ে আবার কোটা কেন? বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক এবং সম-অধিকারের দেশ। এখানে সবাই সমান সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে। তাই কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য বিশেষ কোটাব্যবস্থা সংরক্ষণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমদ এটাকে কোটা হিসেবে দেখতে নারাজ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, এটিকে কোটা হিসেবে না দেখাই ভালো। কারণ, সরাসরি নির্বাচনে অনেক সময় সংখ্যালঘুরা কোনো আসন পান না। তাই ১০ শতাংশ রাখা হলে তাদের প্রতিনিধিত্বটা আরও বাড়বে। তরুণদের জন্য কোটা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তরুণেরা একটি বড় আন্দোলন করেছে। তাই তাদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করার জন্য হয়তো তারা এটি করেছেন। এটাকে বৈষম্য বলা ঠিক হবে না বলে মনে করছেন তিনি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোটারদের হলফনামা দেওয়ার বিষয়টি তিনি সমর্থন করেন না। এতে জটিলতা আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করছেন। অন্যদিকে কোটায় কোনো দোষ দেখেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা। তবে তরুণদের বিষয়টি যুক্ত না করলে চলত বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার মনে করেন, এটি কোটা নয়, তরুণদের প্রতিনিধিত্ব রাখা। তবে যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন ২১ বছর বয়সীদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এমনিতেই তরুণেরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়তে পারবে। সে ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ না হয়ে ৫ শতাংশ হলে ভালো হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে আর কোটা নামের মুসিবত নাজেল হবে না—এমন একটা প্রতীতি অনেকের মনেই জন্মেছিল। অথচ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সে পরিত্যক্ত কোটাব্যবস্থার পুনর্বহালেরই ইঙ্গিত মেলে। আমাদের সংবিধান দেশের বৈধ নাগরিকদের রাজনীতি করার সমান অধিকার দিয়েছে। তারপরও জাতীয় সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক আসন সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের প্রথম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ১৫টি। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ১০ বছরের জন্য এই বিধান করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তা পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য বহাল ও আসনসংখ্যা ৩০টিতে উন্নীত করা হয়। ১৯৯০ সালে তা আরও ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। ২০০৫ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে তা ৪৫-এ এবং ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা ৫০ করা হয়। পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনেও নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে।
ইতিপূর্বে বিভিন্ন মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, যেহেতু নারীরা এখন অনেক অগ্রসর, পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা সর্বক্ষেত্রে সমান ভূমিকা রাখছে, তাই সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিধানটি বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই। কেউ কেউ সম-অধিকারের এই সময়ে ‘সংরক্ষিত’ আসন নারীদের জন্য অসম্মানজনক বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা সেসব অভিমতকে গ্রহণীয় বিবেচনা করেননি। ফলে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। উপরন্তু এবার সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৪০০ করে নারীদের জন্য সারা দেশে ১০০ আসন নির্দিষ্ট করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে; যেগুলোতে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এখন আবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তরুণদের জন্য কোটার সুপারিশ করেছে। যে কোটার বিরুদ্ধে তরুণরা ঐতিহাসিক আন্দোলন করে জাতির বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা একটি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাল, সেই তরুণদের পুনরায় কেন কোটার বেড়াজালে আবদ্ধ করার এই উদ্যোগ, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
যুক্তি হিসেবে ড. সাব্বির আহমদ বলেছেন, যেহেতু তরুণেরা একটি বড় আন্দোলন করেছে, তাই তাদের জন্য এটা করা যেতেই পারে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর তাবৎ আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাস তাঁর জানা থাকার কথা। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সবখানেই আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণেরাই সম্মুখ সারিতে থাকে। প্রবীণেরা নেতৃত্বে থাকলেও আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে নেয় তরুণেরাই। আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে দৃকপাত করলে একই ঘটনা দেখতে পাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ছাত্র-তরুণেরাই ছিল উদগাতা। সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তরুণেরাই ছিল অগ্রগামী সৈনিক। কই, সেসব আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সে জন্য তরুণদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার বা বিশেষ সুবিধা দেওয়ার তো কথা ওঠেনি! তাহলে এখন কেন তরুণদের প্রাধান্য দেওয়ার এই অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনা?
না, তাই বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে আমি রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তরুণদের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করছি। তরুণেরা অবশ্যই এগিয়ে আসবে। তবে তার আগে তাদের সে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এটা ঠিক, আজকের তরুণেরাই একদিন প্রবীণ হবে, তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করবে। বিষয়টি নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি কথা হচ্ছিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে। সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রার্থী হওয়ার বয়স ২১ করার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, আমি সেটাকে অপরিণামদর্শী বলে অভিহিত করেছি। কেননা, তরুণদের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় সংসদকে ‘কচিকাঁচার আসরে’ পরিণত করা কোনোমতেই সুবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে না।
সাধারণত একজন তরুণের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়ে থাকে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে, যদি সে তাতে অংশ নেয়। তারপর ধীরে ধীরে সে জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করে এবং যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ সদস্য হতে পারে। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর তার বিপরীতে যদি কৈশোর পেরোনোর আগেই একজনকে আইনপ্রণেতা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী। কেননা, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপক্বতা দুইভাবে আসতে পারে। এক. প্রাকৃতিকভাবে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। দুই. পড়াশোনা ও হাতে-কলমে কাজ করে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়সী একজন মানুষের রাজনীতি, প্রশাসন ও আইন সম্বন্ধে যে জ্ঞান থাকে, একুশ বছর বয়সী একজন তরুণের তা থাকার কথা নয়। সুতরাং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স পঁচিশের নিচে না আনাই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
আমাদের দেশে একটি ছড়ার প্রচলন রয়েছে—‘নতুন কিছু করো রে ভাই নতুন কিছু করো,/কিছুই যদি না পারো তো বউকে ধরে মারো’। সংস্কার ভাবনা যেন অনুরূপ উদাহরণ সৃষ্টি না করে, সেদিকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: মহিউদ্দিন খান মোহন
সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গত বছরের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের সূচিত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। যার পরিণতি ঘটে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে। সে গণ-অভ্যুত্থানে পতনের মুখে দেশ থেকে সপারিষদ পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান হয় তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশ শাসনের। সরকারের যাঁরা পালিয়ে যেতে পারেননি, তাঁদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এসব খবর এখন পুরোনো।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে কোটাপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এমনটাই ধারণা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কোটা হটানোর আন্দোলনের ফসল ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ পুনরায় কোটা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি তরুণদের জন্যও কোটা চায়। কমিশন এদের জন্য ১০ শতাংশ মনোনয়নের সুপারিশ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তা স্বাক্ষরকারী ভোটাররা একক কিংবা যৌথ হলফনামার দ্বারা নিশ্চিত করবেন।
সংসদ নির্বাচনে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের এই সুপারিশ জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে—কোটা হটিয়ে আবার কোটা কেন? বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক এবং সম-অধিকারের দেশ। এখানে সবাই সমান সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে। তাই কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য বিশেষ কোটাব্যবস্থা সংরক্ষণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমদ এটাকে কোটা হিসেবে দেখতে নারাজ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, এটিকে কোটা হিসেবে না দেখাই ভালো। কারণ, সরাসরি নির্বাচনে অনেক সময় সংখ্যালঘুরা কোনো আসন পান না। তাই ১০ শতাংশ রাখা হলে তাদের প্রতিনিধিত্বটা আরও বাড়বে। তরুণদের জন্য কোটা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তরুণেরা একটি বড় আন্দোলন করেছে। তাই তাদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করার জন্য হয়তো তারা এটি করেছেন। এটাকে বৈষম্য বলা ঠিক হবে না বলে মনে করছেন তিনি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোটারদের হলফনামা দেওয়ার বিষয়টি তিনি সমর্থন করেন না। এতে জটিলতা আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করছেন। অন্যদিকে কোটায় কোনো দোষ দেখেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা। তবে তরুণদের বিষয়টি যুক্ত না করলে চলত বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার মনে করেন, এটি কোটা নয়, তরুণদের প্রতিনিধিত্ব রাখা। তবে যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন ২১ বছর বয়সীদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এমনিতেই তরুণেরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়তে পারবে। সে ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ না হয়ে ৫ শতাংশ হলে ভালো হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে আর কোটা নামের মুসিবত নাজেল হবে না—এমন একটা প্রতীতি অনেকের মনেই জন্মেছিল। অথচ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সে পরিত্যক্ত কোটাব্যবস্থার পুনর্বহালেরই ইঙ্গিত মেলে। আমাদের সংবিধান দেশের বৈধ নাগরিকদের রাজনীতি করার সমান অধিকার দিয়েছে। তারপরও জাতীয় সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক আসন সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের প্রথম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ১৫টি। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ১০ বছরের জন্য এই বিধান করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তা পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য বহাল ও আসনসংখ্যা ৩০টিতে উন্নীত করা হয়। ১৯৯০ সালে তা আরও ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। ২০০৫ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে তা ৪৫-এ এবং ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা ৫০ করা হয়। পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনেও নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে।
ইতিপূর্বে বিভিন্ন মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, যেহেতু নারীরা এখন অনেক অগ্রসর, পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা সর্বক্ষেত্রে সমান ভূমিকা রাখছে, তাই সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিধানটি বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই। কেউ কেউ সম-অধিকারের এই সময়ে ‘সংরক্ষিত’ আসন নারীদের জন্য অসম্মানজনক বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা সেসব অভিমতকে গ্রহণীয় বিবেচনা করেননি। ফলে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। উপরন্তু এবার সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৪০০ করে নারীদের জন্য সারা দেশে ১০০ আসন নির্দিষ্ট করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে; যেগুলোতে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এখন আবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তরুণদের জন্য কোটার সুপারিশ করেছে। যে কোটার বিরুদ্ধে তরুণরা ঐতিহাসিক আন্দোলন করে জাতির বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা একটি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাল, সেই তরুণদের পুনরায় কেন কোটার বেড়াজালে আবদ্ধ করার এই উদ্যোগ, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
যুক্তি হিসেবে ড. সাব্বির আহমদ বলেছেন, যেহেতু তরুণেরা একটি বড় আন্দোলন করেছে, তাই তাদের জন্য এটা করা যেতেই পারে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর তাবৎ আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাস তাঁর জানা থাকার কথা। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সবখানেই আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণেরাই সম্মুখ সারিতে থাকে। প্রবীণেরা নেতৃত্বে থাকলেও আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে নেয় তরুণেরাই। আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে দৃকপাত করলে একই ঘটনা দেখতে পাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ছাত্র-তরুণেরাই ছিল উদগাতা। সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তরুণেরাই ছিল অগ্রগামী সৈনিক। কই, সেসব আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সে জন্য তরুণদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার বা বিশেষ সুবিধা দেওয়ার তো কথা ওঠেনি! তাহলে এখন কেন তরুণদের প্রাধান্য দেওয়ার এই অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনা?
না, তাই বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে আমি রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তরুণদের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করছি। তরুণেরা অবশ্যই এগিয়ে আসবে। তবে তার আগে তাদের সে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এটা ঠিক, আজকের তরুণেরাই একদিন প্রবীণ হবে, তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করবে। বিষয়টি নিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি কথা হচ্ছিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে। সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রার্থী হওয়ার বয়স ২১ করার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, আমি সেটাকে অপরিণামদর্শী বলে অভিহিত করেছি। কেননা, তরুণদের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় সংসদকে ‘কচিকাঁচার আসরে’ পরিণত করা কোনোমতেই সুবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে না।
সাধারণত একজন তরুণের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়ে থাকে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে, যদি সে তাতে অংশ নেয়। তারপর ধীরে ধীরে সে জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করে এবং যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ সদস্য হতে পারে। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর তার বিপরীতে যদি কৈশোর পেরোনোর আগেই একজনকে আইনপ্রণেতা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী। কেননা, মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির পরিপক্বতা দুইভাবে আসতে পারে। এক. প্রাকৃতিকভাবে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। দুই. পড়াশোনা ও হাতে-কলমে কাজ করে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়সী একজন মানুষের রাজনীতি, প্রশাসন ও আইন সম্বন্ধে যে জ্ঞান থাকে, একুশ বছর বয়সী একজন তরুণের তা থাকার কথা নয়। সুতরাং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স পঁচিশের নিচে না আনাই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
আমাদের দেশে একটি ছড়ার প্রচলন রয়েছে—‘নতুন কিছু করো রে ভাই নতুন কিছু করো,/কিছুই যদি না পারো তো বউকে ধরে মারো’। সংস্কার ভাবনা যেন অনুরূপ উদাহরণ সৃষ্টি না করে, সেদিকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: মহিউদ্দিন খান মোহন
সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠানের মাপে নিজেকে ছেঁটে খাটো না করার প্রত্যয়ে ফরাসি দার্শনিক ও লেখক জঁ পল সার্ত্রে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কথায় ‘ইনস্টিটিউশনালাইজড’ হতে চাই না, তাই সবিনয় প্রত্যাখ্যান। পুরস্কার একধরনের স্বীকৃতি। সেটি কার না পেতে ভালো লাগে? সলিমুল্লাহ খান যখন ‘লোক’ সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ
৬ ঘণ্টা আগেআজ সম্পাদকীয় লেখার অনেক বিষয় ছিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা যেত, বইমেলা নিয়ে লেখা যেত, লেখা যেত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। কিন্তু লিখতে গিয়ে আজকের পত্রিকার বিনোদন পাতায় একটি সংবাদের দিকে চোখ আটকে গেল। ১৫ ফেব্রুয়ারি
৬ ঘণ্টা আগেভাষা নিয়ে কিছু বলতে গেলে সে সময়ের সমাজ নিয়েও কথা বলতে হয়। কীভাবে বাংলা ভাষা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সকলের ভাষা হয়ে উঠল, কীভাবে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে দেশের জনগণ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রস্তুত হলো, তার পটভূমি জানা দরকার।
১২ ঘণ্টা আগেআটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এবং বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি এক মুখ্য গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্লোগানগুলো ছিল কখনো গানের ভাষায়, কখনো রাজপথের রুদ্র বাক্যে—‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ অথবা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কৃষক লাঙল চালাতে চালাতে থমকে দাঁড়ায়, ‘কী ব্যাপার, মুখের ভাষা কাইড়া...
১ দিন আগে