Ajker Patrika

গাজার শিশুদের জন্য আরেক দুঃস্বপ্নের ঈদ

এম আর রহমান
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৮: ৪৪
ঈদে নতুন পোশাক, মজার খাবার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ নেই গাজার শিশুদের। ছবি: সংগৃহীত
ঈদে নতুন পোশাক, মজার খাবার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ নেই গাজার শিশুদের। ছবি: সংগৃহীত

তারিখটা ছিল ১৭ মার্চ। রমজানের ১৮তম দিনে সেহরি করছিলেন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা। হঠাৎ তাঁদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী বোমা হামলা চালানো শুরু করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারায় ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি। আহত হয় শতাধিক। এর পর থেকে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রতিদিনই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, এসব হামলায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ মার্চের হামলায় ৪৩০ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ১৮০টির বেশি শিশু ছিল।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতের মধ্যে গাজার শিশুদের হতাহতের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া ইসরায়েলের সামরিক হামলায় গাজায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১৭ হাজারই শিশু। ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুও।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, গাজার শিশুদের হত্যা করে ইসরায়েলের কী লাভ হচ্ছে? ইসরায়েল দাবি করে যে তাদের সামরিক অভিযান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। তবে বাস্তবে, এই হামলায় অসংখ্য নিরপরাধ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ ও সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারছে না এই শিশুদের জন্য।

ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা ও চিরতরে পঙ্গু করার ইসরায়েলি গোপন পরিকল্পনা অনেক দিনের। তারই বাস্তবায়ন গাজায় দেখছে বিশ্ববাসী। বলতে পারেন, কেন? উত্তরটা হচ্ছে–ইসরায়েলের হিসাবটাই এ রকম যে ফিলিস্তিনের একটি ছেলেশিশুকে হত্যা করা মানে ভবিষ্যতের একজন প্রতিবাদী যোদ্ধাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা। আর একটি মেয়েশিশুকে হত্যা করলে, ভবিষ্যতে ৭-৮টি ফিলিস্তিনি শিশুর জন্ম রোধ করা সম্ভব। একই সঙ্গে গাজা বা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি মায়েদের ওপর নৃশংসতা বা বলপ্রয়োগ একটু কমই লাগবে। হিসাবটা একেবারেই বরাবর। সবই ভবিষ্যতের হিসাব, যা শুরু হয়েছে ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকে এবং এটা এখনো চলমান।

জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মতে, গাজায় সংঘাতের ফলে শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বয়ে আনছে। ইসরায়েলি হামলা ও অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে গাজা উপত্যকার শিশুদের জীবন আজ এক গভীর মানবিক সংকটে নিমজ্জিত। এই অঞ্চলের শিশুরা প্রতিদিনই নতুন নতুন দুর্দশার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বোমা হামলা, গোলাগুলি এবং ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে বসবাস করছে তারা। এই পরিস্থিতি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। শিশু অধিকারবিষয়ক সংস্থা ওয়ার চাইল্ড অ্যালায়েন্স এবং কমিউনিটি ট্রেনিং সেন্টার ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গাজার ৯৬ শতাংশ শিশু মনে করে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং ৪৯ শতাংশ শিশু জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর, ইসরায়েল গাজার ওপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করার পর, খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছে। ফলে খেতে পারছে না ফিলিস্তিনিরা। খেতে পারছে না সেখানকার শিশুরা। ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে গাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্কুল ধ্বংস হয়েছে। আবার অনেক স্কুল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। বিশেষ করে শীতকালে পর্যাপ্ত গরম পোশাক ও আশ্রয়ের অভাবে শিশুরা হাইপোথার্মিয়ার শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি এক মাস বয়সী শিশু আলী আল-বাতরান হাইপোথার্মিয়ায় মারা গেছে এবং তার যমজ ভাইও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

ইসরায়েলি হামলার ফলে হাজারো পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে। এই বাস্তুচ্যুত শিশুরা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তীব্র শীত ও ভারী বৃষ্টিতে তাদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।

রমজানের দ্বিতীয় দিনে ইসরায়েল গাজার ওপর পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর ১৫ মার্চ ইউনিসেফের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গাজার উত্তরাঞ্চলে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টির হার জানুয়ারিতে ছিল ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ৩১ শতাংশে পৌঁছেছে; কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অপুষ্টি এবং পানিশূন্যতায় ২৩ শিশু মারা গেছে। গাজার বাকি অংশেও একই অবস্থা দেখা গেছে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেছেন, ‘গাজায় শিশু অপুষ্টির এই চিত্র ভয়াবহ। এটি আমাদের হতবাক করেছে।’

ক্যাথরিন রাসেলের মতে, শৈশবে অপুষ্টির অভিজ্ঞতা জীবনভর ভোগাতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে যোগাযোগে সমস্যা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দেরি হওয়া এবং শিক্ষামূলক ফলাফলের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হওয়া। অনেক শিশু তাদের পরিবার ও প্রিয়জনদের হারিয়েছে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

তবে গাজার শিশুদের এই দুর্দশা দেখেও কারও মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। তাদের কষ্ট লাঘবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। গাজার শিশুদের এই দুর্বিষহ জীবন আমাদের সবার জন্য কষ্টের একটি বিষয়। তাদের নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে বিশ্ববাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি।

সামনে ঈদ আসছে। গাজার শিশুদের জন্য ঈদ মানে ছিল নতুন পোশাক, মজার মজার খাবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করা। কিন্তু এবারের ঈদে এসব কিছুই হবে না, তা হলফ করে বলাই যায়। গাজার শিশুদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত গাজার শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তারা আবারও ঈদের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইউটিউবে ১০০০ ভিউতে আয় কত

মেয়াদোত্তীর্ণ ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রণে সার্ভার, ঝুলে আছে ৭ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স

বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে সরকার, ভয়ে কলকাতায় দিলীপ কুমারের আত্মহত্যা

বাকৃবির ৫৭ শিক্ষকসহ ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

সাবেক সেনাপ্রধান হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম ক্লাবের গেস্ট হাউসে, দরজা ভেঙে বিছানায় মিলল তাঁর লাশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত