বিশেষ জাতিসত্তার প্রতিনিধিদের নিকোনো উঠোনে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। একদা তারা আমাদের বনভূমি পাহারা দিয়েছে, জলাধারকে শুষ্ক হতে দেয়নি। বনজ প্রাণিকুলকে প্রতিপালন করেছে। তারা বয়স্ক মানুষকে কীভাবে শ্রদ্ধা করে, তা-ও আমাদের শেখার বিষয়।
মামুনুর রশীদ
দীর্ঘদিন যাবৎ উদ্যাপিত পয়লা বৈশাখ নিয়ে এবারে বেশ অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল—আদৌ পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করা যাবে কি না। শেষ পর্যন্ত সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী দুদিন ধরে উদ্যাপনের একটি ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার ‘মঙ্গল’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ছিল। দ্বিতীয় শোভাযাত্রা অন্য একটা চেহারা পাবে। দেশের অন্য জাতিসত্তাগুলোও এই সঙ্গে যুক্ত হবে। বহুল ব্যবহৃত শব্দ ইনক্লুসিভ যুক্ত হলো। দুটি বিষয়ই স্পর্শকাতর। একটি শব্দ মঙ্গল। প্রাচীন কাব্যসমূহ এখনো আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই মঙ্গলের বিপরীতে অমঙ্গল ভাবার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। আদিকাল থেকেই বাঙালি মঙ্গল কামনা করেছে। বানভাসি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজদ্রোহের সংকট, নানা উপল্লবে বিধ্বস্ত দেশ, জাতি, রাষ্ট্র সব সময়ই কবি এবং সামাজিকগণ কাব্যরচনা করে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করেছেন।
আমাদের দেশে আশির দশকে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার সময়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করা হতো। শিল্পের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই শোভাযাত্রার উদ্বোধন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কিছু উদ্যমী ছাত্র এবং তরুণ শিল্পীরা এটির আয়োজন করেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নগণ্য ভূমিকা পালন করেছি। বড় একটা ঘটনা ঘটে বাংলা ১৪০০ সালে। বাংলা নববর্ষের শতবর্ষের সূচনাতে চারুকলাকে কেন্দ্র করেই মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং শতবর্ষ উদ্যাপিত হয়। আমি এবং শিল্পী রফিকুন নবী আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেই থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা চলছে। প্রখর রৌদ্রতাপ অথবা বর্ষণ—কোনোটাতেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়নি।
বহু বছর ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রার বহু আগে থেকেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চাকমাদের বিজু উৎসব হয় পয়লা বৈশাখের আগেই। মারমা, মুরং, সাঁওতাল, গারো সবারই নিজস্ব বর্ষ শুরু উৎসব আছে। সেই উৎসবগুলোর আচার-অনুষ্ঠান স্বতন্ত্র। সব জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবগুলো নিজস্ব নিয়মে হয়ে থাকে। বাঙালিদের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবের সঙ্গে সেগুলো যুক্ত করার একটিই কারণ যে তারাও নিজস্ব জাতিসত্তার বাইরে এসে একটা বড় উৎসবে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বকীয়তা কিছুটা হলেও হারাবে। এই সময়ে তাদের আঞ্চলিকভাবে অনেক ধরনের উৎসব থাকে। সেসব ফেলে দিয়ে সরকারি এই আয়োজনে আসা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে বিশেষ জাতিসত্তাগুলোর নেতা বা সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কি কোনো আলোচনা হয়েছে? যেকোনো বিষয় ‘ইনক্লুসিভ’ করতে হলে তার জন্য এই বিশেষ জাতিসত্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করা খুবই জরুরি।
তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়েও অনেক কথা আছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে তাদের বলা হয় উপজাতি, আবার ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের বলা হতো ‘ট্রাইবাল’। গত সরকারের সময় তাদের নামকরণ করা হলো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। আজ সারা পৃথিবীতেই ‘ইনডেজিনাস পিপল’ বা আদিবাসী নামটি যখন স্বীকৃত, তখন বাংলাদেশে এ নামে অভিহিত করলে ক্ষতিটা কী? জাতিসংঘের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই বাংলাদেশ সরকার যুক্ত আছে। ‘আদিবাসী’দের সঙ্গে অনেক ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি শুধু নয়, এমনকি সশস্ত্র সংগ্রামও হয়ে গেছে। অনেক চুক্তিও হয়েছে, কিন্তু সেসবের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। এসব ক্ষেত্রে পাহাড়ে বা সমতলে একই অবস্থা। গারোরা বিপুল সংখ্যায় দেশ ত্যাগ করেছে, সাঁওতালরা এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। তাদের জমির অধিকার এখনো স্বীকৃত হয়নি।
বিশেষ জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভুল-বোঝাবুঝি, বোঝাপড়ার অনেক উপায়ের মধ্যে একটা বড় উপায় ছিল সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য অগ্রহণযোগ্য হলেও কিছু উপজাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। এসবের নাম পরিবর্তন করে ‘আদিবাসী কেন্দ্র’ হলে তাদের অংশীদারত্ব আরও বাড়তে পারত। বিশেষ জাতিসত্তার মানুষদের রয়েছে সুদীর্ঘ সংস্কৃতি, যার মধ্যে তাদের উৎপাদনব্যবস্থা, ভাষা, বয়নশিল্প, খাদ্যাভ্যাস, ধর্ম উদ্যাপনের ভিন্নতা, সামাজিক আচার, বিনোদনসহ অনেক বিষয়। বাঙালিদের সঙ্গে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে মিল থাকলেও জীবনব্যবস্থা একেবারেই ভিন্ন। আমরা সেসব শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার সঙ্গে দেখিনি। হঠাৎ করে যদি আজকে তাদের আমাদের মধ্যে টেনে আনি, তাহলে তা হবে যান্ত্রিক এক উদ্যাপনমাত্র।
ভাষাগত ভিন্নতা নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। মাতৃভাষায় লেখাপড়া করার বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো কার্যত এখনো শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত হয়নি। একসময় তাদের বাঙালি হওয়ার কথা বলে একটা সশস্ত্র সংগ্রামের ফলাফলে পার্বত্য জেলাগুলোয় দীর্ঘ সময় অশান্তিও চলেছে। সাম্প্রতিক সময়েও অনেক ঘটনা বিশেষ জাতিসত্তার মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভকে আবার চাঙা করে তুলছে। তাদের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হতে গিয়ে অনেক অসাম্য ও রাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক দূরত্ব লক্ষ করে বিস্মিতও হয়েছি। খোদ ঢাকা শহরে পাঠ্যপুস্তকের একটি বিষয় নিয়ে আন্দোলনরত বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর ছাত্রদের যেভাবে লাঞ্ছিত করে আহত করা হয়েছে, সেসবও আমরা লক্ষ করেছি।
কিছুদিন আগে রাঙামাটির গ্রামের একটি পর্যটনকেন্দ্রকে যেভাবে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য বড় ধরনের একটা ক্ষোভ তাদের অন্তরাত্মাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এসবই তাদের সমস্যার ছোট্ট একটা প্রতিবেদন।
উপদেষ্টা বলেছেন, রং পরিবর্তন করা হবে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যিই, নানা সমস্যা নিয়ে তারা এখনো রঙিন। ঘরে খাদ্যাভাব আছে, দারিদ্র্য আছে, কিন্তু সাঁওতাল তার উৎসবকে ত্যাগ করেনি। গারোর জীবনে নিত্য সমস্যা, তবু ওয়ানগালাকে সে রঙিন করে তোলে তাদের শিল্প দিয়ে। তাদের বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য, সংগীত দিয়ে জীবনের অপূর্ণতাকে ভরিয়ে দেয়। এখনো বিশেষ জাতিসত্তার প্রতিনিধিদের নিকোনো উঠোনে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। একদা তারা আমাদের বনভূমি পাহারা দিয়েছে, জলাধারকে শুষ্ক হতে দেয়নি। বনজ প্রাণিকুলকে প্রতিপালন করেছে। তারা বয়স্ক মানুষকে কীভাবে শ্রদ্ধা করে, তা-ও আমাদের শেখার বিষয়।
সমস্যা হচ্ছে, সেই মানুষগুলোর সামনে বন উজাড় হয়েছে, পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে, জলাধারগুলো শুকনো হয়ে যাচ্ছে। জুম চাষে অনর্থ হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও বেআইনি অভিবাসনে তারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এসবের জন্য রাষ্ট্র কী ভূমিকা রাখছে? বাঙালিরও রং আছে জীবনে এবং চিন্তায়। ওদেরও রং আছে সংস্কৃতিতে, ইতিহাসে। সংগ্রামের ইতিহাসও সবারই আছে। এই তো সেদিনই প্রয়াত হলেন লড়াইয়ের প্রতীক কুমুদিনী হাজং, হাজং বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ—সর্বত্রই তিনি বড় যোদ্ধা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রেখেছেন। আমরাও একটি জাতি, যার রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। তেমনি ওরাও ধারণ করছে বড় বড় সংগ্রামের ইতিহাস। ওরা ওদের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যাক, আমাদের সঙ্গে ওদের সাক্ষাৎ হবে, শ্রদ্ধা বিনিময়ে, ভালোবাসায় পরস্পর পরস্পরকে শেখার মধ্যে, ভালোবাসার বিনিময়ে। এই জায়গা থেকে যদি শুরু করা যায়, তাহলে শুধু পয়লা বৈশাখ নয়, নানা উৎসবেই আমরা একত্র হতে পারি।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
দীর্ঘদিন যাবৎ উদ্যাপিত পয়লা বৈশাখ নিয়ে এবারে বেশ অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল—আদৌ পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করা যাবে কি না। শেষ পর্যন্ত সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী দুদিন ধরে উদ্যাপনের একটি ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার ‘মঙ্গল’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ছিল। দ্বিতীয় শোভাযাত্রা অন্য একটা চেহারা পাবে। দেশের অন্য জাতিসত্তাগুলোও এই সঙ্গে যুক্ত হবে। বহুল ব্যবহৃত শব্দ ইনক্লুসিভ যুক্ত হলো। দুটি বিষয়ই স্পর্শকাতর। একটি শব্দ মঙ্গল। প্রাচীন কাব্যসমূহ এখনো আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই মঙ্গলের বিপরীতে অমঙ্গল ভাবার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। আদিকাল থেকেই বাঙালি মঙ্গল কামনা করেছে। বানভাসি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজদ্রোহের সংকট, নানা উপল্লবে বিধ্বস্ত দেশ, জাতি, রাষ্ট্র সব সময়ই কবি এবং সামাজিকগণ কাব্যরচনা করে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করেছেন।
আমাদের দেশে আশির দশকে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার সময়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করা হতো। শিল্পের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই শোভাযাত্রার উদ্বোধন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কিছু উদ্যমী ছাত্র এবং তরুণ শিল্পীরা এটির আয়োজন করেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নগণ্য ভূমিকা পালন করেছি। বড় একটা ঘটনা ঘটে বাংলা ১৪০০ সালে। বাংলা নববর্ষের শতবর্ষের সূচনাতে চারুকলাকে কেন্দ্র করেই মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং শতবর্ষ উদ্যাপিত হয়। আমি এবং শিল্পী রফিকুন নবী আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেই থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা চলছে। প্রখর রৌদ্রতাপ অথবা বর্ষণ—কোনোটাতেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়নি।
বহু বছর ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রার বহু আগে থেকেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চাকমাদের বিজু উৎসব হয় পয়লা বৈশাখের আগেই। মারমা, মুরং, সাঁওতাল, গারো সবারই নিজস্ব বর্ষ শুরু উৎসব আছে। সেই উৎসবগুলোর আচার-অনুষ্ঠান স্বতন্ত্র। সব জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবগুলো নিজস্ব নিয়মে হয়ে থাকে। বাঙালিদের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবের সঙ্গে সেগুলো যুক্ত করার একটিই কারণ যে তারাও নিজস্ব জাতিসত্তার বাইরে এসে একটা বড় উৎসবে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বকীয়তা কিছুটা হলেও হারাবে। এই সময়ে তাদের আঞ্চলিকভাবে অনেক ধরনের উৎসব থাকে। সেসব ফেলে দিয়ে সরকারি এই আয়োজনে আসা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে বিশেষ জাতিসত্তাগুলোর নেতা বা সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কি কোনো আলোচনা হয়েছে? যেকোনো বিষয় ‘ইনক্লুসিভ’ করতে হলে তার জন্য এই বিশেষ জাতিসত্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করা খুবই জরুরি।
তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়েও অনেক কথা আছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে তাদের বলা হয় উপজাতি, আবার ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের বলা হতো ‘ট্রাইবাল’। গত সরকারের সময় তাদের নামকরণ করা হলো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। আজ সারা পৃথিবীতেই ‘ইনডেজিনাস পিপল’ বা আদিবাসী নামটি যখন স্বীকৃত, তখন বাংলাদেশে এ নামে অভিহিত করলে ক্ষতিটা কী? জাতিসংঘের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই বাংলাদেশ সরকার যুক্ত আছে। ‘আদিবাসী’দের সঙ্গে অনেক ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি শুধু নয়, এমনকি সশস্ত্র সংগ্রামও হয়ে গেছে। অনেক চুক্তিও হয়েছে, কিন্তু সেসবের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। এসব ক্ষেত্রে পাহাড়ে বা সমতলে একই অবস্থা। গারোরা বিপুল সংখ্যায় দেশ ত্যাগ করেছে, সাঁওতালরা এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। তাদের জমির অধিকার এখনো স্বীকৃত হয়নি।
বিশেষ জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভুল-বোঝাবুঝি, বোঝাপড়ার অনেক উপায়ের মধ্যে একটা বড় উপায় ছিল সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান। সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য অগ্রহণযোগ্য হলেও কিছু উপজাতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। এসবের নাম পরিবর্তন করে ‘আদিবাসী কেন্দ্র’ হলে তাদের অংশীদারত্ব আরও বাড়তে পারত। বিশেষ জাতিসত্তার মানুষদের রয়েছে সুদীর্ঘ সংস্কৃতি, যার মধ্যে তাদের উৎপাদনব্যবস্থা, ভাষা, বয়নশিল্প, খাদ্যাভ্যাস, ধর্ম উদ্যাপনের ভিন্নতা, সামাজিক আচার, বিনোদনসহ অনেক বিষয়। বাঙালিদের সঙ্গে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে মিল থাকলেও জীবনব্যবস্থা একেবারেই ভিন্ন। আমরা সেসব শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার সঙ্গে দেখিনি। হঠাৎ করে যদি আজকে তাদের আমাদের মধ্যে টেনে আনি, তাহলে তা হবে যান্ত্রিক এক উদ্যাপনমাত্র।
ভাষাগত ভিন্নতা নিয়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। মাতৃভাষায় লেখাপড়া করার বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো কার্যত এখনো শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত হয়নি। একসময় তাদের বাঙালি হওয়ার কথা বলে একটা সশস্ত্র সংগ্রামের ফলাফলে পার্বত্য জেলাগুলোয় দীর্ঘ সময় অশান্তিও চলেছে। সাম্প্রতিক সময়েও অনেক ঘটনা বিশেষ জাতিসত্তার মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভকে আবার চাঙা করে তুলছে। তাদের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হতে গিয়ে অনেক অসাম্য ও রাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক দূরত্ব লক্ষ করে বিস্মিতও হয়েছি। খোদ ঢাকা শহরে পাঠ্যপুস্তকের একটি বিষয় নিয়ে আন্দোলনরত বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর ছাত্রদের যেভাবে লাঞ্ছিত করে আহত করা হয়েছে, সেসবও আমরা লক্ষ করেছি।
কিছুদিন আগে রাঙামাটির গ্রামের একটি পর্যটনকেন্দ্রকে যেভাবে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য বড় ধরনের একটা ক্ষোভ তাদের অন্তরাত্মাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এসবই তাদের সমস্যার ছোট্ট একটা প্রতিবেদন।
উপদেষ্টা বলেছেন, রং পরিবর্তন করা হবে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যিই, নানা সমস্যা নিয়ে তারা এখনো রঙিন। ঘরে খাদ্যাভাব আছে, দারিদ্র্য আছে, কিন্তু সাঁওতাল তার উৎসবকে ত্যাগ করেনি। গারোর জীবনে নিত্য সমস্যা, তবু ওয়ানগালাকে সে রঙিন করে তোলে তাদের শিল্প দিয়ে। তাদের বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য, সংগীত দিয়ে জীবনের অপূর্ণতাকে ভরিয়ে দেয়। এখনো বিশেষ জাতিসত্তার প্রতিনিধিদের নিকোনো উঠোনে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। একদা তারা আমাদের বনভূমি পাহারা দিয়েছে, জলাধারকে শুষ্ক হতে দেয়নি। বনজ প্রাণিকুলকে প্রতিপালন করেছে। তারা বয়স্ক মানুষকে কীভাবে শ্রদ্ধা করে, তা-ও আমাদের শেখার বিষয়।
সমস্যা হচ্ছে, সেই মানুষগুলোর সামনে বন উজাড় হয়েছে, পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে, জলাধারগুলো শুকনো হয়ে যাচ্ছে। জুম চাষে অনর্থ হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও বেআইনি অভিবাসনে তারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এসবের জন্য রাষ্ট্র কী ভূমিকা রাখছে? বাঙালিরও রং আছে জীবনে এবং চিন্তায়। ওদেরও রং আছে সংস্কৃতিতে, ইতিহাসে। সংগ্রামের ইতিহাসও সবারই আছে। এই তো সেদিনই প্রয়াত হলেন লড়াইয়ের প্রতীক কুমুদিনী হাজং, হাজং বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ—সর্বত্রই তিনি বড় যোদ্ধা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রেখেছেন। আমরাও একটি জাতি, যার রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। তেমনি ওরাও ধারণ করছে বড় বড় সংগ্রামের ইতিহাস। ওরা ওদের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যাক, আমাদের সঙ্গে ওদের সাক্ষাৎ হবে, শ্রদ্ধা বিনিময়ে, ভালোবাসায় পরস্পর পরস্পরকে শেখার মধ্যে, ভালোবাসার বিনিময়ে। এই জায়গা থেকে যদি শুরু করা যায়, তাহলে শুধু পয়লা বৈশাখ নয়, নানা উৎসবেই আমরা একত্র হতে পারি।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল।
১৫ ঘণ্টা আগেবর্ষাকাল এলেই যেন ঢাকায় জলাবদ্ধতা ভর করে বসে। জলাবদ্ধতা যখন এই শহরের ঘাড়ে চেপে বসে, তখন এই নগরের মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আজ এই শহরের এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না যদি তারা অপরিকল্পিত নগরায়ণের দিকে না ঝুঁকত, যদি নদী কিংবা খালের স্থান দখল না করে কোনো স্থাপনা করার পরিকল্পনা করত।
১৫ ঘণ্টা আগেটাঙ্গাইলের সখীপুর-কচুয়া-আড়াইপাড়া সড়কের যে করুণ অবস্থা, তা আসলে আমাদের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক—যেখানে প্রতিদিন স্কুলশিক্ষার্থী, রোগী, কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক ও হাজারো সাধারণ মানুষ চলাচল করে।
১৫ ঘণ্টা আগেজুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ওই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মূলত তারা ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত বাংলাদেশের মূল সমস্যা সেটাই যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি
২ দিন আগে