Ajker Patrika

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও বিতর্ক

তাহমিনা কোরেশী
আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১৭: ২৪
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালার ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনটি সমাজে নারী-পুরুষ সমতার বাস্তবায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু সুস্পষ্টভাবে নারীর অধিকারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, আবার কিছু সুপারিশ কাঠামোগত ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের দাবি তোলে।

কমিশনের সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাবগুলোর একটি হলো—উত্তরাধিকার ও সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। এটি ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে জটিল ও সংবেদনশীল হলেও নাগরিক অধিকারের দিক থেকে একটি জরুরি প্রশ্ন।

  • বর্তমানে মুসলিম পরিবারে একজন কন্যা সন্তান একজন পুত্রের অর্ধেক উত্তরাধিকার পায়। হিন্দু পরিবারে কন্যাদের কোনো উত্তরাধিকারই নেই, বিধবা নারীও কখনো কখনো বঞ্চিত হন।
  • বাংলাদেশ নারী আইনজীবী সমিতির একটি রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে ৭ জন কোনো না কোনোভাবে সম্পত্তি বঞ্চনার শিকার হন।

এই বৈষম্য দীর্ঘ মেয়াদে নারীর আর্থিক নিরাপত্তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং আত্মসম্মান ক্ষুণ্ন করে। কমিশনের প্রস্তাব এ বৈষম্য দূর করে সমতাভিত্তিক উত্তরাধিকারের ভিত্তি রাখতে চায়।

কমিশন প্রস্তাব করেছে—বিবাহবিচ্ছেদে নারী-পুরুষ উভয় পক্ষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সন্তানের অভিভাবকত্বে ‘পিতা-প্রধান’ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

  • বর্তমানে নারীরা বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তান পালনের অধিকারের জন্য বিচারব্যবস্থায় গিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার শিকার হন।
  • অনেক নারী, বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে, আইনগত সুবিধা জানেন না বা প্রয়োগ করতে পারেন না।

এই প্রস্তাব নারীর আত্ম নির্ভরশীলতা এবং সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সহায়ক। অভিভাবকত্বে যৌথ সিদ্ধান্তের ধারা আরও মানবিক ও আধুনিক পরিবার কাঠামো গড়তে সহায়তা করবে।

কমিশন সুপারিশ করেছে—যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং প্রত্যেক কর্মস্থলে অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি বাধ্যতামূলক করা।

  • বেসরকারি সংস্থাগুলোতে প্রায় শতকরা ৪৫ ভাগ নারী কর্মী যৌন হয়রানির শিকার হন, অথচ অভিযোগ জানাতে ভয় পান চাকরি হারানোর শঙ্কায়।
  • বিদ্যমান নীতিমালা আছে (২০০৯–এর হাইকোর্ট গাইডলাইন), কিন্তু তা বাস্তবায়নে ঘাটতি প্রবল।

একটি স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে, ভয়ের সংস্কৃতি দূর করতে এবং যোগ্যতাভিত্তিক পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে।

প্রতিবেদনটি মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস এবং পিতৃত্বকালীন ছুটি কমপক্ষে ২১ দিন করার প্রস্তাব করেছে।

  • নারী কর্মীদের অনেকেই মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে গিয়ে চাকরি হারান বা পদোন্নতি বঞ্চিত হন।
  • পিতৃত্বকালীন ছুটির অভাব পারিবারিক দায়িত্বের ভার নারীর কাঁধে একচেটিয়াভাবে চাপিয়ে দেয়।

পিতৃত্বকালীন ছুটি পুরুষদের মধ্যে পরিবারকেন্দ্রিক দায়িত্ববোধ তৈরি করতে সাহায্য করবে এবং নারীর প্রতি প্রচলিত একপক্ষীয় দায়িত্ববোধের চাপ কমাবে।

এই সংস্কার-সুপারিশগুলো শুধু আইনগতই নয়, সামাজিকভাবে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের ইঙ্গিত দেয়। তবে এগুলোর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমাজের প্রস্তুতি এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বোধের সঙ্গে সংলাপ করার সক্ষমতার ওপর।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা প্রকাশের পরপরই যে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা মূলত বাংলাদেশের সামাজিক-ধর্মীয় বাস্তবতা, রাজনৈতিক অবস্থান ও নারীর অধিকারের বিষয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সংস্কার-প্রচেষ্টার স্বরূপ যতটা আইনগত, তার চেয়ে অনেক বেশি সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক।

সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী ও আলেম সমাজ থেকে।

তাঁদের ভাষায়, উত্তরাধিকার ও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সমতার দাবি সরাসরি ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

  • মুসলিম পারিবারিক আইনে কন্যা পুত্রের অর্ধেক পায়, যাকে ইসলামি বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়।
  • কমিশনের প্রস্তাবকে তাঁরা ‘আল্লাহর বিধানে হস্তক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন।
  • হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি সংগঠন জানিয়েছে, ‘আধুনিকতার নামে ধর্মীয় আইনকে খর্ব করার ষড়যন্ত্র’ চলছে।

এখানে যে দ্বন্দ্বটি প্রকট হয়েছে, তা হলো—একদিকে ধর্মীয় বিধান সংরক্ষণ বনাম অপরদিকে নাগরিক অধিকার ও লিঙ্গসমতার দাবি।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ (১)-এ রাষ্ট্র সব নাগরিকের প্রতি সমান আচরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও, ৪১ অনুচ্ছেদে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এই দ্বৈততা আইন ও ধর্মের বিভাজনকে অস্পষ্ট করে তোলে।

সরকারের ভেতরেও এই প্রস্তাব নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত মত উঠে এসেছে।

  • ক্ষমতাসীন দলের কিছু সিনিয়র নেতা ‘ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান’ জানানোর পক্ষে, আবার
  • কিছু প্রগতিশীল নেতা-নেত্রী ‘নাগরিক অধিকারকে’ প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানান।

রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ এই ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক।

  • একটি দল বলেছে, ‘এই কমিশন বিদেশি এনজিও এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার।’
  • আরেকটি দল সংস্কারের পক্ষ নিয়ে বলেছে, ‘সময় এসেছে নারীর প্রকৃত মুক্তির পথে হাঁটার।’

এই বিতর্ক রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে, কারণ এটি কেবল নীতিগত নয়—ভোটব্যাংক, ধর্মীয় মতাবলম্বী জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রত্যাশা, সবকিছুকে ছুঁয়ে গেছে।

সংস্কারের বিরোধিতার একটি বড় অংশ এসেছে সাধারণ জনগণের ভেতরকার সংস্কার-ভীতি থেকেও।

  • অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের পরিবর্তন ‘পশ্চিমা ধারণা’ এবং ‘পারিবারিক কাঠামো ভেঙে ফেলবে।’
  • নারীর অধিকারের প্রসার মানে কি ‘পারিবারিক কর্তৃত্ব ক্ষয়ে যাওয়া?’ এমন আশঙ্কাও দেখা গেছে।

একটি বেসরকারি জরিপ অনুযায়ী (সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র, ২০২৫)—

  • ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ‘নারী অধিকার মানে পরিবারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি।’
  • আবার ৩৯ শতাংশ নারী বলেছেন, ‘ধর্মীয় বিধানের বাইরে নতুন আইন করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।’

এখানে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি দ্বৈত মানসিকতা:

নারীদের ক্ষমতায়ন চাই, কিন্তু সাংস্কৃতিক রীতিনীতির বাইরে নয়। সমতা চাই, কিন্তু ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে বিরোধিতা না করে।

কমিশনের সুপারিশ প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে—

  • ‘নারীরা পুরুষদের সমান উত্তরাধিকার চাইলে ইসলাম ত্যাগ করতে হবে’
  • ‘সন্তানদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে’
  • ‘বিয়েতে পিতার অনুমতি ছাড়াই মেয়েরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে’।

এসব তথ্য বিভ্রান্তিকর হলেও জনমনে প্রভাব ফেলে।

একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মিডিয়া উইং এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ‘ধর্মীয় বিষণ্নতা’র প্রচার শুরু করে। সঠিক ও স্বচ্ছভাবে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা না থাকলে যেকোনো সংস্কারপ্রচেষ্টা বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি করে।

এই বিতর্কের ভেতর দিয়ে আমরা একটি বড় সত্যের মুখোমুখি হই: আইনগত সমতা ও ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বন্দ্বে সমাজ দ্বিধান্বিত। এই দ্বিধা দূর করতে হলে প্রয়োজন—

  • ব্যাখ্যাভিত্তিক, আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসম্প্রদায় সংলাপ,
  • সংসদে গণশুনানির আয়োজন,
  • নারী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সম্মিলিত আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি
  • সর্বোপরি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান, যা একই সঙ্গে জনগণের বিশ্বাস রক্ষা করে এবং নারীর অধিকার নিশ্চিত করে।

এই বিতর্ক থেকে আমরা বুঝতে পারি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিঙ্গ সমতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক রীতির মধ্যে একটি সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।

এ ক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে:

১. ধর্মীয় স্কলার, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনবিদদের মধ্যে সংলাপের আয়োজন,

২. সংসদীয় গণশুনানি ও নীতিমালাভিত্তিক বিতর্কের পথ উন্মুক্ত রাখা,

৩. সঠিক তথ্য প্রচার ও জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান,

৪. সংবিধানের আলোকে নাগরিক অধিকার ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন,

৫. একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপরেখা, যাতে নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন না হয় এবং একইসঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসেও আঘাত না লাগে।

৬. সর্বোপরি একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান, যা একই সঙ্গে জনগণের বিশ্বাস রক্ষা করে এবং নারীর অধিকার নিশ্চিত করে।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী চিন্তার সূচনা। কিন্তু এই চিন্তাকে বাস্তবায়নে অধিকার, ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির পরস্পর বিরোধী চাহিদাগুলোকে বুঝে এগোতে হবে। এ এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা—যেখানে নারীর সমতা শুধু কাগজে নয়, বাস্তবেও প্রতিষ্ঠিত হবে যদি সমাজ সেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকে। আর সেই প্রস্তুতি গড়ে তোলার দায় আমাদের সবার।

লেখক: নারী অধিকার কর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত