Ajker Patrika

সিআরবি মাথা উঁচু করে বাঁচুক

মন্টি বৈষ্ণব
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২১, ২১: ০২
সিআরবি মাথা উঁচু করে বাঁচুক

চট্টগ্রাম নগরীর হাতে গোনা যে কয়েকটি জায়গায় এখনো সবুজের দেখা মেলে তার মধ্যে অন্যতম সিআরবি। সিআরবি মানে হলো সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর এই সিআরবি। টাইগার পাস এলাকার এই সিআরবিতে রয়েছে বহু শতবর্ষী বৃক্ষ। এ ছাড়া এখানে আছে শিরীষতলা নামে অনেক বড় প্রশস্ত মাঠ। যেখানে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন, রবীন্দ্র–নজরুল জয়ন্তীসহ আরও অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

মূল কথা, এই সিআরবি হলো বহু গাছের কেন্দ্রভূমি। চট্টগ্রাম নগরীর ফুসফুস বলা যায় একে। এখানে পাখিদের পাশাপাশি খেলা করে শিশুরা। শত শত মানুষ, মন আর শরীরকে সুস্থ রাখতে সিআরবিতে হাঁটতে যায়। গত কয়েকদিনের পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ফুসফুসে করাত চালানোর তথ্য বেশ আলোচিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের কথা উপেক্ষা করে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে সিআরবিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য কেটে ফেলা হবে ৭০টির বেশি গাছ। এরই মধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও করেছে রেলওয়ে। তারা এই চুক্তি করেছিল ২০২০ সালের ১৮ মার্চে। প্রশ্ন হলো—তাহলে এখন কেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? চুক্তির সময়ও পরিবেশবাদী ও চট্টগ্রামের সচেতন মহল প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সম্প্রতি সিআরবি এলাকায় সাইনবোর্ড টানিয়ে হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। ফলে টিকে থাকা গুটিকয় সবুজ ভূমির একটিতে করাত চালানোর বিষয়টি এখন অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য।

সিআরবির খোলা প্রান্তরে হাসপাতাল তৈরি করা হবে শুনে ক্ষোভে ফুঁসছেন চট্টগ্রামবাসী। শুধু পরিবেশবাদী বা সংস্কৃতিকর্মী নন, রেলকর্মীরাও এর প্রতিবাদ করছেন। কারণ, অনেক পুরোনো জায়গা এই সিআরবি। আর সিআরবিজুড়ে রয়েছে অনেক গাছের মেলা। সেখানে হাঁটলেই মন ভালো হয়ে যায়। প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা এটি। চিরসবুজ সিআরবি থেকে আকাশকেও মাঝেমাঝে মনে হয় সবুজ রঙের। তাই এই খবর শোনার পর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এখানে হাসপাতাল তৈরি হলে শিশুদের খেলা বন্ধ হয়ে যাবে, বড়দের হাঁটার জন্য থাকবে না খোলা মাঠ, অনুষ্ঠিত হবে না কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শোনা যাবে না পাখিদের কলতান। আর বেশ্বিক উষ্ণায়ণ নিয়ে তোলপাড় এই সময়ের ধ্রূপদী প্রশ্নগুলো তো রয়েছেই।

আজকের দুনিয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সারা দুনিয়া বিশ্বেক উষ্ণায়ণ কমানো নিয়ে সোচ্চার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা সংকটের বিষয় সামনে আসছে। আর এই সূত্রেই বনায়নের প্রসঙ্গ যেমন উঠছে, তেমনি উঠছে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি। বাংলাদেশও প্রতিবার পরিবেশ সম্মেলন কিংবা বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই প্রসঙ্গটি জোরের সঙ্গে উত্থাপন করছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা মিলছে এমন বহু প্রকল্পের, যা পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনছে।

হাসপাতাল প্রসঙ্গে বলতে হয়, হাসপাতাল মানে কিন্তু হাসপাতাল। কোনো সিনেমা হল নয়, যেখানে কয়েক ঘণ্টা পরপর দর্শক আসবে, আবার চলে যাবে। মানুষ হাসপাতালে খুব শখের বসে যায় না। অসুস্থ হলে টানা চিকিৎসার জন্য যেতে হয় হাসপাতাল নামক জায়গায়। হাসপাতালে প্রতিদিন আসবে হাজার হাজার রোগী, আর তাঁদের আত্মীয়স্বজন। এদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষকে দিনের পর দিন চিকিৎসার স্বার্থে হাসপাতালে থাকতে হবে। আবার এসব মানুষের জন্য হাসপাতালের আশপাশে থাকবে অনেক ওষুধপত্র, চা আর খাবার দাবারের দোকান। আরও থাকবে অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ি। এতে প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণে পরিবেশের ক্ষতি হবে। 

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে যেমন রাজধানীর ফুসফুস বলা হয়, তেমনি অনেক বেশি গাছ-গাছালির জন্য চট্টগ্রামের সিআরবিকে বলা হয় চট্টগ্রামের ফুসফুস। ফুসফুসের কার্যক্রম বন্ধ হলে মানুষ যেমন মৃত্যুবরণ করে। সিআরবিতে হাসপাতাল হলে ঠিক তেমনি অবস্থা হবে মানুষের। 

সিআরবির শিরীষতলায় প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন, রবীন্দ্র–নজরুল জয়ন্তীসহ আরও অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়আবার অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে, শতবর্ষী বৃক্ষ কাটা পড়বে না। হাসপাতাল হলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। হাসপাতালের গঠন আর কার্যক্রম এ বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাসপাতালে থাকবে অনেক মানুষ। এতগুলো মানুষের বর্জ্য কোথায় যাবে? এতে কি গাছেদের ক্ষতি হবে না বলে মনে করছেন? 

গাছ কাটা আমাদের পুরোনো অভ্যাস। গাছেদের সঙ্গে কিছু কিছু মানুষের এত শত্রুতা কেন বোঝা মুশকিল। কেন আমরা এই শতবর্ষী গাছেদের বাঁচতে দিচ্ছি না? সিআরবিতে হাসপাতাল হলে তো চট্টগ্রামবাসীকে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। প্রকৃতিতে বিনা মূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করে গাছ। আমরা প্রকৃতির অংশ। যে প্রাণ–প্রকৃতি আমাদের বেঁচে থাকার উৎস, সেই প্রকৃতিকে আজ আমরা কেটে ফেলার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।। 

গত দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বে তার আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। প্রতিদিন সামান্য একটু অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে হাজার হাজার মানুষ। এ সময়টাতে সিলিন্ডারের অক্সিজেন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। এত মানুষের মৃত্যুর পরও কি আমরা গাছেদের কথা চিন্তা করব না? 

এরই মধ্যে এই হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদে সোচ্চার আছেন পরিবেশবিদ, সংস্কৃতিকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলের মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। এই হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রেলসচিব, রেলের মহাপরিচালকসহ আটজনকে ডিমান্ড অব জাস্টিস নোটিশ (আইনি নোটিশ) পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ)। প্রশ্ন হলো—সবাই কি তবে হাসপাতাল তৈরির বিপক্ষে?

না, এত সরল সমীকরণ করা চলে না। প্রসঙ্গটি একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, কেন এই প্রশ্ন অবান্তর। হাসপাতাল রোগের চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য। আর জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ে ধুঁকতে থাকা বর্তমান বিশ্ব জানে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থ থাকার জন্য কতটা জরুরি। আমরা আমাদের হাসপাতালের চাহিদাটি মেটাতে গিয়ে সেই সুস্থতার সহযোগীকেই হত্যা করতে যাচ্ছি। সংকটটি এখানেই। আমাদের প্রবণতা সুস্থ থাকা নয়, অসুস্থতার চিকিৎসা। অথচ আজকের দুনিয়ার জনস্বাস্থ্য নীতি বলে, আগে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর জোগান নিশ্চিত করা হোক। চিকিৎসার সুব্যবস্থার প্রসঙ্গটি এর পরের ধাপ। আমরা প্রথম ধাপটির দিকে না তাকিয়ে দ্বিতীয় ধাপের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটা অনেকটা গাছের ডালে বসে গোড়া কাটার মতো বিষয়। চট্টগ্রামের সিআরবির গাছ কাটার ক্ষেত্রে আমরা আক্ষরিক অর্থেই সেদিকে এগোচ্ছি।

তাই যারা প্রতিবাদ করছে, তাদের কেউ হাসপাতাল তৈরির বিপক্ষে নয়। তাদের মূল বক্তব্য, হাসপাতাল অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সেটা সিআরবিতে নয়। চট্টগ্রামে অনেক খালি জমি আছে। একটু খুঁজলে হাসপাতালের জন্য অনেক জায়গা পাওয়া যাবে। সেখানে হাসপাতাল তৈরি করলে কারও কোনো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না। সিআরবি এলাকা তার প্রাণ-প্রকৃতিকে নিয়ে বেঁচে থাকুক। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করে সিআরবি মাথা উঁচু করে বাঁচুক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত