ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। জুলাই আন্দোলন, শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলেছেন ড. কামরুল হাসান মামুন।
মাসুদ রানা
গত বছর আন্দোলনের সময় আপনিসহ অনেক শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে। এক বছর পর গণ-অভ্যুত্থান কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমার আশাটা উল্টো পথে চলে গেছে। আমার আশা তো মেটেনি, বরং অনেক কিছুই নেতিবাচক, যা আমাকে মারাত্মকভাবে কষ্ট দেয়। জুলাই আন্দোলন যে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হয়েছিল, তার কোনো কিছুই আর প্রাপ্তির খাতায় নেই। আমি আশা করেছিলাম শিক্ষা খাত একটা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। যেহেতু এই আন্দোলনের মূল ইঞ্জিন ছিল ছাত্র ও শিক্ষকেরা। সঙ্গে জনগণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষও ছিলেন। এই অভ্যুত্থান সফল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমত শিক্ষার্থীদের বড় ভূমিকা ছিল। শিক্ষকদেরও ভূমিকা ছিল। সেই জায়গা থেকে আমি আশা করেছিলাম, শিক্ষায় একটা বিপ্লব আসবে। কারণ, আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও শিক্ষার ইস্যু নিয়েই শুরু হয়েছিল। আমরা একটা সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। সেই সুযোগ হয়তো ১০, ২০, ৩০ বা ৫০ বছরে না-ও আসতে পারে। অনেকগুলো ছাত্র-জনতার মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ববরণের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার আশা করেছিলাম, সেটা কীভাবে বিপথে চলে গেল—এটা যতবার ভাবি, ততবার সেটা নিয়ে আমার কষ্ট হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের সুযোগগুলো কেন হারিয়ে গেল?
আন্দোলনের সময় সবার চাওয়া-পাওয়াগুলোতে একটা ঐকমত্য ছিল। আন্দোলনের পরপরই সবাই তাদের ব্যক্তিগত, দলীয় স্বার্থ এবং নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠল। আবার অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি ভুল শুরুতেই করেছে। এর মধ্যে দুটি ভুল মারাত্মক ছিল। এক. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করেননি। তিনি শিক্ষার্থী নেতৃত্বদের বলতে পারতেন, ‘এ দেশের জনগণ তোমাদের আজীবন স্মরণ রাখবে। তোমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমাদের এখন নিজ কাজে ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। তোমরা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছ। এখন আমাদের কাজটা করতে দাও।’ এসব না করে তিনি বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বসিয়েছ। তোমরা এই আন্দোলনকে সফল পরিণতি দিয়েছ। তোমরাই এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড।’ এভাবে তিনি তাদের পিঠ চাপড়ে দিলেন। এই যে তিনি তাদের আকাশে ওঠালেন, এটাই ছিল ভুল। কারণ, তারা হঠাৎ করেই সেলিব্রিটি হয়ে গেল। হঠাৎ করে কেউ যখন বড় সেলিব্রিটি হয়ে যায়, তখন সেটা কেউ কেউ ধারণ করতে পারে না। সবকিছুকে ধারণ করার জন্য পাত্র লাগে। ক্ষমতা, সুনাম পাওয়ার জন্য জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নামক একটা পাত্র লাগে। জ্ঞান, অভিজ্ঞতার পাত্রটা যদি বড় না হয়, তাহলে সেটা উপচে পড়ে। সেই উপচে পড়ার ব্যাপারটি এখন চারদিকে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের জন্য যদি প্রধান উপদেষ্টা সেই সময় বলতেন, ‘তোমরা নিজেদের প্রস্তুত করো। কিছুদিন পরই তোমাদেরকে এ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে, তার জন্য তোমরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করো। নেতৃত্বের গুণাগুণ অর্জন করো।’ কিন্তু তিনি সেটা করলেন না।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?
মোটেও না। এই সরকারের ভাবমূর্তি মানুষের কাছে অনেক বেড়ে যেত যদি এই বাজেটে শিক্ষায় জিডিপির ৫ এবং স্বাস্থ্য খাতে ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিত। সারা দেশের মানুষ অবশ্যই সাধুবাদ জানাত। গণ-অভ্যুত্থানের পরে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে। এ দেশের প্রত্যেক অভিভাবকের একমাত্র স্বপ্ন হলো তাঁর সন্তানের শিক্ষা। যেখানে গত সরকারের শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৬৯ শতাংশ আর এ সরকার দিল ১.৭১ শতাংশ। তাহলে শিক্ষায় কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? তারা তো ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারেনি। ইমপ্যাক্ট তখনই তৈরি হতো যদি সরকার শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন করত। তারা যে সুযোগ হাতছাড়া করল, এটা হলো অপূরণীয় ক্ষতি।
পৃথিবীতে যত দেশ উন্নত হয়েছে, তারা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। আগে শিক্ষায় উন্নত হতে হয়, এটার কারণে উন্নত মানুষ তৈরি হয়, এরপর উন্নত মনের মানুষেরা দেশের উন্নতি করে। বিগত সরকার শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে। আর অনুন্নত মানুষকে টাকা বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিল। ফলে চুরি, বাটপারি, অপচয়গুলো হয়েছে। মানুষ তৈরি না করে যদি উন্নয়নের দিকে যাই, তাহলে হবে অপচয়।
চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ২০ বছর আগেও ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই, যারা ক্ষমতা ও অর্থনীতিতে উন্নতি করেছে শিক্ষা ছাড়া।
অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন না করার কী কারণ থাকতে পারে?
না করার কারণ হলো, অন্য অনেক কিছু করলে পরে সেটার ইফেক্ট দ্রুত পাওয়া যায়। শিক্ষাটা বড় জিনিস। এর সুফল আসে দেরিতে। শিক্ষাতে কোনো সরকারই বেশি বাজেট দিতে চায় না। নির্বাচিত সরকারও তা করে না। কারণ, তারা মনে করে বরাদ্দ যদি বেশি দেওয়া হয়, তাহলে সেটা শেষ করতে আরেক সরকার চলে আসবে। সুতরাং তাদের বরাদ্দ করা খাত থেকে অন্য সরকার সুফল পাবে—এটা কোনো সরকার মানতে পারে না। কিন্তু সুফলটা যে দেশ ও জনগণ পাবে, এটা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। এই সরকারও তা-ই মনে করছে।
কিন্তু তাদের বোঝা উচিত ছিল, তাদের অনেক দায় আছে। কারণ, এ ধরনের কাজ নির্বাচিত সরকারগুলো করতে চাইবে না। এটা একটা বিশাল সুযোগ ছিল। আমার মতে, যতগুলো সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ছিল শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন তারা করল না। এটা অমার্জনীয়।
এক বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এখনকার ছাত্ররাজনীতির লক্ষণটা বোঝা যায় শিক্ষকরাজনীতির লক্ষণ দেখে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলে এবং একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারা যায়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির সরকারি ছাত্রসংগঠনের ভাব নিয়ে চলে। আপাতত তাদের আচরণের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সরকারি দল মনে করে।
যদিও আগের মতো হলগুলোতে টর্চার সেল নেই এবং জোর করে মিছিলে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ, তাদের মূল পার্টি এখনো ক্ষমতায় নেই। পুলিশ ও সরকারের সমর্থন না থাকার কারণে আপাতত আবাসিক হলগুলো ঠিক আছে।
আমার আশঙ্কা, একটা নির্বাচন হওয়ার পরেই আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাব। অন্যদিকে, শিক্ষকরাজনীতিতে নীল দল নেই। আগে নীল দল যা করত এখন সাদা দল তা করছে। যেমন কয়েক দিন আগে পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম আমি সিনেট মেম্বার হয়েছি। কয়েকজন শুভেচ্ছা জানানোর সূত্রে সেটা জানতে পারলাম। যদিও এখন পর্যন্ত আমি কোনো চিঠি পাইনি। শুনেছি, এটা শোনার পরেই সাদা দলের নেতারা উপাচার্যের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফা নিত্রা কীভাবে সিনেট মেম্বার হন?
সিনেট মেম্বার একটা ছোটখাটো পদ মাত্র। এটাও তাঁরা সহ্য করতে পারছেন না। সাদা দলের বাইরে কেউ এ পদ পাবে—এটা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা যখন পূর্ণ মাত্রায় ক্ষমতায় আসবে, তখন কী হবে? এ কারণে আশঙ্কা করি, এ দেশে আসলে সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে না। ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতির মধ্যেও কোনো পরিবর্তন আসবে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটি বলে আপনি মনে করেন?
এটা একটা দার্শনিক ব্যাপার। এটার জন্য খুব দরকার একটা শিক্ষা কমিশন। শিক্ষা কমিশনের কাজটা হলো, গোটা রাষ্ট্রকে একটা বড় পর্দায় প্রজেকশন দিয়ে সব মাধ্যমের শিক্ষা নিয়ে একটা দর্শন তৈরি করা। দুঃখজনক হলো, বিভিন্ন ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো ধরনের ক্রসিং নেই। যারা মাদ্রাসায় পড়ে আর যারা সাধারণ শিক্ষা এবং ইংলিশ ভার্সন ও মিডিয়ামে পড়ে, তাদের সঙ্গে কারও কোথাও দেখা হয় না।
এ জন্যই একটা শিক্ষা কমিশন দরকার। ইউরোপ, আমেরিকায় তো নানান ধারা আছে। সেখানে কারিগরি ধারা অনেক শক্তিশালী। একটা দেশের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী হতে হবে কারিগরি ধারার। মূল ধারা হতে হবে অনেক শক্তিশালী, কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং।
আমার মতে, দক্ষিণ কোরিয়া বা চীন থেকে ভালো মানের শিক্ষক এনে এখানকার কারিগরি ও ডিপ্লোমা স্কুল-কলেজে নিয়োগ দিতে হবে। এরপর এখান থেকেই স্কিলসম্পন্ন শিক্ষার্থী বের হবে। এই স্কিলসম্পন্ন মানুষেরা বিদেশে গেলে ভালো মানের বেতন পাবে এবং তাতে দেশের রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। আমরা যদি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই মানের শিক্ষক নিয়োগ দিই, তাহলে সেখানে উন্নতি সম্ভব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
গত বছর আন্দোলনের সময় আপনিসহ অনেক শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে। এক বছর পর গণ-অভ্যুত্থান কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমার আশাটা উল্টো পথে চলে গেছে। আমার আশা তো মেটেনি, বরং অনেক কিছুই নেতিবাচক, যা আমাকে মারাত্মকভাবে কষ্ট দেয়। জুলাই আন্দোলন যে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হয়েছিল, তার কোনো কিছুই আর প্রাপ্তির খাতায় নেই। আমি আশা করেছিলাম শিক্ষা খাত একটা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। যেহেতু এই আন্দোলনের মূল ইঞ্জিন ছিল ছাত্র ও শিক্ষকেরা। সঙ্গে জনগণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষও ছিলেন। এই অভ্যুত্থান সফল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমত শিক্ষার্থীদের বড় ভূমিকা ছিল। শিক্ষকদেরও ভূমিকা ছিল। সেই জায়গা থেকে আমি আশা করেছিলাম, শিক্ষায় একটা বিপ্লব আসবে। কারণ, আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও শিক্ষার ইস্যু নিয়েই শুরু হয়েছিল। আমরা একটা সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। সেই সুযোগ হয়তো ১০, ২০, ৩০ বা ৫০ বছরে না-ও আসতে পারে। অনেকগুলো ছাত্র-জনতার মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ববরণের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার আশা করেছিলাম, সেটা কীভাবে বিপথে চলে গেল—এটা যতবার ভাবি, ততবার সেটা নিয়ে আমার কষ্ট হয়।
গণ-অভ্যুত্থানের সুযোগগুলো কেন হারিয়ে গেল?
আন্দোলনের সময় সবার চাওয়া-পাওয়াগুলোতে একটা ঐকমত্য ছিল। আন্দোলনের পরপরই সবাই তাদের ব্যক্তিগত, দলীয় স্বার্থ এবং নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠল। আবার অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি ভুল শুরুতেই করেছে। এর মধ্যে দুটি ভুল মারাত্মক ছিল। এক. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করেননি। তিনি শিক্ষার্থী নেতৃত্বদের বলতে পারতেন, ‘এ দেশের জনগণ তোমাদের আজীবন স্মরণ রাখবে। তোমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমাদের এখন নিজ কাজে ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। তোমরা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছ। এখন আমাদের কাজটা করতে দাও।’ এসব না করে তিনি বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বসিয়েছ। তোমরা এই আন্দোলনকে সফল পরিণতি দিয়েছ। তোমরাই এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড।’ এভাবে তিনি তাদের পিঠ চাপড়ে দিলেন। এই যে তিনি তাদের আকাশে ওঠালেন, এটাই ছিল ভুল। কারণ, তারা হঠাৎ করেই সেলিব্রিটি হয়ে গেল। হঠাৎ করে কেউ যখন বড় সেলিব্রিটি হয়ে যায়, তখন সেটা কেউ কেউ ধারণ করতে পারে না। সবকিছুকে ধারণ করার জন্য পাত্র লাগে। ক্ষমতা, সুনাম পাওয়ার জন্য জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নামক একটা পাত্র লাগে। জ্ঞান, অভিজ্ঞতার পাত্রটা যদি বড় না হয়, তাহলে সেটা উপচে পড়ে। সেই উপচে পড়ার ব্যাপারটি এখন চারদিকে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের জন্য যদি প্রধান উপদেষ্টা সেই সময় বলতেন, ‘তোমরা নিজেদের প্রস্তুত করো। কিছুদিন পরই তোমাদেরকে এ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে, তার জন্য তোমরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করো। নেতৃত্বের গুণাগুণ অর্জন করো।’ কিন্তু তিনি সেটা করলেন না।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?
মোটেও না। এই সরকারের ভাবমূর্তি মানুষের কাছে অনেক বেড়ে যেত যদি এই বাজেটে শিক্ষায় জিডিপির ৫ এবং স্বাস্থ্য খাতে ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিত। সারা দেশের মানুষ অবশ্যই সাধুবাদ জানাত। গণ-অভ্যুত্থানের পরে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে। এ দেশের প্রত্যেক অভিভাবকের একমাত্র স্বপ্ন হলো তাঁর সন্তানের শিক্ষা। যেখানে গত সরকারের শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.৬৯ শতাংশ আর এ সরকার দিল ১.৭১ শতাংশ। তাহলে শিক্ষায় কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? তারা তো ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারেনি। ইমপ্যাক্ট তখনই তৈরি হতো যদি সরকার শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন করত। তারা যে সুযোগ হাতছাড়া করল, এটা হলো অপূরণীয় ক্ষতি।
পৃথিবীতে যত দেশ উন্নত হয়েছে, তারা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। আগে শিক্ষায় উন্নত হতে হয়, এটার কারণে উন্নত মানুষ তৈরি হয়, এরপর উন্নত মনের মানুষেরা দেশের উন্নতি করে। বিগত সরকার শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে। আর অনুন্নত মানুষকে টাকা বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিল। ফলে চুরি, বাটপারি, অপচয়গুলো হয়েছে। মানুষ তৈরি না করে যদি উন্নয়নের দিকে যাই, তাহলে হবে অপচয়।
চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ২০ বছর আগেও ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই, যারা ক্ষমতা ও অর্থনীতিতে উন্নতি করেছে শিক্ষা ছাড়া।
অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করলেও শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন না করার কী কারণ থাকতে পারে?
না করার কারণ হলো, অন্য অনেক কিছু করলে পরে সেটার ইফেক্ট দ্রুত পাওয়া যায়। শিক্ষাটা বড় জিনিস। এর সুফল আসে দেরিতে। শিক্ষাতে কোনো সরকারই বেশি বাজেট দিতে চায় না। নির্বাচিত সরকারও তা করে না। কারণ, তারা মনে করে বরাদ্দ যদি বেশি দেওয়া হয়, তাহলে সেটা শেষ করতে আরেক সরকার চলে আসবে। সুতরাং তাদের বরাদ্দ করা খাত থেকে অন্য সরকার সুফল পাবে—এটা কোনো সরকার মানতে পারে না। কিন্তু সুফলটা যে দেশ ও জনগণ পাবে, এটা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। এই সরকারও তা-ই মনে করছে।
কিন্তু তাদের বোঝা উচিত ছিল, তাদের অনেক দায় আছে। কারণ, এ ধরনের কাজ নির্বাচিত সরকারগুলো করতে চাইবে না। এটা একটা বিশাল সুযোগ ছিল। আমার মতে, যতগুলো সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ছিল শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন তারা করল না। এটা অমার্জনীয়।
এক বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এখনকার ছাত্ররাজনীতির লক্ষণটা বোঝা যায় শিক্ষকরাজনীতির লক্ষণ দেখে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলে এবং একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারা যায়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির সরকারি ছাত্রসংগঠনের ভাব নিয়ে চলে। আপাতত তাদের আচরণের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সরকারি দল মনে করে।
যদিও আগের মতো হলগুলোতে টর্চার সেল নেই এবং জোর করে মিছিলে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ, তাদের মূল পার্টি এখনো ক্ষমতায় নেই। পুলিশ ও সরকারের সমর্থন না থাকার কারণে আপাতত আবাসিক হলগুলো ঠিক আছে।
আমার আশঙ্কা, একটা নির্বাচন হওয়ার পরেই আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাব। অন্যদিকে, শিক্ষকরাজনীতিতে নীল দল নেই। আগে নীল দল যা করত এখন সাদা দল তা করছে। যেমন কয়েক দিন আগে পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম আমি সিনেট মেম্বার হয়েছি। কয়েকজন শুভেচ্ছা জানানোর সূত্রে সেটা জানতে পারলাম। যদিও এখন পর্যন্ত আমি কোনো চিঠি পাইনি। শুনেছি, এটা শোনার পরেই সাদা দলের নেতারা উপাচার্যের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফা নিত্রা কীভাবে সিনেট মেম্বার হন?
সিনেট মেম্বার একটা ছোটখাটো পদ মাত্র। এটাও তাঁরা সহ্য করতে পারছেন না। সাদা দলের বাইরে কেউ এ পদ পাবে—এটা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা যখন পূর্ণ মাত্রায় ক্ষমতায় আসবে, তখন কী হবে? এ কারণে আশঙ্কা করি, এ দেশে আসলে সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে না। ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতির মধ্যেও কোনো পরিবর্তন আসবে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনটি বলে আপনি মনে করেন?
এটা একটা দার্শনিক ব্যাপার। এটার জন্য খুব দরকার একটা শিক্ষা কমিশন। শিক্ষা কমিশনের কাজটা হলো, গোটা রাষ্ট্রকে একটা বড় পর্দায় প্রজেকশন দিয়ে সব মাধ্যমের শিক্ষা নিয়ে একটা দর্শন তৈরি করা। দুঃখজনক হলো, বিভিন্ন ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো ধরনের ক্রসিং নেই। যারা মাদ্রাসায় পড়ে আর যারা সাধারণ শিক্ষা এবং ইংলিশ ভার্সন ও মিডিয়ামে পড়ে, তাদের সঙ্গে কারও কোথাও দেখা হয় না।
এ জন্যই একটা শিক্ষা কমিশন দরকার। ইউরোপ, আমেরিকায় তো নানান ধারা আছে। সেখানে কারিগরি ধারা অনেক শক্তিশালী। একটা দেশের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী হতে হবে কারিগরি ধারার। মূল ধারা হতে হবে অনেক শক্তিশালী, কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং।
আমার মতে, দক্ষিণ কোরিয়া বা চীন থেকে ভালো মানের শিক্ষক এনে এখানকার কারিগরি ও ডিপ্লোমা স্কুল-কলেজে নিয়োগ দিতে হবে। এরপর এখান থেকেই স্কিলসম্পন্ন শিক্ষার্থী বের হবে। এই স্কিলসম্পন্ন মানুষেরা বিদেশে গেলে ভালো মানের বেতন পাবে এবং তাতে দেশের রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। আমরা যদি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই মানের শিক্ষক নিয়োগ দিই, তাহলে সেখানে উন্নতি সম্ভব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
মানুষের জীবনে আতঙ্ক বা ভয় একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। পারিপার্শ্বিকতার কারণে ছোটবেলা থেকেই ভূত-প্রেত, দেও-দৈত্য, রাক্ষস-খোক্কস প্রভৃতি শব্দ ও কল্পিত ভয়ংকর রূপ বা চেহারা অন্তরে গেঁথে যায় এবং সেখান থেকেই আতঙ্কের যাত্রা হয়েছে শুরু। একটু উনিশ-বিশ হলেই ভয় লাগে, বুক ধড়ফড় করে ওঠে।
৩ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় গত শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছে। পুরো বিশ্বের নজর ছিল সেদিকে। সাধারণত যেটা হয়, দুই দেশের নেতারা যখন মুখোমুখি হন, তখন বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বসেন হিসাবনিকাশে।
৪ ঘণ্টা আগেপ্রায় সময়ই খবর হয়, যানজটের কারণে রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারে না অ্যাম্বুলেন্স এবং পথেই রোগীর মৃত্যু। ২০১৮ সালে সড়ক আন্দোলনের সময়টায় যখন দ্রুত ও সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আন্দোলনকারীরা আলাদা লেন করে দিল...
৪ ঘণ্টা আগেঅনেকেরই সংশয় ছিল। কারও কিছুটা হালকা, কারও আবার গভীর। কেউ কেউ শঙ্কিতও ছিলেন। দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা নিয়ে। এদের সবার সেই সব সংশয় ও শঙ্কা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ফলে দেশের শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তরকামী সাধারণ মানুষের জন্য তা হয়ে উঠেছে অশনিসংকেত। হ্যাঁ, এই কথাগুলো হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয়
১ দিন আগে