সরকারে অন্তর্ভুক্ত সমন্বয়কেরাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক যাঁরা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতিমধ্যেই স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই শিবিরের ক্যাডার। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ নিয়ে এসেছে, কারণ তাঁরা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধকে’ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর মনে হচ্ছে।
ড. মইনুল ইসলাম
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা হলেও স্বৈরশাসক হাসিনা কিংবা আন্দোলনকারীরা তা আন্দাজ করতে পারেননি। জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিল স্বৈরশাসক হাসিনাকে উৎখাতের স্বর্ণসুযোগ বিবেচনা করে। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই ছাত্র-ছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি ১৬ জুলাইয়ে আন্দোলনে ঘৃতাহুতির ভূমিকা পালন করেছিল। আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি তখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারা দেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে।
অন্যদিকে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংগঠিতভাবে অবস্থানকারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা সারা দেশের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় প্রচণ্ড ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাস চালায়। ঢাকার টেলিভিশন ভবন ভাঙচুর, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর রগ কাটা, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা, দুটি মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংস, সেতু মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাক পোড়ানো, রেললাইন উপড়ানো, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর ওই পরিকল্পিত সন্ত্রাসের উদাহরণ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কারফিউ বলবৎ করার জন্য সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। জুলাইয়ের ৩১ তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে স্বৈরাচারী সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষিত হয়। কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর ২ আগস্ট রাতে ঢাকায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সিনিয়র সামরিক অফিসারদের অত্যন্ত জরুরি একটি পরামর্শ সভা ডাকেন এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন।
সেনাপ্রধান আহূত ওই সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন যে কারফিউ বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকলেও সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাঁদের মতামত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ামাত্রই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা সরকার পতনের উদ্দেশ্যে তাঁদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করে দেন। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন হাসিনা। আবারও ওই দিন শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাস চালায় আন্দোলনকারীর ছদ্মবেশে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। এই ৪০০ থানা পোড়ানোতে গানপাউডার ব্যবহারের আলামত মিলেছে। পুলিশকে এ ধরনের ঢালাও আক্রমণ এবং সর্বোপরি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যরা সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যান। অতএব, পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ বাহিনী পালিয়ে যাওয়ায় এবং সামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে গুলি না চালানোর অবস্থানে চলে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ বুঝে নিতে সক্ষম হয় যে হাসিনার পতন শুধুই সময়ের ব্যাপার। ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত হাসিনা সেনাপ্রধানকে হুমকি-ধমকি দিয়ে গুলি চালাতে রাজি করাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সেনাপ্রধান ছিলেন অনড়। বরং, তিনি হাসিনাকে দেশত্যাগে রাজি করানোর জন্য হাসিনার পুত্র জয়কে অনুরোধ জানান। ইতিমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন উপকণ্ঠ থেকে প্রায় সব রাজপথ ধরে লাখ লাখ মানুষের মিছিল ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত গণভবন, সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয় যে এসব মিছিল গণভবনে পৌঁছাতে বড়জোর ৪৫ মিনিট লাগবে। হাসিনা নিজেই টেলিভিশনে লাখ লাখ মানুষের মিছিল দেখতে পারছিলেন, তাই জয়ের কথামতো হাসিনা পদত্যাগ করতে সম্মত হন। হাসিনা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করার কথা বললেও অবস্থাদৃষ্টে তিনি তা না করেই বিমানবাহিনীর একটি বিমানে চড়ে প্রাণভয়ে ভারতে পাড়ি জমান। বেলা ২টার দিকে হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমা অতিক্রম করার পর জেনারেল ওয়াকার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে হাসিনা পদত্যাগ করেছেন মর্মে জানান দেন। ওপরে স্বৈরশাসক হাসিনা সরকার উৎখাতের যে বর্ণনা প্রদত্ত হলো, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সেনাবাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়াতেই হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া প্রাণ বাঁচানোর গত্যন্তর ছিল না। ঢাকায় জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষ গণভবনে হাসিনাকে ধরতে পারলে যে তাঁকে টুকরা টুকরা করে ফেলত, সেটা আন্দাজ করাই যায়!
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল—স্বৈরশাসক হাসিনাকে উৎখাত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে সেটা মোটেও বিবেচ্য ছিল না। হাসিনাকে উৎখাত করলে কে ক্ষমতায় আসবে, সেটা ওই মুহূর্তে জনগণের মোটেও বিবেচ্য ছিল না। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার, যাদের সবাই আন্দোলনের সময় তাদের পরিচয় সযতনে লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিল। এক খবরে বলা হচ্ছে, ১৫২ জন সমন্বয়কের মধ্যে ১০৮ জনই ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার। এখন বলা হচ্ছে, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। এটা একেবারেই ভুয়া দাবি, লাখ লাখ মানুষের মিছিলগুলো সংগঠিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না ওই দিন, যদিও ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসে অতি আগ্রহ পরবর্তী সময়ে তাদের পরিচয়কে নগ্নভাবে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছিল। এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সরকারে অন্তর্ভুক্ত সমন্বয়কেরাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক যাঁরা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতিমধ্যেই স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই শিবিরের ক্যাডার। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ নিয়ে এসেছে, কারণ তাঁরা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধকে’ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর মনে হচ্ছে। এই ব্যাপারটি সিংহভাগ সাধারণ জনগণের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার ব্যাপারে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের অবস্থান ছিল ন্যক্কারজনক, তারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ভুল অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র সংঘের নব্য সংস্করণ ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের এই গণহত্যা কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। বরং, ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য ভারত ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করে টেলিভিশনে উচ্চকণ্ঠে গলাবাজি করেছেন। তাঁরা যদি মনে করেন যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ন্ত্রণকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সরাসরি মদদপুষ্ট হয়ে তাঁরা এভাবে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারবেন, তাহলে বলব তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাঁদের অনেকের জামায়াত-শিবির তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না। ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু ভবন ধূলিসাৎ করার পর দেশে তাদের জনপ্রিয়তা হয়তো এখন শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে! অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে ড. ইউনূস এবং উপদেষ্টাদেরও জনরোষের মোকাবিলা করতে হবে। জনগণের বুঝতে বাকি নেই যে তাদের অজান্তে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-শিবিরের হাতে চলে গেছে। আমার বিশ্বাস, সুযোগ পেলে আরেকটা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে দেশকে জামায়াত-শিবিরের মতো চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য জনগণের মানসিক প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা হলেও স্বৈরশাসক হাসিনা কিংবা আন্দোলনকারীরা তা আন্দাজ করতে পারেননি। জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিল স্বৈরশাসক হাসিনাকে উৎখাতের স্বর্ণসুযোগ বিবেচনা করে। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই ছাত্র-ছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি ১৬ জুলাইয়ে আন্দোলনে ঘৃতাহুতির ভূমিকা পালন করেছিল। আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি তখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারা দেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে।
অন্যদিকে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংগঠিতভাবে অবস্থানকারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা সারা দেশের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় প্রচণ্ড ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাস চালায়। ঢাকার টেলিভিশন ভবন ভাঙচুর, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর রগ কাটা, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা, দুটি মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংস, সেতু মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাক পোড়ানো, রেললাইন উপড়ানো, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর ওই পরিকল্পিত সন্ত্রাসের উদাহরণ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কারফিউ বলবৎ করার জন্য সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। জুলাইয়ের ৩১ তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে স্বৈরাচারী সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষিত হয়। কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর ২ আগস্ট রাতে ঢাকায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সিনিয়র সামরিক অফিসারদের অত্যন্ত জরুরি একটি পরামর্শ সভা ডাকেন এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন।
সেনাপ্রধান আহূত ওই সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন যে কারফিউ বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকলেও সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাঁদের মতামত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ামাত্রই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা সরকার পতনের উদ্দেশ্যে তাঁদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করে দেন। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন হাসিনা। আবারও ওই দিন শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাস চালায় আন্দোলনকারীর ছদ্মবেশে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। এই ৪০০ থানা পোড়ানোতে গানপাউডার ব্যবহারের আলামত মিলেছে। পুলিশকে এ ধরনের ঢালাও আক্রমণ এবং সর্বোপরি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যরা সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যান। অতএব, পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ বাহিনী পালিয়ে যাওয়ায় এবং সামরিক বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে গুলি না চালানোর অবস্থানে চলে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ বুঝে নিতে সক্ষম হয় যে হাসিনার পতন শুধুই সময়ের ব্যাপার। ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত হাসিনা সেনাপ্রধানকে হুমকি-ধমকি দিয়ে গুলি চালাতে রাজি করাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সেনাপ্রধান ছিলেন অনড়। বরং, তিনি হাসিনাকে দেশত্যাগে রাজি করানোর জন্য হাসিনার পুত্র জয়কে অনুরোধ জানান। ইতিমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন উপকণ্ঠ থেকে প্রায় সব রাজপথ ধরে লাখ লাখ মানুষের মিছিল ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত গণভবন, সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয় যে এসব মিছিল গণভবনে পৌঁছাতে বড়জোর ৪৫ মিনিট লাগবে। হাসিনা নিজেই টেলিভিশনে লাখ লাখ মানুষের মিছিল দেখতে পারছিলেন, তাই জয়ের কথামতো হাসিনা পদত্যাগ করতে সম্মত হন। হাসিনা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করার কথা বললেও অবস্থাদৃষ্টে তিনি তা না করেই বিমানবাহিনীর একটি বিমানে চড়ে প্রাণভয়ে ভারতে পাড়ি জমান। বেলা ২টার দিকে হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমা অতিক্রম করার পর জেনারেল ওয়াকার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে হাসিনা পদত্যাগ করেছেন মর্মে জানান দেন। ওপরে স্বৈরশাসক হাসিনা সরকার উৎখাতের যে বর্ণনা প্রদত্ত হলো, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সেনাবাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়াতেই হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ছাড়া প্রাণ বাঁচানোর গত্যন্তর ছিল না। ঢাকায় জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষ গণভবনে হাসিনাকে ধরতে পারলে যে তাঁকে টুকরা টুকরা করে ফেলত, সেটা আন্দাজ করাই যায়!
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল—স্বৈরশাসক হাসিনাকে উৎখাত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে সেটা মোটেও বিবেচ্য ছিল না। হাসিনাকে উৎখাত করলে কে ক্ষমতায় আসবে, সেটা ওই মুহূর্তে জনগণের মোটেও বিবেচ্য ছিল না। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার, যাদের সবাই আন্দোলনের সময় তাদের পরিচয় সযতনে লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিল। এক খবরে বলা হচ্ছে, ১৫২ জন সমন্বয়কের মধ্যে ১০৮ জনই ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার। এখন বলা হচ্ছে, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। এটা একেবারেই ভুয়া দাবি, লাখ লাখ মানুষের মিছিলগুলো সংগঠিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না ওই দিন, যদিও ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসে অতি আগ্রহ পরবর্তী সময়ে তাদের পরিচয়কে নগ্নভাবে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছিল। এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সরকারে অন্তর্ভুক্ত সমন্বয়কেরাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক যাঁরা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতিমধ্যেই স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই শিবিরের ক্যাডার। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ নিয়ে এসেছে, কারণ তাঁরা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধকে’ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর মনে হচ্ছে। এই ব্যাপারটি সিংহভাগ সাধারণ জনগণের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার ব্যাপারে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের অবস্থান ছিল ন্যক্কারজনক, তারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ভুল অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও জামায়াতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র সংঘের নব্য সংস্করণ ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের এই গণহত্যা কর্মকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। বরং, ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য ভারত ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করে টেলিভিশনে উচ্চকণ্ঠে গলাবাজি করেছেন। তাঁরা যদি মনে করেন যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ন্ত্রণকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সরাসরি মদদপুষ্ট হয়ে তাঁরা এভাবে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারবেন, তাহলে বলব তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাঁদের অনেকের জামায়াত-শিবির তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না। ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু ভবন ধূলিসাৎ করার পর দেশে তাদের জনপ্রিয়তা হয়তো এখন শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে! অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে ড. ইউনূস এবং উপদেষ্টাদেরও জনরোষের মোকাবিলা করতে হবে। জনগণের বুঝতে বাকি নেই যে তাদের অজান্তে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-শিবিরের হাতে চলে গেছে। আমার বিশ্বাস, সুযোগ পেলে আরেকটা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে দেশকে জামায়াত-শিবিরের মতো চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য জনগণের মানসিক প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এমনিতেই ফেব্রুয়ারি এলে রাজপথগুলো আগুনরাঙা হয়ে ওঠে। বাতাসে গনগনে ফুলকি ছড়াতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারি এ দেশের প্রতিটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় ১৯৫২ সালে তার রচিত পথের কথা।
১৫ ঘণ্টা আগেতথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ বা পিআইবিতে তারুণ্যের উৎসবে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তিনির্ভর ছাত্ররাজনীতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। ছাত্রদের দেশের কল্যাণে ইতিবাচক রাজনীতি করতে...
১৫ ঘণ্টা আগেএকুশ মানে মাথা নত না করা—শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের বলা এই বাক্যটি এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে আর কবে দেখা দিয়েছে? নানা লোকের নানা মতবাদে দেশের ভাবনার ভারসাম্য যখন বিপদের সম্মুখীন, তখন একুশ আমাদের কোন অনুপ্রেরণা দেয়, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্বও এ সময়কার মানুষদের ওপর বর্তায়।
২ দিন আগেবাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির ট্র্যাজিক ঘটনায় শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহসহ অনেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও মিলিটারির নির্মম গুলিবর্ষণ ও ট্রাকের চাপায় তাঁরা শহীদ হন। আহত হয়েছিলেন অগণিত নর-নারী। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত
২ দিন আগে