Ajker Patrika

সময় এসেছে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়ার

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৫, ১৫: ০৮
সবার আগে দরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সবার সচেতনতা সৃষ্টি। ছবি: সংগৃহীত
সবার আগে দরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সবার সচেতনতা সৃষ্টি। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বটা যখন ইলেকট্রনিক যুগের, তখন তাকে বাদ দিয়ে আধুনিক জীবনের কথা ভাবাই যায় না। ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কোন ইলেকট্রনিক জিনিসটা না হলে আমাদের চলে? কোন ঘরে এখন টেলিভিশন চলে না? কে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না? অধিকাংশ বাড়িতেই এখন রেফ্রিজারেটর শোভা পাচ্ছে, অনেক বাড়িতেই রয়েছে এয়ারকন্ডিশনার। ল্যাপটপ আর কম্পিউটার এখন অধিকাংশ শিক্ষিত শ্রেণির জীবনসঙ্গী। রড তৈরির জন্য ভাঙতে হচ্ছে পুরোনো জাহাজ, পুরোনো জাহাজের মালামালে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রকম বর্জ্যের। কয়েক দশক ধরে এ সবকিছুর সঙ্গেই চলছে আমাদের আধুনিক জীবনযাপন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এসব ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এসব সামগ্রীর একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল বা সচল থাকার মেয়াদ থাকে। অকেজো সোলার প্যানেল ও ইলেকট্রিক গাড়িও এখন ই-বর্জ্য। সাধারণত এগুলো স্বল্পায়ু, তাই মেয়াদ শেষ হলে বা ব্যবহারের অযোগ্য হলে সেসব সামগ্রী ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলতে হয়। ভাগাড়ে ফেলা এসব সামগ্রীর বর্জ্যই ই-বর্জ্য বা ইলেকট্রনিক-বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের মধ্যে মোবাইল বা সেলফোনের ই-বর্জ্য বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে জাহাজভাঙাসহ বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৯০০০ টন আসে শুধু মোবাইল ফোন বর্জ্য, প্রতিবছর এর পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সারা পৃথিবীতে ২০২৪ সালে ই-বর্জ্যের উৎপাদন ছিল ৬৩৩ লাখ টন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্যের উৎপাদন হবে ৭৪৭ মিলিয়ন টন। বিশ্বে এশিয়ার দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার পরিমাণ ২৪৯ লাখ টন। আমেরিকা ও ইউরোপের চেয়েও আমরা বেশি ই-বর্জ্য তৈরি করি।

স্তূপ করে রাখা এসব ই-বর্জ্য থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ বিশেষ করে ভারী ধাতুগুলো ও জৈব যৌগ মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। ই-বর্জ্যে থাকে ক্ষতিকর বিভিন্ন ভারী ধাতু, যেমন সিলিকন ডাই-অক্সাইড, পলিয়েস্টার, ফেনল, ফরমালডিহাইড, হ্যালেজিনেটিড পলিমার, নাইট্রোজেনধারী পলিমার ইত্যাদি। ই-বর্জ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই বিভিন্ন ভারী ধাতু, বিশেষ করে আয়রন বা লোহা, সিসা, মার্কারি, তামা, ক্যাডমিয়াম এবং ১৫ শতাংশ প্লাস্টিক সামগ্রী। এ ছাড়া এর মধ্যে থাকে টিউব ও স্ক্রিন, কেব্‌ল, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ইত্যাদি। সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হলে পরিবেশদূষণকারী এসব ক্ষতিকর পদার্থ মানুষ ও প্রাণীর মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সম্প্রতি হৃদয় রায় ও সাথী গবেষকদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক সামগ্রীগুলোর মধ্যে মোবাইল বা সেলফোনের জীবনকাল সবচেয়ে কম, যা মাত্র ১ থেকে ২ বছর এবং ডেস্কটপ ও ল্যাপটপের জীবনকাল সবচেয়ে বেশি, যা ৭ থেকে ৮ বছর। টেলিভিশনের জীবনকাল ৩ থেকে ৬ বছর। এয়ারকন্ডিশনার যন্ত্রগুলোও সাধারণত সচল থাকে ৫ থেকে ৬ বছর। অধিকাংশ রেফ্রিজারেটর ৮ বছর চলার পর নষ্ট হয়ে যায়। সে সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, দেশের শতভাগ মানুষ সেলফোন ব্যবহার করেন, টেলিভিশন আছে ৮০ শতাংশ ঘরে। অথচ এদের ৬৫ শতাংশ মানুষই জানেন না ই-বর্জ্য কী? প্রতিবছর বাংলাদেশে ই-বর্জ্য বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। এর খুব সামান্য পরিমাণ প্রতিবছর রিসাইক্লিং করা হচ্ছে, যার পরিমাণ মাত্র ১৩ থেকে ১৪ হাজার টন।

মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ই-বর্জ্যের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পরিবেশে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদির ওপর ই-বর্জ্যের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ই-বর্জ্য যখন ভাঙা বা গলানো হয়, তখন তা থেকে যেসব রাসায়নিক ধাতব দ্রব্য বের হয় সেগুলো বাতাসে মেশে, পানিতে যায় ও মাটিকে দূষিত করে। ই-বর্জ্যের বিভিন্ন কণা ও রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ডাইঅক্সিন বায়ুমণ্ডলের বাতাসে মেশে। এতে বায়ু দূষিত হয়। শ্বাসের সঙ্গে সেই দূষিত বায়ু দেহে শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে, ত্বকের সংস্পর্শে আসে ও মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। এতে টিউমার ও ক্যানসারের মতো রোগও হতে পারে। ই-বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে তা থেকে নির্গত মার্কারি বা পারদ, লিথিয়াম, সিসা, বেরিয়াম ইত্যাদি ধাতবদ্রব্য মাটির গভীরে প্রবেশ করে, এতে মাটি ও পানি দূষিত হয়। এরূপ মাটির নিচ থেকে যে পানি তোলা হয়, তাতেও এসব ধাতুর কণা পাওয়া যায়। ওপর থেকে এসব ধাতবদ্রব্য বৃষ্টির পানিতে মিশে চলে যায় পুকুর, খাল ও নদীতে। কাজেই সেসব পানিও দূষিত হয় ও জলজ জীবের আবাসস্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ফলে পরিবেশে সামগ্রিক পরিবেশতন্ত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

বর্তমানে কেউ কেউ ই-বর্জ্যকে আখ্যায়িত করেছেন

‘নগর খনি’ বা ‘আরবান মাইন’ হিসেবে। কেননা, এসব বর্জ্য থেকে দূষক দ্রব্যের পাশাপাশি পাওয়া যায় অনেক মূল্যবান ধাতু। তাই কোনো দেশে ই-বর্জ্য এখন সম্পদ। কোনো কোনো দেশ অন্য দেশ থেকে তাই ই-বর্জ্য কিনছে ও এর ওপর ভিত্তি করে ই-বর্জ্য সম্পদ সংগ্রহের শিল্প গড়ে তুলেছে। বিশ্বের অনেক দেশে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু আহরণকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে অনেকে। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড বা র‍্যাম থেকে সোনা, রূপা, তামা, টিন, লিথিয়াম, প্লাটিনাম, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি মূল্যবান ধাতু পাওয়া যায়। এ ছাড়া পাওয়া যায় কাচ ও প্লাস্টিক। গবেষণায় দেখা গেছে, ১ টন পিসিবি বা র‍্যাম থেকে প্রায় ৬০০ গ্রাম সোনা ও ৭ দশমিক ৬ কেজি রূপা পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও এরূপ শিল্প স্থাপন করে ই-বর্জ্যের মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার বা সংগ্রহ করা যেতে পারে। ই-বর্জ্য ভাগাড়ে বা ভূমি ভরাটকাজে ব্যবহার না করে এভাবে তা থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রাহক, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী ও ই-বর্জ্য রপ্তানিকারক গোষ্ঠী তৈরি করে ই-বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা যায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-কে ২০২১ সালে হালনাগাদ করে তাতে ই-বর্জ্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা। এ বিধিমালা অনুসারে, কোনো পুরোনো ইলেকট্রিক্যাল বা ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি বা গ্রহণ করা যাবে না, ই-বর্জ্য পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পরিবহন করতে হবে, আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে হবে, এরূপ নানাবিধ বিধির উল্লেখ থাকলেও সেগুলো পরিষ্কার বা সুস্পষ্ট না, পরিবেশবান্ধব পরিবহন বলতে আসলে কী বোঝায়, আন্তর্জাতিক মানইবা কী? ই-বর্জ্য সম্পর্কে যখন ব্যবহারকারীদের দুই-তৃতীয়াংশের কোনো ধারণা নেই, যাঁরা এসব বর্জ্য নিষ্পত্তি ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করছে, তারাও এসব বিধিমালা সম্পর্কে জানে না, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিও জানা নেই। ঘরের একটা টিভি নষ্ট হলে কোথায় ফেলবে, তা কেউ জানেন না, নষ্ট মোবাইলটাও তো ফেলা হচ্ছে ঘরে রাখা বর্জ্যপাত্রে। তাই সবার আগে দরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সবার সচেতনতা সৃষ্টি, বর্জ্য সংগ্রহ থেকে নিষ্পত্তি বা রিসাইক্লিংসহ পুরো প্রক্রিয়াটির একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকা দরকার, তথ্যবিভ্রান্তি এড়াতে গবেষণাও দরকার। এ বিষয়ে যেসব নীতি ও বিধি আছে সেগুলোরও স্পষ্টীকরণ ও যথাযথ প্রয়োগই পারে সঠিকভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করতে।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত