Ajker Patrika

বিভেদ বাড়িয়ে ঐক্যের ডাকে কাজ হবে তো

দেশের সক্রিয় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতিতে দেখতে চায় না। কিন্তু কী উপায়ে দলটিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যাবে, সেই কৌশল নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। এ ছাড়া অপরাধে জড়িত না থাকা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাইলে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন কোনো কোনো রাজনীতিক।

আজাদুর রহমান চন্দন
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: পিআইডি
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: পিআইডি

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারানোর পর থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছিলেন কেবল সজীব ওয়াজেদ জয়। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের সেসব বক্তব্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন সীমাহীন দুর্নীতি, নির্বাচনের নামে বারবার তামাশা এবং সর্বোপরি আন্দোলনকারীদের দমাতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যাপক হত্যা-নৃশংসতার জন্য এতটুকু অনুশোচনা প্রকাশ পায়নি। উল্টো তিনি গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে আইনসংগত সংস্কার ও নির্বাচন অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত জয় দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দল বলতে নিজের দল আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘না শুধরে কি পাবে আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে তখনই লিখেছিলাম, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী করে নিজেদের শুধরে নেওয়ার বদলে অনুকূল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের শোধরানোর উদ্যোগ না নিলে তাঁদের সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে কি না, সেই প্রশ্নও রেখেছিলাম।

আমার মতো এক নগণ্য ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিমতের বিষয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকেরা সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন—এমন আশা কস্মিনকালেও পোষণ করি না। তবে গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা নানা বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাতে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপের লেশমাত্রও দেখা যায়নি। উল্টো তাঁরা আদৌ কোনো অপরাধ বা ভুল করেছেন কি না, সে বিষয়ে জনমত জানতে আগে তাঁদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়ার সুযোগ চান দলটির কোনো কোনো নেতা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ভুল-ত্রুটি সামনে এনেই রাজনীতিতে এবং জনগণের কাছে ফিরতে চায় তাঁদের দল।

নাছিম আরও বলেন, ‘আমরা যদি ভুল করি, মানুষ খারাপ বললে সেই সমালোচনা মেনে নিয়ে আমরা শোধরাবার চেষ্টা করব। অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও সমৃদ্ধ কাজ করার চেষ্টা করব। আমরা খারাপটাকে বর্জন করব। খারাপ যদি করে থাকি, সেটার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমরা দলীয় মূল্যায়ন করে দেশের মানুষের কাছে গিয়ে তুলে ধরব।’

দলীয় বা সরকারি পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার যাঁরা করেছেন, তাঁদের মনোভাব এমন হলেও সাধারণ অনেক কর্মী-সমর্থকের কাছ থেকে শোধরানোর পক্ষেই মত পেয়েছি। ফোনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি সরাসরি আলাপচারিতায় চেনাজানা বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগারের কাছ থেকে এমন অভিমত পাই। আমার নিজ এলাকার একজন সুপরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগার তো ফেসবুকে মন্তব্যের ঘরে সরাসরি লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারক মহলের ভাববার সময় এখনই’।

আওয়ামী লীগারদের প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, লেখাটি ছাপা হওয়ার পর একদা বামপন্থী দু-একজন বন্ধু কিন্তু আমার ওপর বেজায় চটেছিলেন। একজন লিখেছিলেন, ‘আপনাদের লজ্জা করে না ইনিয়ে-বিনিয়ে, প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের মতো একটা দুর্বৃত্ত দলের পক্ষে কথা বলতে?’ ওই বন্ধুটির কাছে আওয়ামী লীগকে শোধরানোর তাগিদ দেওয়ার মানে হলো ‘প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের মতো একটা দুর্বৃত্ত দলের পক্ষে কথা’ বলা!

পুরোনো প্রসঙ্গটি টেনে আনলাম ‘রিফাইন্ড (পরিশীলিত বা সংশোধিত) আওয়ামী লীগ’ নিয়ে হঠাৎ রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণে। রাজনীতিতে এই নতুন উত্তাপ দেখা দিয়েছে মূলত ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের নেই’ বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক মন্তব্যের পর। ড. ইউনূস গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলের কাছে ওই মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবার রাত ১২টার বেশ কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি বলেন, ‘ড. ইউনূস, আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।’ এর ঘণ্টাখানেক পর আরেকটি বড় পোস্টে হাসনাত দাবি করেন, ভারতের পরিকল্পনায় ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি লেখেন, ‘আমিসহ আরও দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ মার্চ দুপুর ২: ৩০-এ। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই।’ হাসনাত আরও লেখেন, ‘আমাদের আরও বলা হয়, “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে—এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।’

দেশের সক্রিয় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতিতে দেখতে চায় না। কিন্তু কী উপায়ে দলটিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যাবে, সেই কৌশল নিয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। এ ছাড়া অপরাধে জড়িত না থাকা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাইলে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন কোনো কোনো রাজনীতিক। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘যাঁরা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী, তাঁদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না কেন?’ তাঁর এই বক্তব্য নিয়েও দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করছেন বিএনপিরও কিছু লোক। রিজভী কিন্তু আওয়ামী লীগের অপরাধী নেতাদের বিচারের বিপক্ষে কিছু বলেননি। তাঁর বক্তব্যেও মূলত পরিশীলিত আওয়ামী লীগের ধারণারই সমর্থন মেলে। কিন্তু তাঁকে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির শিকার বানানোর চেষ্টা চলছে। কিছু মহল বিষয়টিকে ফ্যাসিস্ট দলের পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করে নিজস্ব গোষ্ঠীস্বার্থে সাধারণ মানুষকে পক্ষে টানার চেষ্টায় লিপ্ত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টায়ও আছে কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী। কেউ কেউ এই ইস্যুতে নিরাপত্তা বাহিনীকেও জনগণের প্রতিপক্ষ বানাতে চাইছে। এতে যে সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না চিন্তাবিদ তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও।

হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর দ্বিতীয় পোস্টের একেবারে শেষে লিখেছেন, ‘আসুন, সকল যদি কিন্তু পাশে রেখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।’ যদিও একটি বিষয়েই শুধু নয়, বরং সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্যই অপরিহার্য ছিল ঐক্য। কিন্তু বাস্তবে হলো উল্টোটা। শুরু থেকেই উপেক্ষা করা হতে থাকল বামপন্থী রাজনৈতিক দল-সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদের। দিনে দিনে নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে মতভেদও প্রকাশ পায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের। এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকারসহ নানা ইস্যুতে বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসা ব্যক্তি-সংগঠনকেও কখনো ‘শাহবাগি’, কখনো ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে মব লেলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ‘শক্তি-সামর্থ্য’ কম বলেই বোধ করি বিষয়টি অনেকের কাছে ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু একপর্যায়ে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সঙ্গেও মতভিন্নতা দেখা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত এনসিপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের। রাষ্ট্রপতিকে সরানো, গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ, জাতীয় নির্বাচনের আগেই সংস্কার ও স্থানীয় নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে এই মতভেদ দেখা যায়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো শনিবারও এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে কিংবা নির্বাচন আগে, সংস্কার পরে—এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। জাতীয় সংস্কার কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে, যা অনভিপ্রেত।

আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আগাগোড়াই আন্দোলনে ছিল বিএনপি ও তার সমমনা বিভিন্ন দল, সিপিবি-বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চাসহ অনেক রাজনৈতিক দল। আন্দোলনকারী অনেক দলের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে নিজেদের সুবিধামতো ঐক্যের ডাক কতটা ফলদায়ক হবে সেটা অচিরেই স্পষ্ট হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে কারখানায় মিলল ৬ দিন আগে নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর লাশ

বিকাশ ও নগদ ছাড়াই দেশে আন্তএমএফএস লেনদেন চালু

বাবার ব্যবসায়িক সমস্যায় জামায়াত প্রার্থীর সিদ্ধান্তে নাখোশ শিবির নেতার পদত্যাগ

২ শিশুকে হত্যা করে বালুচাপা: বিএনপির নেতা কারাগারে

ভিন দেশে সরকার উৎখাতের মার্কিন নীতির দিন শেষ: তুলসী গ্যাবার্ড

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

প্রশাসন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়নি

মোশাহিদা সুলতানা।

মোশাহিদা সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘সর্বজনকথা’র প্রকাশক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে চা-দোকানি, ভবঘুরে ও হকার উচ্ছেদের কারণ এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে।

মাসুদ রানা
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৫: ৪৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে চা-দোকানি এবং হকার উচ্ছেদের মূল কারণ কী? শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?

চা-দোকানি ও হকাররা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেন, এ রকম তথ্য আমরা এর আগে শুনিনি বা পাইনি। যেটা আমরা জেনেছি, এখানে কিছু ভবঘুরে, পাগল থাকেন; বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এখানে মাদকাসক্তদের আড্ডার বিষয়টা বড় করে উপস্থাপন করা হয়। সেসবের সঙ্গে হকারদের কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমাদের ধারণা নেই। ধারণা নেই বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, আসলে তাঁদের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, যদি সম্পর্ক থাকত, তাহলে ক্যাম্পাসের পাশে যে শাহবাগ থানা আছে, তারা তা জানত। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কারা মাদক বিক্রি করে, সেটা তারা জানে এবং চাইলে তাদেরকে ধরতে পারে। কিন্তু চা-বিক্রেতা বা হকারদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

ডাকসুর কোনো প্রতিনিধি কি এভাবে হকার উচ্ছেদ করতে পারেন? এটা তো প্রশাসনের দায়িত্বে হওয়ার কথা?

সত্যি বলতে কি, ডাকসু প্রতিনিধিদের এগুলো করার কথা নয়। এটা যাঁরা করেছেন, তাঁরা নিয়মবহির্ভূতভাবেই করেছেন। এটা করার কোনো এখতিয়ার তাঁদের নেই। তাঁরা বরং প্রশাসনের কাছে দাবি তুলতে পারেন, আপনারা এখান থেকে চা-দোকানি ও হকারদের সরিয়ে নিন এবং এখানে একটা বিকল্প ব্যবস্থা করুন। এখানে চা-দোকানি বা হকাররা কেন এসেছেন? ক্যাম্পাসে সস্তা খাবারের চাহিদা আছে বলেই তাঁরা এখানে ব্যবসা করতে পারছেন। এখানে মেট্রোরেলের কারণে মানুষের যাতায়াত আছে। দুপুর ও রাতের খাবারের পরেও শিক্ষার্থীদের খিদে লাগাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁরাই কিন্তু এসব দোকানের বড় কনজ্যুমার বা ভোক্তা।

এখন তাঁরা যদি বলেন, এখানে কেন তাঁরা এলেন, কেন তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হলো? তাহলে বলতে হবে, সেটা তো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছেন। সবার জানা থাকার কথা, জুলাই আন্দোলনের সময় এই মানুষগুলোই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেক সময় তাঁরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বিপদগ্রস্ত হলে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের সাহায্যও করেছেন। এভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হকার বা চা-দোকানিদের একটা দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

আরেকটা বিষয় লক্ষ করার মতো, তাঁদের বেশির ভাগই একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন বয় ছিলেন নতুবা ক্যানটিনের অন্য কাজ করেছেন। এ ধরনের লোকজন অবসর সময়ে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এভাবে তাঁরা আবার ক্যাম্পাসের ইকোসিস্টেমের অংশ হয়ে গেছেন। এঁদেরকে বহিরাগত হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

উচ্ছেদ করা দোকানি বা হকারদের বিরুদ্ধে ‘মাদক কারবারি’র অভিযোগ আনা হয়েছে। ঢালাওভাবে সবাইকে অভিযুক্ত করা কতটা যৌক্তিক?

ক্যাম্পাসে একটা সিস্টেম থাকা দরকার। কাদেরকে এবং কীভাবে বসার অনুমতি দেওয়া হবে? এই অনুমতি যদি কেউ ভেতরে ভেতরে দিয়ে থাকে, কোনো চাঁদাবাজির ব্যাপার থাকে এবং সেখান থেকে কোনো অর্থ আয়ের ব্যাপার থাকে, তাহলে তাঁরা কোনোভাবেই সিস্টেমের মধ্যে আসতে চাইবেন না। সেটা আইনি পথ নয়। লিখিত অনুমতি না থাকায় মুখে মুখে একধরনের অনুমতি দেওয়ার মতো ব্যাপার। অর্থাৎ মৌখিক চুক্তি।

যেটাকে তাঁরা আইনবহির্ভূত বলছেন, সেটার কি কোনো লিখিত দলিল আছে? লিখিত থাকলে সেটা দেখার বিষয়। যদি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে তার তো একটা নীতিমালা থাকা উচিত। সেই নীতিমালা অনুযায়ী হকারদের বসতে দেওয়া হবে। কিন্তু সেটা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

ডাকসুর পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযানে সরাসরি যুক্ত হওয়া কি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে প্রশাসন বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার ইঙ্গিত দেয় না?

প্রশাসন বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার ইঙ্গিত দেয় কি না, সেটা তো আমরা জানি না। তবে অন্য কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ ধরনের কাজ করার কথা নয়। এর মধ্যে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, সেখানে দু-তিন রাতের মধ্যে দোকান বসানো হয়েছে। এই দোকানগুলো বসানো হয়েছে নতুন প্রশাসন আসার পর। তাঁরা কীভাবে এখানে এসে দোকান খুলতে পারলেন? এখানে নিশ্চয় কোনো গোষ্ঠীস্বার্থের ব্যাপার আছে, যারা এই নতুন দোকানিদের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অনুমান করতে পারি, এখানে কোনো না কোনোভাবে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ থাকতে পারে।

যে বামপন্থী ছাত্রনেতারা এসবের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদেরকে ‘গাঞ্জাটিয়া’সহ আপত্তিকর শব্দে গালি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের ভাষার ব্যবহার কি ছাত্ররাজনীতির পরিবেশকে বিব্রত করে না?

যাঁরা এভাবে কথা বলছেন, তাঁদের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা হলো, যাঁরা তাঁদের এসব অপকর্মে বাধা দিচ্ছেন, তাঁদের কোনো না কোনোভাবে মানুষের কাছে হেয় করা। আমাদের সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী, কাউকে হেয়, অপমান করা এবং ট্যাগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এমনভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়, যেন তাঁরা ভবিষ্যতে কোনো ঘটনায় প্রতিবাদ করতে না পারেন। সেই উদ্দেশ্য থেকে বামপন্থীদের ‘গাঞ্জাটিয়া’ এবং ভবঘুরে ও হকারদের সক্রিয়ভাবে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। কোনো বামপন্থী বা সাধারণ শিক্ষার্থী বলেননি যে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা চান না। বামপন্থী ছাত্রনেতারা কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন।

এখন হকার উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিছুদিন পর অন্য কোনো হকার অন্য প্রক্রিয়ায় ফিরে আসতে পারেন। তাঁরাই যদি আবার নারী শিক্ষার্থীদের গোপনে ছবি তোলেন বা ভিডিও করেন? সেটার কী হবে?

ডাকসু প্রতিনিধি সত্যি সত্যি নিরাপত্তার কথা ভেবে থাকলে আগে তাঁদেরকে জানতে হবে, কোন কোন বিষয় একজন নারী শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তাহীন করে তোলে। শিক্ষার্থীরা কি অভিযোগ করেছেন, যাঁরা প্রকাশ্যে খাবার বিক্রি করেন, তাঁরা নারী শিক্ষার্থীদের যৌন কোনো ইঙ্গিত দিয়েছেন কিংবা শ্লীলতাহানি করেছেন? অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ডাকসুর যে দুজন প্রতিনিধি হকার ও চা-দোকানিদের পিটিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু অভিযোগ করেছেন, তাঁরা মাদকাসক্তি নির্মূল করছেন। ব্যাপারটিকে তাঁরা ঘুরিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাঁরা এটার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁরা (বামপন্থীরা) যেন মুখ খুলতে না পারেন।

এই পুরো ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা কতটা নিরপেক্ষ ছিল বলে আপনি মনে করেন?

আমার মনে হয়, ডাকসুতে যাঁরা প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা একটা বিশেষ দলের আজ্ঞাবহ হয়ে সুচিন্তিতভাবে এ কাজগুলো করছেন। ডাকসুর প্রতিনিধিরা প্রশাসনের ওপর ধারাবাহিকভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে প্রশাসন কোনো ভূমিকা না নেয়। এই সুযোগে ছাত্রপ্রতিনিধিরা ভূমিকা গ্রহণ করছেন। এ কারণে আমি এ ঘটনাকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলব।

ডাকসুর গঠনতন্ত্রে এসব না থাকার পরেও তাঁরা এটা কীভাবে করতে পারলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা কি এড়াতে পারে?

এই প্রশাসন কিন্তু আরও অনেক কিছু করেনি। তাদের দায়িত্বের কাজ না করার কারণে এখানে অনেক ঘটনা ঘটেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাম্য হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ওই সময় কিন্তু ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আসার নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। তা সত্ত্বেও এ ঘটনা ঘটেছে। সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশাসন করতে পারেনি।

কোনো বহিরাগত ক্যাম্পাসে এসে কোনো নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করেছে, সে রকম কিছু আমরা শুনিনি। কিন্তু আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন কর্মচারী একজন নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করেছেন। তাঁর অপরাধের কারণে তাঁকে থানায় পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তাঁকে থানা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে, তাঁকে ফুলের মালাও পরানো হয়েছে।

এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, প্রশাসন আসলে কোনো ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়নি। তার কারণে ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে।

গত সরকারের সময় ছাত্রলীগ যে অপকর্মগুলো করেছিল, বর্তমান ডাকসু নেতৃত্ব কি সেদিকে অগ্রসর হচ্ছেন বলে আপনি মনে করেন?

আগে ছাত্রলীগ যা করত, এখনকার ডাকসু প্রতিনিধিরা কম কিছু করছেন না। এগুলো নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো অনুশোচনাও নেই। তাঁরা বলছেন, বামপন্থীদের ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। যাঁরা ঘটনাগুলোর প্রতিবাদ করছেন, তাঁদেরকে হেয় করছেন। বিভিন্নভাবে তাঁদেরকে অপমান করা ও অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটা ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ভবঘুরের ব্যক্তিগত ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করার সঙ্গে কনডম পাওয়ার ঘটনাটি প্রচার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী কি কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারেন? কিছুদিন আগে আমাদের একজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, দুই প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য তাঁর মোবাইল ফোন চেক করেছেন। এই যে ধারাটা শুরু হয়েছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ভীতি ঢোকানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে কারখানায় মিলল ৬ দিন আগে নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর লাশ

বিকাশ ও নগদ ছাড়াই দেশে আন্তএমএফএস লেনদেন চালু

বাবার ব্যবসায়িক সমস্যায় জামায়াত প্রার্থীর সিদ্ধান্তে নাখোশ শিবির নেতার পদত্যাগ

২ শিশুকে হত্যা করে বালুচাপা: বিএনপির নেতা কারাগারে

ভিন দেশে সরকার উৎখাতের মার্কিন নীতির দিন শেষ: তুলসী গ্যাবার্ড

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মৃত্যুর মিছিলের শূন্যতা

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪৭
মৃত্যুর মিছিলের শূন্যতা

মানুষের জীবনের একটা অনিবার্য পরিণতি—মৃত্যু, সে এক প্রাকৃতিক বিষয়। যেমন মেঘ, বৃষ্টি, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত—যার ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনই। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু হলে আমরা বলে থাকি, একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো, যে শূন্যতা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করি আমরা বহু দিন, বহু বর্ষ, বহু শতাব্দী। তেমনি সাম্প্রতিককালে আমরা একটা মৃত্যুর মিছিল দেখছি, যার সূচনা হয়েছে যতীন সরকার থেকে। যতীন সরকার ছিলেন নেত্রকোনার বারহাট্টা গ্রামের একজন ছাপোষা শিক্ষক। দেশ বিভাগের আগে একজন শিক্ষক কেমন ছিলেন, তা সহজে অনুমান করা যায়। কিন্তু তিনি বলেও গেছেন ছাত্রদের এবং কৌতূহলী মানুষদের, সেগুলো পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নয়, আবার পাঠ্যবই থেকে পড়িয়েছেনও।

তাঁর অনেক মূল্যবান লেখার মধ্যে একটি লেখা, ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন।’ এই বইয়ে তিনি দার্শনিকতার সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, একটা পুকুরপাড়ে দেখা গেল অনেক মানুষের জটলা, কৌতূহলবশত সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী হয়েছে?’ উত্তরে একজন এসে বললেন, ‘ঐ যে পুকুরে মাছ ধরছে।’ এর পরের জিজ্ঞাসা, ‘আপনারা কী করছেন?’ উত্তর, ‘আমরা দার্শনিক।’ কথাটা নেত্রকোনার একটি আঞ্চলিক কথা বটে, কিন্তু যতীন সরকার তাকে একটা দার্শনিক অভিধা দিয়েছেন। যিনি দর্শন করেন, তিনি তো দার্শনিক বটেই। পৃথিবীর সব দার্শনিকের দর্শনচিন্তার শিকড় তো সেটাই, কিন্তু তারপর তিনি কী দেখেন? শুধুই কি দেখা, নাকি এই দেখা মানবজাতির অভিজ্ঞতায় নতুন একটা উপাদান হিসেবে যুক্ত হলো, সেটাই দেখার বিষয়। যতীন সরকার লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’। তিনি পাকিস্তানের জন্ম দেখেছিলেন, মৃত্যুও।

তাই তার আনুপূর্বিক বিষয়াদি নিয়ে তাঁর ভাবনা উপস্থিত করেছিলেন। পাঠক তাতে ঋদ্ধ হয়েছিল। এভাবে কোনো রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় কি না, তার ভবিষ্যৎই-বা কী দাঁড়ায়? বরং চিরতরে একটা সাম্প্রদায়িকতার উৎস এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকেই বেগবান করে তোলে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনায় তার উদ্বেগ শুধু নয়, একটা ব্যাখ্যাও আমাদের আলোড়িত করত। প্রায়ই একই সময়ে আরেকজন শিক্ষক, তিনি এসেছেন পশ্চিম বাংলার বর্ধমান ও কলকাতা থেকে—বদরুদ্দীন উমর।

পিতা আবুল হাশিমের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন দেখেছেন কিন্তু ছোটবেলা থেকে পরিবারের অন্য আত্মীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেই প্রভাব ছিল সাম্যবাদের পক্ষে। পাকিস্তানের দার্শনিক ভিত্তিটায় তিনি প্রথমেই আঘাত করেন। তাঁর যুগান্তকারী রচনা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সংস্কৃতির সংকট’। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটটিতেই যাদের ভাবনায় দেখা দেয়—‘আমরা বাঙালি না মুসলমান’। এই সময়ই তিনি ‘ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামক বইটি লিখেছিলেন। সংকটটা যে তখন শুধু ভাষার ছিল না, সঙ্গে ছিল আরও অনেক ধরনের বাস্তবতা, তা এত সবিস্তারে যুক্তিসহযোগে তাঁর মতো আর কেউ উপস্থাপন করেননি। আমৃত্যু তিনি নিরলসভাবে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখে গেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাষা আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ এক ফলক, যাকে স্পর্শ না করে কোনোভাবেই হাঁটা যায় না। সেই পথ, সেই ঘটনার সাক্ষী আরেক লেখক, গবেষক আহমদ রফিক। পেশায় চিকিৎসক। ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী শুধু নন, সংগঠক, নেতা এবং আজীবন ভাষার আলো তিনি ছড়িয়ে গেছেন। লেখক হিসেবে তাঁর দিগন্ত বিস্তৃত, কিন্তু তিনি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, ভাষার দর্শনেরও প্রবক্তা।

সম্প্রতি এই মৃত্যুর মিছিলে যিনি যুক্ত হয়েছেন, তিনি বয়সে তাঁদের চেয়ে ছোট হলেও ছিলেন দর্শনের ছাত্র। নিজেকে তিনি কখনোই শিক্ষক ভাবতেন না; বরং ছাত্র ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি দর্শনকে ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসতেন। সেই সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে একটা দিগন্তে তাঁর বিচরণ তো ছিলই। বিপুলসংখ্যক ছাত্র-অছাত্র-পাঠকের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটা প্রভাব তৈরি হয়েছিল, যা তাঁর মৃত্যুর পর নানা মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি গল্প, নাটক লিখেছেন, অসংখ্য প্রবন্ধের রচয়িতাও। এ দেশে যা একেবারেই দুর্লভ, সেই কাজও তিনি করেছেন। তা হলো চিত্রকলা ও সাহিত্যের সমালোচনা। এ কাজগুলো হয়তো আরও অনেকে করে থাকেন, কিন্তু মনজুরের যে আত্মগত অঙ্গীকার, তা একেবারেই দুর্লভ। স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো শিল্পীকে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করার কাজটিও তিনি প্রায় নিয়মিতই করতেন; বিশেষ করে তরুণদের নিয়ে। তিনি তরুণদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন নিয়মিত। সর্বোপরি আধুনিকতায়, চিন্তায়, মননে ও ব্যবহারিক জীবনে সব সময় আধুনিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করতেন প্রবলভাবে। আধুনিক মনন একবার গ্রহণ করলে পূর্বাপর তাবৎ জ্ঞানকে একটা পরিশীলিত এবং সময়োপযোগী হিসেবে গ্রহণ করাটা সহজ হয়। সাধারণত মতাদর্শগত জ্ঞান এবং ভাবনা যদি গভীরভাবে মননে প্রোথিত হয়ে যায়, তাহলে মুক্তবুদ্ধিকে ধারণ করাও কঠিন হয়ে যেতে পারে।

যতীন সরকার যখন জন্মেছিলেন, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক দর্শন মার্ক্সবাদের প্রভাব সারা বিশ্বে স্পন্দিত হয়েছিল। বস্তুবাদী দর্শনের নিরিখে একধরনের গবেষণালব্ধ এবং যুক্তিতর্কের উপস্থাপনার সময় এসেছিল। বাড়ির পাশেই দেখতে পেয়েছিলেন টংক বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ। সেই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ—এসব তাঁর চিন্তাকে নিশ্চয় অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু ওই পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শনের মধ্য দিয়ে একদা আবিষ্কার করলেন, তিনি সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন। সংখ্যালঘুর সেই জটিল নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও তিনি তাঁর

কথা নিঃসংকোচে লিখে গেছেন এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছেন।

বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন একই সময়ের মানুষ। মার্ক্সবাদের দীক্ষায় তাঁর যৌবন ও উত্তরকাল কেটেছে। বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাজ ছেড়ে তিনি সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার—সবই ছিল তাঁর তুখোড় সমালোচনার ক্ষেত্র। রাজনীতি কখনো দার্শনিকতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার বাইরে চলে যায়। যুক্তি কখনো একপেশে হয়ে

যায়। তিনি একই মতাদর্শের মানুষেরও সমালোচনা করতেন। কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। একটা সমাজে এখন এ রকম মানুষের প্রবল অভাব।

ভাষা আন্দোলনের সৈনিক, সংগঠক, সাক্ষী আহমদ রফিক শুধু চিকিৎসক হিসেবেই জীবনটা পার করে দিতে পারতেন। ভাষা আন্দোলন তো বটেই, নব্বই-ঊর্ধ্ব জীবনে শিক্ষকের পেশা ছেড়ে দিয়ে তিনি সাহিত্যেও মনোনিবেশ করেছিলেন, কিন্তু চিন্তায় ছিলেন প্রগতিশীল। সুদীর্ঘ জীবনে একজন মানুষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যাঁরা লড়াই করেন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন।

গত ৫৪ বছরের রাজনীতিতে সরকার সমাজের কথা ভাবেনি। রাষ্ট্রও নিরপেক্ষ ও মানবিক হতে পারেনি। পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছর এবং পরে বাংলাদেশের ১৫ বছরের বেশি সময় একটা অগণতান্ত্রিক সামরিক ব্যবস্থার মধ্যে চলেছে।

তাই সমাজে মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই ঘটেনি; বরং রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাকে করায়ত্ত করার জন্য কালক্ষেপণ করেছে। এই ব্যবস্থায় অর্থ এসে দাঁড়িয়েছে একটা কেন্দ্রস্থলে। সব ক্ষেত্রে পেশাদারি সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। সামরিক বাহিনীও ব্যবহৃত হয়েছে এর পাহারাদার হিসেবে। আজকের সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা তারই প্রতিফলন। যে সময়ে এই মানুষগুলো লোকান্তরিত হলেন, সে-ও এক অস্থির সময়। তাঁদের মূল্যায়নের জন্য এই সময়টি তেমন সুস্থির সময় নয়। এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য অনাগতকালে কোনো মহৎ মানুষের জন্ম হবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত। অসংখ্য রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে, পাশাপাশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু বিপুল বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি কী করে নিরাপদ হবে, তার ভাবনা কোথায়?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে কারখানায় মিলল ৬ দিন আগে নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর লাশ

বিকাশ ও নগদ ছাড়াই দেশে আন্তএমএফএস লেনদেন চালু

বাবার ব্যবসায়িক সমস্যায় জামায়াত প্রার্থীর সিদ্ধান্তে নাখোশ শিবির নেতার পদত্যাগ

২ শিশুকে হত্যা করে বালুচাপা: বিএনপির নেতা কারাগারে

ভিন দেশে সরকার উৎখাতের মার্কিন নীতির দিন শেষ: তুলসী গ্যাবার্ড

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তিনজন চিকিৎসক!

সম্পাদকীয়
তিনজন চিকিৎসক!

দেশে বড় বড় কত ঘটনা ঘটে চলেছে, অথচ সেদিকে চোখ না রেখে দিনাজপুরের বিরামপুর নিয়ে কেন সম্পাদকীয় লিখতে হবে, তার একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। দেশের রাজনীতিতে প্রতিটি মুহূর্তেই জন্ম নিচ্ছে নতুন বাস্তবতা। একটি রাজনৈতিক দলকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে অন্য এক দলের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহী, পর মুহূর্তেই দেখা যাচ্ছে, সেই ধারণা ঠিক নয়। জুলাই সনদ নিয়েই নানা ঘটনা ঘটছে দেশবাসীর চোখের সামনে। কিন্তু ঘটনা কোন দিকে গড়ায়, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক রাজনীতি-সচেতন মানুষ বা দলের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। তাই ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে টেনে নিয়ে যাবে, সেটাই শুধু দেখার বিষয়। মন্তব্য করার মতো পরিপক্ব হয়ে ওঠার আগেই ঘটনা বদলে যাচ্ছে।

এ কারণেই বিরামপুরকে বেছে নেওয়া। বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান অবস্থা থেকেও আমাদের অসহায়ত্বের খানিকটা আঁচ পাওয়া যাবে। একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে ২৫ জন চিকিৎসক থাকার কথা, কিন্তু সেখানে আছেন সবে ধন নীলমণি ৩ জন—এই একটি তথ্যই বুঝিয়ে দেয়, কী অবস্থায় রয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য খাত। ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদের কোনো কমতি নেই, কিন্তু রয়েছেন তিনজন চিকিৎসক। বিরামপুর উপজেলার একটি পৌরসভা, সাতটি ইউনিয়নসহ পাশের বিভিন্ন উপজেলার ৫০০ থেকে ৬০০ রোগীকে প্রতিদিন আউটডোরে এবং প্রায় ৬০ জন ভর্তি রোগীকে ইনডোরে চিকিৎসা দিতে হয়। তিনজন চিকিৎসক কীভাবে রোগীদের এই চাপ সামলাচ্ছেন, সেটা বোধগম্য নয়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, এখানে গাইনি ও স্ত্রীরোগের জন্য কোনো চিকিৎসক নেই। অর্থাৎ এলাকার নারীরা কতটা বিপদে আছেন, তা এই একটি তথ্য থেকে ধারণা করা সম্ভব।

সাধারণভাবে কয়েকটি প্রশ্ন এসে ভিড় করে মনে। দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ কম নয়, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজও অসংখ্য। দেশে বেকারত্বও প্রকট। তাহলে বিরামপুরের মতো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় চিকিৎসকের সংকট থাকছে কেন? সময়মতো চিকিৎসক নেওয়া হয় না, নাকি দিনাজপুরে গিয়ে চাকরি করতে হবে—এ বিষয়ে চিকিৎসকদের অনাগ্রহ রয়েছে? সরকারি চাকরিতে চিকিৎসকের অনাগ্রহের কথা ধোপে টেকে না। চাকরিসূত্রে যেকোনো জায়গায় তাঁর পোস্টিং হতে পারে। কিন্তু নানাভাবে ‘ম্যানেজ’ করে বড় বড় শহরে থেকে যাওয়ার প্রবণতাও কি রয়েছে সংকটের মূলে? নাকি সরকারি পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে ঘাপলা—সেটিও খুঁজে বের করা খুব জরুরি।

মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা একটি—এ কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। শিক্ষা, বাসস্থানও তো মৌলিক অধিকার, সেটাই-বা কজন পাচ্ছে? আলাদাভাবে তাই স্বাস্থ্যসেবার কথা না বলে জোর দেওয়া যাক রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের দিকে। যাঁরা ক্ষমতায় যান কিংবা যাওয়ার জন্য রাজনীতি করেন, তাঁদের দলীয় ইশতেহারে অনেক দামি দামি কথা লেখা থাকে, কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ২৫ জন জনবলের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ জন চিকিৎসকই থাকবেন। অর্থাৎ ইশতেহার আর বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির জন্য কেউই কাজ করবে না।

এই অবস্থাটা নানাভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিরাজ করছে। এটা বদলাতেই হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে কারখানায় মিলল ৬ দিন আগে নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর লাশ

বিকাশ ও নগদ ছাড়াই দেশে আন্তএমএফএস লেনদেন চালু

বাবার ব্যবসায়িক সমস্যায় জামায়াত প্রার্থীর সিদ্ধান্তে নাখোশ শিবির নেতার পদত্যাগ

২ শিশুকে হত্যা করে বালুচাপা: বিএনপির নেতা কারাগারে

ভিন দেশে সরকার উৎখাতের মার্কিন নীতির দিন শেষ: তুলসী গ্যাবার্ড

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

লাউয়াছড়ায় প্রাণীদের বিপদ

সম্পাদকীয়
লাউয়াছড়ায় প্রাণীদের বিপদ

এখন নাকি বানর আর শূকরের পালকেই দেখা যায় লাউয়াছড়ায়। বিরল প্রজাতির অনেক পাখি ও প্রাণী বাস করত এই সংরক্ষিত বনে। কিন্তু সেসব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বনটিকে নিজেদের অভয়ারণ্য বলে হয়তো ভাবতে পারছে না তারা।

পর্যটন এই জীববৈচিত্র্যকে ম্লান করে দেওয়ার একটি কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। লাউয়াছড়া বনের অভ্যন্তরের অনেকটা পথে গাড়ি ঢুকতে পারে। বনের মধ্যে গাড়ি চলছে—এটা কোনো সুসংবাদ হতে পারে না। গাড়ি প্রবেশে নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। কীভাবে এই গাড়িওয়ালারা অনুমতি নিয়ে লাউয়াছড়ায় প্রবেশ করেন, তা জানা প্রয়োজন।

মৌলভীবাজারে অবস্থিত লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জাতীয় উদ্যান হিসেবে বেঁচে থাকার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের একটি জরিপে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী থাকার কথা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ছিল। কিন্তু এখন এত ধরনের উদ্ভিদ, পাখি ও প্রাণী কেন দেখা যায় না, সে প্রশ্ন তো তুলতেই হবে। যাঁদের ওপর এদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার, তাঁরা আদতে কী করছেন, তা জানতে হবে না?

তবে এ ব্যাপারে বন বিভাগ একটি খাঁটি কথা বলেছে। তাদের মতে, অতিরিক্ত পর্যটকের হট্টগোল, গাড়ি ও ট্রেনের আওয়াজ এবং জনসংখ্যা বাড়ার কারণে প্রাণীরা লোকালয় থেকে একটু দূরে চলে যায়। এসব কারণে প্রাণী কম দেখা যায় বনে। এ ছাড়া পর্যটন আর বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ একসঙ্গে রক্ষা করা কঠিন।

শেষ কথাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ‘পর্যটন আর বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ একসঙ্গে রক্ষা করা কঠিন।’ এ তো খুবই সত্যভাষণ। যদি সেটাই সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এই বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? এই বনের ঘনত্বের কারণে একসময় বনের ভেতর সূর্যের আলো সরাসরি পড়ত না। সেই ঘনত্ব কমে গেল কেন? কেন বনের সর্বত্র মানুষ অবাধে ঢুকে পড়ছে? বন বিভাগ কি জানে না, পশুর চারণক্ষেত্রে মানুষের অবাধ আনাগোনা পশু-পাখির জন্য স্বস্তিদায়ক নয়? আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এই বনে প্রাণীদের খাদ্যসংকট। পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকলে এই বনে পশু-পাখি কেন থাকবে? পশুদের জীবনের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার জন্য চা-বাগানের কীটনাশক মেশানো পানিও অনেকটা দায়ী, যার কারণে ছড়ায় পানি খেতে আসা প্রাণীরা মারা পড়ে।

লাউয়াছড়ার জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো বাড়তি পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই। যে কারণে বনের এই দুর্দশা, তার প্রতিটির সমাধান করার উপায় বন বিভাগের জানা আছে। সেগুলো মেনে চললে লাউয়াছড়ায় বসবাসকারী পশু-পাখি ও উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারবে। একই সঙ্গে প্রকৃতিকে বাঁচানো এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব যদি আন্তরিকতা থাকে। সরকারি কাজে সে রকম আন্তরিকতা কি একেবারেই দুর্লভ হয়ে গেছে? না হয়ে থাকলে তার প্রমাণ দেওয়া হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে কারখানায় মিলল ৬ দিন আগে নিখোঁজ তরুণ-তরুণীর লাশ

বিকাশ ও নগদ ছাড়াই দেশে আন্তএমএফএস লেনদেন চালু

বাবার ব্যবসায়িক সমস্যায় জামায়াত প্রার্থীর সিদ্ধান্তে নাখোশ শিবির নেতার পদত্যাগ

২ শিশুকে হত্যা করে বালুচাপা: বিএনপির নেতা কারাগারে

ভিন দেশে সরকার উৎখাতের মার্কিন নীতির দিন শেষ: তুলসী গ্যাবার্ড

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত