মামুনুর রশীদ
আমি বেশ কিছুদিন আগে এক ফিলিস্তিনি অভিনেতার সঙ্গে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। ওই অভিনেতা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে হলিউডেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। শুনেছি একবার অস্কারে নমিনেশনও পেয়েছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। ফিলিস্তিন নিয়ে আমাদের প্রবল কৌতূহল। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে ওই দেশের কথা জানার চেষ্টা করতাম। তিনি আবার ফিলিস্তিনেরই একটি ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা অনেকেই বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করে থাকেন। পরিচালক, চিত্রগ্রাহক সবাই সেখানে কাজ করে থাকেন। তাঁর পরিবারের গল্পও শুনতাম। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম। যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ওরা বড় হতে থাকে। মনে হতো এর মধ্যেই ওদের নিরাপদ আশ্রয় আছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে নতুন করে যে ইসরায়েলি হামলা শুরু হয়েছে, তাতে নিরাপদ আশ্রয়গুলো আর নিরাপদে নেই। বাড়িঘর, হাসপাতাল, মসজিদ, আশ্রয়শিবির, গগনচুম্বী অট্টালিকাসহ কোনো কিছুই আর ইসরায়েলের আক্রমণের বাইরে নেই।
গত কয়েক দিনে যে নিষ্ঠুরতার চরিত্র দেখেছি, তা দেখে যেকোনো সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। মানুষ নৃশংস হয়, কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্র সন্ত্রাসী এবং নৃশংস হয়ে পড়ে, তার ভয়াবহতা আমরা ইতিহাসে যা দেখেছি, এখানে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। একবার ইরাকের শিশুদের ওপর নৃশংসতা দেখে আমার শ্বাসকষ্টের ব্যাধি হয়েছিল। এবারে সেই ব্যাধিটি সম্ভবত ফিরে এসেছে। কী করে সম্ভব! ইসরায়েলের মতো একটি ছোট রাষ্ট্র সারা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই শক্তির উৎস কী, তা আমরা সবাই জানি। শত শতবার শান্তিচুক্তিসহ নানা ধরনের চুক্তি হওয়ার পরেও ফিলিস্তিনিদের জীবনে শান্তি আসেনি। পাখির যেমন ছোট্ট একটা শান্তির আবাস থাকে, নিরাপদে পাখিরা বাসায় ঘুমায়, আনন্দে শিস দেয়, নিরাপদে খাবার খায়, ছানাদের প্রতিপালন করে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের সেইটুকু শান্তি কখনো আসেনি। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করছে। পিতা তাঁর সন্তানের রক্তাক্ত দেহটাকে কোলে করে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন উন্মাদের মতো, একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। আর তখনই আবার আক্রান্ত হচ্ছেন ওই হতভাগ্য পিতা। এটা দু-এক দিনের অনিশ্চয়তা নয়, সুদীর্ঘ দিনের অনিশ্চয়তার এক বিশাল অভিযান।
পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রে শাসকদের পরিবর্তন হয়েছে, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি ফিলিস্তিনের হতভাগ্য নাগরিকদের ভাগ্য। মানবাধিকার, মানবিকতার রক্ষক এবং জাতিসংঘ ও তার নিরাপত্তা পরিষদ যেসব কথা বলে থাকে, সেগুলো কি শুধু কথার কথা? কোনো বাস্তব প্রয়োগ নেই! এটাই নতুন সভ্যতার হয়তো নিয়ম। ইউক্রেন জ্বলছে, সেই আগুনও নিভছে না। শাসকগোষ্ঠী নানা কীর্তি ও নানান সভায় ব্যস্ত থাকছে, কিন্তু সাধারণ নাগরিকেরা নিজের জীবন বাঁচাতে এক শরণার্থীশিবির থেকে আরেক শরণার্থীশিবিরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর মানব ইতিহাসে এত বড় নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ কখনো ভোগেনি। প্রশ্ন জাগে, আমরা কোথায় আছি? আমাদের অস্তিত্ব কোথায়?
বেশ কিছু শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের কাছাকাছিই আছে। তারা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। একি দুষ্কাল! একটি রক্তাক্ত শিশুকে দেখছিলাম, তার শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে কিন্তু শিশুটি কাঁদছে না। তার যন্ত্রণার অভিব্যক্তিটা অদ্ভুত! হয়তো শিশুটি ততক্ষণে রক্তক্ষরণেই মৃত্যুবরণ করেছে। সে জানে তার কান্না কোনো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সুসভ্য মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। আমরা একসময়ে সেই ষাটের দশকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেইসব নৃশংসতার ছবি দেখে আঁতকে উঠতাম, আবেগে বাঁধভাঙা অশ্রু আমাদের গ্রাস করত। ভিয়েতনামে মাইলাই হত্যাকাণ্ডের ছবি দেখে বা ধানের খেতের পাশে ভিয়েতনামি কোনো গেরিলার ছবি দেখে আতঙ্কিত হতাম, ঘৃণা জাগত সেইসব নৃশংস যুদ্ধাপরাধীদের দেখে। কিন্তু আজকে যা হচ্ছে সে তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে ছাপিয়ে ভিয়েতনামের নৃশংসতাকে অতিক্রম করে এক নতুন বাস্তবতায় গিয়ে ঠেকেছে। যে বাস্তবতায় মানুষের জীবন অর্থহীন। সারা পৃথিবী রক্তস্নাত হলেও জাগ্রত বিশ্ব বিবেক কিছুই করতে পারছে না। একটি রাষ্ট্র তার সব অসহায়ত্ব নিয়ে বিশ্ব বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিভক্ত মানবতা, সেই সঙ্গে অসহায় বিশ্ব বিবেক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্য শুধুই অবলোকন করছে।
কিছুদিন ধরেই এই যুদ্ধের বিভীষিকা মানবতার আর্তনাদ আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমাদের করণীয় ছিল একমাত্র প্রতিবাদ। আমরা চাইছিলাম ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই পথে নামুক, ফিলিস্তিনি ঝান্ডা আমরা তুলে ধরি। এবং সেই সঙ্গে আমাদের শুধু প্রতিবাদ নয়, আমাদের উদ্বেগ, আমাদের ক্ষোভ এবং আমাদের ভ্রাতৃত্বের বাণী ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে পৌঁছে দিই। ৭ এপ্রিল ঢাকাসহ সারা দেশের নানান জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। তাতে মনে মনে শান্তি পেয়েছি, অন্তত আমাদের দেশও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কিছু ঘটনায় আমাদের সেই অশান্ত হৃদয়ে তৃপ্তির জায়গাটুকু যেন তছনছ হয়ে গেল। ইহুদি মালিকানার অভিযোগ তুলে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রতিবাদী মানুষের ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, সেখানে ভাঙচুর ও কিছু স্থানে লুটপাটের ঘটনায় আমাদের প্রতিবাদটা যেন অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনে সংঘটিত ঘটনায় কিছুদিন ধরেই সারা বিশ্বে নাগরিক প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা অত্যন্ত জোরালো। কিন্তু কোথাও ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে মানুষ কখনো কখনো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, মারমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু লুণ্ঠনকে তারা একই সঙ্গে ঘৃণা করে। প্রতিবাদের ভাষা, ঘৃণার ভাষা কখনোই লুণ্ঠন হতে পারে না। এ কথাও ভাবা দরকার, ওইসব প্রতিষ্ঠান এখন শুধু ইহুদিদের নয়, বহুজাতিক কোম্পানি এবং বহুজাতিক কোম্পানি মানেই ইহুদি মালিকানা নয়। তা ছাড়া, এইসব কোম্পানিতে কর্মরত সবাই এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ। তারা দ্রুতই তাদের কাজটি হারাবে, অসহায় হয়ে পড়বে এবং আরেকটি মানবিক বিপর্যয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। মানুষ তার ন্যায্য অধিকার হারালে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নিজের অজান্তে হিংস্রতাকে বেছে নেয়। যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি ভায়োলেন্স।
এই ভায়োলেন্সকে কখনো যৌক্তিকভাবেও দেখা যায়।
যদি তার মধ্যে নৈতিক স্খলন না থাকে। যদি কোনো ধরনের আক্রোশ, কোনো নৈতিক স্খলন অথবা লুণ্ঠনের মতো কাজ চলে, তাহলে তা নিতান্তই পুরো আয়োজনকে তুচ্ছ করে তোলে।
সেদিন আমি যখন মিরপুর যাচ্ছিলাম, পথে বেশ কিছু বিক্ষোভ-মিছিল-সমাবেশ দেখে আমার ইচ্ছে করছিল আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিই। যোগ না দিলেও আমার ক্ষুব্ধ হৃদয়টি তাদের সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে যখন এইসব সংবাদ একের পর এক ইন্টারনেটে প্রকাশ পেতে শুরু করল, তখন নিজেই লজ্জিত হলাম। কারণ ইন্টারনেটের গুণে এইসব ছবি সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছাল। ফিলিস্তিন প্রশ্নে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বিষয়টি সবার কাছেই প্রচণ্ড ক্ষোভের, সেখানে সবাই প্রতিবাদ চায় এবং অবিলম্বে এই নৃশংসতার অবসান চায়। শুধু তা-ই নয়, সেই সঙ্গে ইসরায়েলের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের সমুচিত বিচারও প্রত্যাশা করছে বিশ্ববাসী। যারা ক্ষুব্ধ হয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তারা হয়তো জানেও না, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের নির্বুদ্ধিতাকে ব্যবহার করছে।
ফিরে আসি আমার সেই ফিলিস্তিনি বন্ধুটির কথায়। যেভাবে সেদিন ফিলিস্তিনের একটি আকাশচুম্বী ভবনকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হলো, সেখানে অনেক মানুষ শূন্যে উড়ছিল। শূন্যে ওড়া ওই জীবন্ত দেহগুলো কিছুক্ষণ পরেই হয়তো মৃত্যুবরণ করেছে। অবয়বগুলো বোঝা যায় না। তবে বারবার আমার সেই বন্ধুটিকে খুঁজছিলাম। আমার বন্ধুটির সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন আমাকে ফিলিস্তিনে নিয়ে যাবেন, আমরা দুজন বিভিন্ন গলির পথে অথবা পথের ধারে কোথাও বসব। একটি চায়ের দোকানে বসে একসঙ্গে চা খাব অথবা তাঁর ফিল্মের স্কুলটিতে গিয়ে সারাটা দিন কাটাব। এমনই নানান কথা হয়েছিল। হয়তো বাকি জীবনে যত দিন বেঁচে আছি সেই বন্ধুটিকে খোঁজার চেষ্টা করব। কিন্তু আমার আশঙ্কা, ঠিকানা খুঁজে খুঁজে যখন তাঁর বাড়িটির সামনে যাব, দেখব বাড়িটির কোনো চিহ্ন নেই। পড়শিদের কারও সঙ্গে দেখা হলে হয়তো আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে আর মনে মনে বলবে, ‘আপনি কি এই গ্রহের মানুষ, জানেন না এখানে কী হয়েছে?’
লেখক: মামুনুর রশীদ
নাট্যব্যক্তিত্ব
আমি বেশ কিছুদিন আগে এক ফিলিস্তিনি অভিনেতার সঙ্গে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। ওই অভিনেতা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে হলিউডেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। শুনেছি একবার অস্কারে নমিনেশনও পেয়েছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। ফিলিস্তিন নিয়ে আমাদের প্রবল কৌতূহল। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে ওই দেশের কথা জানার চেষ্টা করতাম। তিনি আবার ফিলিস্তিনেরই একটি ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা অনেকেই বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করে থাকেন। পরিচালক, চিত্রগ্রাহক সবাই সেখানে কাজ করে থাকেন। তাঁর পরিবারের গল্পও শুনতাম। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম। যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ওরা বড় হতে থাকে। মনে হতো এর মধ্যেই ওদের নিরাপদ আশ্রয় আছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে নতুন করে যে ইসরায়েলি হামলা শুরু হয়েছে, তাতে নিরাপদ আশ্রয়গুলো আর নিরাপদে নেই। বাড়িঘর, হাসপাতাল, মসজিদ, আশ্রয়শিবির, গগনচুম্বী অট্টালিকাসহ কোনো কিছুই আর ইসরায়েলের আক্রমণের বাইরে নেই।
গত কয়েক দিনে যে নিষ্ঠুরতার চরিত্র দেখেছি, তা দেখে যেকোনো সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে। মানুষ নৃশংস হয়, কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্র সন্ত্রাসী এবং নৃশংস হয়ে পড়ে, তার ভয়াবহতা আমরা ইতিহাসে যা দেখেছি, এখানে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। একবার ইরাকের শিশুদের ওপর নৃশংসতা দেখে আমার শ্বাসকষ্টের ব্যাধি হয়েছিল। এবারে সেই ব্যাধিটি সম্ভবত ফিরে এসেছে। কী করে সম্ভব! ইসরায়েলের মতো একটি ছোট রাষ্ট্র সারা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই শক্তির উৎস কী, তা আমরা সবাই জানি। শত শতবার শান্তিচুক্তিসহ নানা ধরনের চুক্তি হওয়ার পরেও ফিলিস্তিনিদের জীবনে শান্তি আসেনি। পাখির যেমন ছোট্ট একটা শান্তির আবাস থাকে, নিরাপদে পাখিরা বাসায় ঘুমায়, আনন্দে শিস দেয়, নিরাপদে খাবার খায়, ছানাদের প্রতিপালন করে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের সেইটুকু শান্তি কখনো আসেনি। ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করছে। পিতা তাঁর সন্তানের রক্তাক্ত দেহটাকে কোলে করে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন উন্মাদের মতো, একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। আর তখনই আবার আক্রান্ত হচ্ছেন ওই হতভাগ্য পিতা। এটা দু-এক দিনের অনিশ্চয়তা নয়, সুদীর্ঘ দিনের অনিশ্চয়তার এক বিশাল অভিযান।
পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রে শাসকদের পরিবর্তন হয়েছে, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি ফিলিস্তিনের হতভাগ্য নাগরিকদের ভাগ্য। মানবাধিকার, মানবিকতার রক্ষক এবং জাতিসংঘ ও তার নিরাপত্তা পরিষদ যেসব কথা বলে থাকে, সেগুলো কি শুধু কথার কথা? কোনো বাস্তব প্রয়োগ নেই! এটাই নতুন সভ্যতার হয়তো নিয়ম। ইউক্রেন জ্বলছে, সেই আগুনও নিভছে না। শাসকগোষ্ঠী নানা কীর্তি ও নানান সভায় ব্যস্ত থাকছে, কিন্তু সাধারণ নাগরিকেরা নিজের জীবন বাঁচাতে এক শরণার্থীশিবির থেকে আরেক শরণার্থীশিবিরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর মানব ইতিহাসে এত বড় নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ কখনো ভোগেনি। প্রশ্ন জাগে, আমরা কোথায় আছি? আমাদের অস্তিত্ব কোথায়?
বেশ কিছু শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের কাছাকাছিই আছে। তারা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। একি দুষ্কাল! একটি রক্তাক্ত শিশুকে দেখছিলাম, তার শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে কিন্তু শিশুটি কাঁদছে না। তার যন্ত্রণার অভিব্যক্তিটা অদ্ভুত! হয়তো শিশুটি ততক্ষণে রক্তক্ষরণেই মৃত্যুবরণ করেছে। সে জানে তার কান্না কোনো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সুসভ্য মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। আমরা একসময়ে সেই ষাটের দশকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেইসব নৃশংসতার ছবি দেখে আঁতকে উঠতাম, আবেগে বাঁধভাঙা অশ্রু আমাদের গ্রাস করত। ভিয়েতনামে মাইলাই হত্যাকাণ্ডের ছবি দেখে বা ধানের খেতের পাশে ভিয়েতনামি কোনো গেরিলার ছবি দেখে আতঙ্কিত হতাম, ঘৃণা জাগত সেইসব নৃশংস যুদ্ধাপরাধীদের দেখে। কিন্তু আজকে যা হচ্ছে সে তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে ছাপিয়ে ভিয়েতনামের নৃশংসতাকে অতিক্রম করে এক নতুন বাস্তবতায় গিয়ে ঠেকেছে। যে বাস্তবতায় মানুষের জীবন অর্থহীন। সারা পৃথিবী রক্তস্নাত হলেও জাগ্রত বিশ্ব বিবেক কিছুই করতে পারছে না। একটি রাষ্ট্র তার সব অসহায়ত্ব নিয়ে বিশ্ব বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিভক্ত মানবতা, সেই সঙ্গে অসহায় বিশ্ব বিবেক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্য শুধুই অবলোকন করছে।
কিছুদিন ধরেই এই যুদ্ধের বিভীষিকা মানবতার আর্তনাদ আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমাদের করণীয় ছিল একমাত্র প্রতিবাদ। আমরা চাইছিলাম ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই পথে নামুক, ফিলিস্তিনি ঝান্ডা আমরা তুলে ধরি। এবং সেই সঙ্গে আমাদের শুধু প্রতিবাদ নয়, আমাদের উদ্বেগ, আমাদের ক্ষোভ এবং আমাদের ভ্রাতৃত্বের বাণী ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে পৌঁছে দিই। ৭ এপ্রিল ঢাকাসহ সারা দেশের নানান জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। তাতে মনে মনে শান্তি পেয়েছি, অন্তত আমাদের দেশও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কিছু ঘটনায় আমাদের সেই অশান্ত হৃদয়ে তৃপ্তির জায়গাটুকু যেন তছনছ হয়ে গেল। ইহুদি মালিকানার অভিযোগ তুলে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রতিবাদী মানুষের ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, সেখানে ভাঙচুর ও কিছু স্থানে লুটপাটের ঘটনায় আমাদের প্রতিবাদটা যেন অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনে সংঘটিত ঘটনায় কিছুদিন ধরেই সারা বিশ্বে নাগরিক প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা অত্যন্ত জোরালো। কিন্তু কোথাও ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে মানুষ কখনো কখনো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, মারমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু লুণ্ঠনকে তারা একই সঙ্গে ঘৃণা করে। প্রতিবাদের ভাষা, ঘৃণার ভাষা কখনোই লুণ্ঠন হতে পারে না। এ কথাও ভাবা দরকার, ওইসব প্রতিষ্ঠান এখন শুধু ইহুদিদের নয়, বহুজাতিক কোম্পানি এবং বহুজাতিক কোম্পানি মানেই ইহুদি মালিকানা নয়। তা ছাড়া, এইসব কোম্পানিতে কর্মরত সবাই এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ। তারা দ্রুতই তাদের কাজটি হারাবে, অসহায় হয়ে পড়বে এবং আরেকটি মানবিক বিপর্যয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। মানুষ তার ন্যায্য অধিকার হারালে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নিজের অজান্তে হিংস্রতাকে বেছে নেয়। যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি ভায়োলেন্স।
এই ভায়োলেন্সকে কখনো যৌক্তিকভাবেও দেখা যায়।
যদি তার মধ্যে নৈতিক স্খলন না থাকে। যদি কোনো ধরনের আক্রোশ, কোনো নৈতিক স্খলন অথবা লুণ্ঠনের মতো কাজ চলে, তাহলে তা নিতান্তই পুরো আয়োজনকে তুচ্ছ করে তোলে।
সেদিন আমি যখন মিরপুর যাচ্ছিলাম, পথে বেশ কিছু বিক্ষোভ-মিছিল-সমাবেশ দেখে আমার ইচ্ছে করছিল আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিই। যোগ না দিলেও আমার ক্ষুব্ধ হৃদয়টি তাদের সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে যখন এইসব সংবাদ একের পর এক ইন্টারনেটে প্রকাশ পেতে শুরু করল, তখন নিজেই লজ্জিত হলাম। কারণ ইন্টারনেটের গুণে এইসব ছবি সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছাল। ফিলিস্তিন প্রশ্নে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বিষয়টি সবার কাছেই প্রচণ্ড ক্ষোভের, সেখানে সবাই প্রতিবাদ চায় এবং অবিলম্বে এই নৃশংসতার অবসান চায়। শুধু তা-ই নয়, সেই সঙ্গে ইসরায়েলের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের সমুচিত বিচারও প্রত্যাশা করছে বিশ্ববাসী। যারা ক্ষুব্ধ হয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তারা হয়তো জানেও না, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের নির্বুদ্ধিতাকে ব্যবহার করছে।
ফিরে আসি আমার সেই ফিলিস্তিনি বন্ধুটির কথায়। যেভাবে সেদিন ফিলিস্তিনের একটি আকাশচুম্বী ভবনকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হলো, সেখানে অনেক মানুষ শূন্যে উড়ছিল। শূন্যে ওড়া ওই জীবন্ত দেহগুলো কিছুক্ষণ পরেই হয়তো মৃত্যুবরণ করেছে। অবয়বগুলো বোঝা যায় না। তবে বারবার আমার সেই বন্ধুটিকে খুঁজছিলাম। আমার বন্ধুটির সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন আমাকে ফিলিস্তিনে নিয়ে যাবেন, আমরা দুজন বিভিন্ন গলির পথে অথবা পথের ধারে কোথাও বসব। একটি চায়ের দোকানে বসে একসঙ্গে চা খাব অথবা তাঁর ফিল্মের স্কুলটিতে গিয়ে সারাটা দিন কাটাব। এমনই নানান কথা হয়েছিল। হয়তো বাকি জীবনে যত দিন বেঁচে আছি সেই বন্ধুটিকে খোঁজার চেষ্টা করব। কিন্তু আমার আশঙ্কা, ঠিকানা খুঁজে খুঁজে যখন তাঁর বাড়িটির সামনে যাব, দেখব বাড়িটির কোনো চিহ্ন নেই। পড়শিদের কারও সঙ্গে দেখা হলে হয়তো আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে আর মনে মনে বলবে, ‘আপনি কি এই গ্রহের মানুষ, জানেন না এখানে কী হয়েছে?’
লেখক: মামুনুর রশীদ
নাট্যব্যক্তিত্ব
সূর্যোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবার যে নববর্ষের আগমন, তা রাঙিয়ে দিয়ে যাক প্রত্যেক মানুষের জীবন। বাংলা নববর্ষের উজ্জীবনী সুধায় স্নান করুক মানুষ। আশা ও আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নপূরণে সার্থক হোক পৃথিবী। গ্লানি, জ্বরা মুছে গিয়ে অগ্নিস্নানে ধরণিকে শুচি করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ...
১ দিন আগেবাংলা নববর্ষ বরণকে কেন্দ্র করে আমাদের নগরকেন্দ্রিক জীবনে উপচানো আবেগ-উচ্ছ্বাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আবেগ-উচ্ছ্বাস জাতিগত পারস্পরিক সৌহার্দ্যের নয়, সমষ্টিগতও নয়, একান্তই আত্মকেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ।
১ দিন আগেনতুন বছরে প্রবেশ করলাম আমরা। পৃথিবীব্যাপী বসবাসরত নানা জনগোষ্ঠী যেমন নতুন বছরকে উৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নেয়, তেমনি বাঙালিও নানা আনন্দ-আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। একটি নতুন আশা, উদ্দীপনা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বছরের প্রথম দিনটিতে।
১ দিন আগেআশেকা ইরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক চেয়ারপারসন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র জেন্ডার, ভূ-কৌশলগত ও আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়ে। ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে আরব বিশ্বের ভূমিকা...
২ দিন আগে