একেএম শামসুদ্দিন
জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ‘ছাত্র সংবাদ’-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রবন্ধের নাম, ‘যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি’। আহমেদ আফগানী এ প্রবন্ধের লেখক। প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’ তাঁর এই মন্তব্যটি খুবই স্পর্শকাতর ও আপত্তিজনক। এ মন্তব্য নিয়ে চারদিকে যে তীব্র সমালোচনা হয়েছে তার জবাবে লেখক ফেসবুকে যা লিখেছেন তাতে মনে হয়েছে, তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাস থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করেছেন, যা পক্ষান্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি কটাক্ষ করার শামিল। যদিও লেখক মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর নিজস্ব গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন। গবেষণায় যে ফলাফল পেয়েছেন, তার ভিত্তিতেই এ মন্তব্য করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। সাক্ষাৎকারভিত্তিক গবেষণা করতে গিয়ে এ ধরনের মন্তব্য পেয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ১৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘অতএব আমি আমার মন্তব্যের জন্য বিব্রত নই। আমার এ মন্তব্য নতুন নয়। বহু মুক্তিযোদ্ধা, বহু গবেষক, বহু বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন, তাঁরা যদি এ ইসলামবিদ্বেষ সম্পর্কে আগে বুঝতে পারতেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে জড়াতেন না।’
লেখক যে ১৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি। এসব মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতাযুদ্ধের কোন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন এবং যুদ্ধের সময় কোন সেক্টরে এবং কমান্ড স্ট্রাকচারের কোন সারিতে তাঁদের অবস্থান ছিল—এসব উল্লেখ নেই। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের বর্তমান অবস্থান এবং তাঁরা কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তিনি তা উল্লেখ করেননি। এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত লেখকের গবেষণাকর্মের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা তিনি যত যুক্তিই দেখান না কেন। এ লেখা নিয়ে চারদিকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার পরও তিনি দাবি করেন, তিনি যা বলেছেন তাই-ই সঠিক। তবে লেখক একটি কাজ খুব সচেতনভাবেই করেছেন তা হলো, এই বিতর্ক থেকে জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরকে বাইরে রাখতে লেখার সব দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গ কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার লেখা ও মন্তব্যের দায় আমার; অন্য কারও নয়। আমি মনে করি লেখাটি সঠিক। আমার লেখা কেউ ছাপাতে চাইলে আমার শর্ত থাকে যে, আমার লেখা বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে “ছাত্র সংবাদ”ও আমার লেখায় সম্পাদনা করেনি বা করতে পারেনি।’
পরবর্তী সময়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ‘ছাত্র সংবাদ’-এর সম্পাদকমণ্ডলী লেখাটি প্রত্যাহার করে নেয়। এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটার নিজস্ব ফেসবুক পেজে বলা হয়, ‘প্রবন্ধের বক্তব্যটি একান্তই লেখকের “ব্যক্তিগত মতামত” এবং এর সঙ্গে পত্রিকার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পাদকমণ্ডলীর অসতর্কতার জন্য একটি প্রবন্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কয়েকটি লাইন প্রকাশ হয়ে যায়। এই লাইনগুলো নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হওয়ায় প্রবন্ধটি পত্রিকা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো।’ অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য তারা দুঃখ প্রকাশও করে।
প্রবন্ধটি প্রত্যাহার করে নিলেও ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ‘ছাত্র সংবাদ’ তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তারা এই লেখাটিকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল’ বলে ভালো সাজার যত চেষ্টাই করুক; লেখাটি যে ইচ্ছাকৃত এবং সচেতনভাবেই প্রকাশ করেছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যেকোনো প্রকাশনায় একটি লেখা প্রকাশের আগে দায়িত্বপ্রাপ্তরা অন্যান্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি বেশ যত্নের সঙ্গে লক্ষ করে দেখেন, লেখার বিষয়বস্তু গ্রহণযোগ্য কি না। লেখার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে কি না, যেসব বিষয় বা যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে তা যথাযোগ্যভাবে খণ্ডন করা হয়েছে কি না, লেখার ভেতর এমন কোনো শব্দ বা বাক্য আছে কি না, যা সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এবং পত্রিকার আদর্শ বা নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না। তা না হলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ লেখা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। ছাত্রশিবিরের মুখপত্র ‘ছাত্র সংবাদ’ও নিশ্চয়ই এমন কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে লেখা প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু আহমেদ আফগানীর লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনার ক্ষেত্রে তারা যে যত্নবান ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। লেখাটিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন সব অযৌক্তিক এবং আপত্তিকর বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে; তা পত্রিকার লোকজনের চোখ এড়িয়ে গেছে—এ কথা কাকপক্ষীও বিশ্বাস করবে না। পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে শুধু দল ও পত্রিকার আদর্শ ও নীতিমালার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তারা আহমেদ আফগানীর এই লেখাটি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেখার বিষয়বস্তু এবং বিতর্কিত মন্তব্যটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কি না কিংবা ওই মন্তব্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে কটাক্ষ করা হয়েছে কি না, সে কথা বিবেচনা করেনি। তাদের এই আচরণ, একাত্তরে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিতর্কিত এই লেখা প্রকাশের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যে তারা মনেপ্রাণে আজও মেনে নিতে পারেনি, এটি তারই বহিঃপ্রকাশ। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক যত কৌশলই গ্রহণ করুক না কেন, সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা তাদের সে কৌশল ধরতে সক্ষম।
জামায়াতকে এ দেশে রাজনীতি করতে হলে অবশ্যই একাত্তরে তাদের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর এপ্রিলেই গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের অংশ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঘোষণা দিয়েই বসে থাকেনি তারা, দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় জামায়াত ও সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ও কর্মীদের রাজাকার, আলবদর, আলশামসে নিয়োগ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব সহযোগী বাহিনী বাঙালি গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড নেই, যাতে তারা অংশ নেয়নি। গোলাম আযম সেদিন বুঝতে পারেননি জামায়াতের এ পরিণতি হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জামায়াত-শিবিরের প্রকৃত অবস্থান ও বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলের কথা যখন উঠেছে, তখন এ প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। রাজনৈতিক ফায়দার উদ্দেশ্যে জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে যে কৌশলই গ্রহণ করুক, দেশবাসীর কাছে একাত্তরে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথা স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কোনো কাজ হবে না। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের পূর্বসূরি ইসলামী ছাত্র সংঘ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অপরাধের কথা কখনো স্বীকার করেনি। বরং একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল বলে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়। ‘একাত্তরে বাংলাদেশের কনসেপ্ট’ ছিল না বলেও দাবি করে। ইদানীং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমান জামায়াতের প্রধান বলেছেন, ‘একাত্তরে আমরা “কোনো ভুল” করে থাকলে এবং তা “যদি” সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, আমরা জাতির কাছে ক্ষমা চাইব।’
এসব ভালো কথা বলে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করলেও এযাবৎ একাত্তরের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করছে না। অথচ সাধারণ মানুষসহ শিক্ষার্থীদের সংগঠনে ভেড়াবার জন্য মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও বিভিন্ন সময়ের গণ-আন্দোলনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে জাতীয় দিবসগুলো পালনে গ্রহণ করছে নানা কৌশল।
জামায়াত-শিবির ভালো করেই জানে মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে নানা কৌশলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের দলে টানতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের নতুন সংশোধিত গঠনতন্ত্রেও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ৬৩ সংস্করণের ভূমিকায় বলা আছে, ‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে, সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের উদ্দেশে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’ গঠনতন্ত্রে শুধু সংশোধন আনলেই হবে না। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা তাদের স্বীকার করে নিতে হবে। সেদিন তারা বাঙালি জাতির সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা ও জঘন্য অপরাধ করেছিল, তা স্বীকার করে নিয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না; বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে জামায়াত-শিবির যে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রমাণও করতে হবে।
লেখক: একেএম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ‘ছাত্র সংবাদ’-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রবন্ধের নাম, ‘যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি’। আহমেদ আফগানী এ প্রবন্ধের লেখক। প্রবন্ধে লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’ তাঁর এই মন্তব্যটি খুবই স্পর্শকাতর ও আপত্তিজনক। এ মন্তব্য নিয়ে চারদিকে যে তীব্র সমালোচনা হয়েছে তার জবাবে লেখক ফেসবুকে যা লিখেছেন তাতে মনে হয়েছে, তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাস থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করেছেন, যা পক্ষান্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি কটাক্ষ করার শামিল। যদিও লেখক মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর নিজস্ব গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন। গবেষণায় যে ফলাফল পেয়েছেন, তার ভিত্তিতেই এ মন্তব্য করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। সাক্ষাৎকারভিত্তিক গবেষণা করতে গিয়ে এ ধরনের মন্তব্য পেয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ১৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘অতএব আমি আমার মন্তব্যের জন্য বিব্রত নই। আমার এ মন্তব্য নতুন নয়। বহু মুক্তিযোদ্ধা, বহু গবেষক, বহু বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন, তাঁরা যদি এ ইসলামবিদ্বেষ সম্পর্কে আগে বুঝতে পারতেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে জড়াতেন না।’
লেখক যে ১৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি। এসব মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতাযুদ্ধের কোন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন এবং যুদ্ধের সময় কোন সেক্টরে এবং কমান্ড স্ট্রাকচারের কোন সারিতে তাঁদের অবস্থান ছিল—এসব উল্লেখ নেই। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের বর্তমান অবস্থান এবং তাঁরা কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তিনি তা উল্লেখ করেননি। এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত লেখকের গবেষণাকর্মের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা তিনি যত যুক্তিই দেখান না কেন। এ লেখা নিয়ে চারদিকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার পরও তিনি দাবি করেন, তিনি যা বলেছেন তাই-ই সঠিক। তবে লেখক একটি কাজ খুব সচেতনভাবেই করেছেন তা হলো, এই বিতর্ক থেকে জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরকে বাইরে রাখতে লেখার সব দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গ কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার লেখা ও মন্তব্যের দায় আমার; অন্য কারও নয়। আমি মনে করি লেখাটি সঠিক। আমার লেখা কেউ ছাপাতে চাইলে আমার শর্ত থাকে যে, আমার লেখা বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে “ছাত্র সংবাদ”ও আমার লেখায় সম্পাদনা করেনি বা করতে পারেনি।’
পরবর্তী সময়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ‘ছাত্র সংবাদ’-এর সম্পাদকমণ্ডলী লেখাটি প্রত্যাহার করে নেয়। এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটার নিজস্ব ফেসবুক পেজে বলা হয়, ‘প্রবন্ধের বক্তব্যটি একান্তই লেখকের “ব্যক্তিগত মতামত” এবং এর সঙ্গে পত্রিকার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পাদকমণ্ডলীর অসতর্কতার জন্য একটি প্রবন্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত কয়েকটি লাইন প্রকাশ হয়ে যায়। এই লাইনগুলো নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হওয়ায় প্রবন্ধটি পত্রিকা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো।’ অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য তারা দুঃখ প্রকাশও করে।
প্রবন্ধটি প্রত্যাহার করে নিলেও ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ‘ছাত্র সংবাদ’ তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তারা এই লেখাটিকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল’ বলে ভালো সাজার যত চেষ্টাই করুক; লেখাটি যে ইচ্ছাকৃত এবং সচেতনভাবেই প্রকাশ করেছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যেকোনো প্রকাশনায় একটি লেখা প্রকাশের আগে দায়িত্বপ্রাপ্তরা অন্যান্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি বেশ যত্নের সঙ্গে লক্ষ করে দেখেন, লেখার বিষয়বস্তু গ্রহণযোগ্য কি না। লেখার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে কি না, যেসব বিষয় বা যুক্তি উত্থাপন করা হয়েছে তা যথাযোগ্যভাবে খণ্ডন করা হয়েছে কি না, লেখার ভেতর এমন কোনো শব্দ বা বাক্য আছে কি না, যা সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এবং পত্রিকার আদর্শ বা নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না। তা না হলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ লেখা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। ছাত্রশিবিরের মুখপত্র ‘ছাত্র সংবাদ’ও নিশ্চয়ই এমন কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে লেখা প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু আহমেদ আফগানীর লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনার ক্ষেত্রে তারা যে যত্নবান ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। লেখাটিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন সব অযৌক্তিক এবং আপত্তিকর বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে; তা পত্রিকার লোকজনের চোখ এড়িয়ে গেছে—এ কথা কাকপক্ষীও বিশ্বাস করবে না। পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে শুধু দল ও পত্রিকার আদর্শ ও নীতিমালার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তারা আহমেদ আফগানীর এই লেখাটি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে লেখার বিষয়বস্তু এবং বিতর্কিত মন্তব্যটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কি না কিংবা ওই মন্তব্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে কটাক্ষ করা হয়েছে কি না, সে কথা বিবেচনা করেনি। তাদের এই আচরণ, একাত্তরে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিতর্কিত এই লেখা প্রকাশের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তাদের আসল চরিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যে তারা মনেপ্রাণে আজও মেনে নিতে পারেনি, এটি তারই বহিঃপ্রকাশ। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক যত কৌশলই গ্রহণ করুক না কেন, সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা তাদের সে কৌশল ধরতে সক্ষম।
জামায়াতকে এ দেশে রাজনীতি করতে হলে অবশ্যই একাত্তরে তাদের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর এপ্রিলেই গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের অংশ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঘোষণা দিয়েই বসে থাকেনি তারা, দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় জামায়াত ও সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ও কর্মীদের রাজাকার, আলবদর, আলশামসে নিয়োগ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব সহযোগী বাহিনী বাঙালি গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড নেই, যাতে তারা অংশ নেয়নি। গোলাম আযম সেদিন বুঝতে পারেননি জামায়াতের এ পরিণতি হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জামায়াত-শিবিরের প্রকৃত অবস্থান ও বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলের কথা যখন উঠেছে, তখন এ প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। রাজনৈতিক ফায়দার উদ্দেশ্যে জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে যে কৌশলই গ্রহণ করুক, দেশবাসীর কাছে একাত্তরে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথা স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কোনো কাজ হবে না। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের পূর্বসূরি ইসলামী ছাত্র সংঘ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অপরাধের কথা কখনো স্বীকার করেনি। বরং একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল বলে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়। ‘একাত্তরে বাংলাদেশের কনসেপ্ট’ ছিল না বলেও দাবি করে। ইদানীং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমান জামায়াতের প্রধান বলেছেন, ‘একাত্তরে আমরা “কোনো ভুল” করে থাকলে এবং তা “যদি” সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, আমরা জাতির কাছে ক্ষমা চাইব।’
এসব ভালো কথা বলে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করলেও এযাবৎ একাত্তরের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করছে না। অথচ সাধারণ মানুষসহ শিক্ষার্থীদের সংগঠনে ভেড়াবার জন্য মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও বিভিন্ন সময়ের গণ-আন্দোলনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। প্রতিনিয়ত নিয়ম করে জাতীয় দিবসগুলো পালনে গ্রহণ করছে নানা কৌশল।
জামায়াত-শিবির ভালো করেই জানে মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে নানা কৌশলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের দলে টানতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের নতুন সংশোধিত গঠনতন্ত্রেও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ৬৩ সংস্করণের ভূমিকায় বলা আছে, ‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে, সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের উদ্দেশে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল।’ গঠনতন্ত্রে শুধু সংশোধন আনলেই হবে না। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা তাদের স্বীকার করে নিতে হবে। সেদিন তারা বাঙালি জাতির সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা ও জঘন্য অপরাধ করেছিল, তা স্বীকার করে নিয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না; বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে জামায়াত-শিবির যে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা প্রমাণও করতে হবে।
লেখক: একেএম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’।
২ ঘণ্টা আগেএবার সিডনির বইমেলায়ও মানুষের সমাগম কম হয়েছে। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত মেলাটিতে ছিল সামান্যসংখ্যক মানুষ। পরদিন রোববার দীর্ঘকালের মেলাটি গতবারের মতো মানুষ টানতে পারেনি। আমি যখন মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে পৌঁছাই, তখন যা দেখেছি তাতে এটা বলা চলে যে মানুষ আগের মতো আসেনি।
২ ঘণ্টা আগেকতভাবে যে লুটপাটের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন চলছে, তার হিসাব কোনো জ্যোতিষী হিসাববিজ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিও করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ২৪ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকায় ‘২০০ বছরের মাঠ কেটে পুকুর, উজাড় গাছও’ শিরোনামের খবরটি পড়লে...
২ ঘণ্টা আগেড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে তিনি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন...
১ দিন আগে