ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১০ জুলাই বিকেলে। ফল ঘোষণার পরপরই সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা—এবার ফল কেমন যেন ঠাস করে মুখে এসে আঘাত করল। গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ পয়েন্ট কম। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ৪৩ হাজার কমে এসেছে। তারও বেশি উদ্বেগজনক হলো—১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এই ফলাফল কেবল শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা, নাকি একটি ব্যর্থ নীতির চূড়ান্ত ফল?
এ বছর ফলাফলের এই বিপর্যয়ের মধ্যেই অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরাম’ এক বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ করেছে, গত ১৬ বছর ধরে সরকার পরীক্ষার ফল ‘ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে’ দেখিয়ে এসেছে। সংগঠনটির সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর অকৃতকার্যের সংখ্যা বেড়েছে, জিপিএ-৫ কমেছে—এটি প্রমাণ করে যে, অতীতে ফলাফল ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, শিক্ষকেরা ক্লাসে পাঠদান না করে দলীয় রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ ও কোচিং-বাণিজ্যে মত্ত ছিলেন। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সরকার, শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষকেরা। এমন বক্তব্য শুধু একটি অভিভাবক সংগঠনের ক্ষোভই প্রকাশ করে না, বরং তা দেশের হাজারো হতাশ অভিভাবকের অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি।
এই অভিযোগকে এক পাশে সরিয়ে রাখা সহজ, কিন্তু একেবারে এড়িয়ে যাওয়া কি সম্ভব? বাস্তবতা হলো, বিগত এক দশকে সরকার জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে ‘উন্নয়ন’ ও ‘স্মার্ট শিক্ষা’ নামক ব্র্যান্ডিং তৈরি করেছে। প্রতিটি বছর ফলাফলের দিনই মন্ত্রীদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে, ‘এই ফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষাবান্ধব নীতির ফসল।’ কিন্তু এই বছর যখন গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশে নেমে এল, তখন সেই মন্ত্রীদের মতামত নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, তাঁরা হয় জেলে অথবা পলাতক। তবে এটা ঠিক, আমরা গত ১৬ বছর ধরে একটি সাজানো ফলাফল বিশ্বাস করে এসেছি!
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে ফল বিপর্যয়ের এই বিষয়টি আমাকে পীড়া দিচ্ছে। আমি জানি, মুখস্থনির্ভর না হওয়ায় অনেক ভালো শিক্ষার্থীও এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে না। আবার, আমি দেখেছি বহু শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়, অথচ উচ্চমাধ্যমিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে টিকতে পারে না। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বৃহৎ একটি ব্যবস্থার কাঠামোগত অসুখের লক্ষণ।
এমন একটি শিক্ষা ও পরীক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, যেখানে প্রকৃত শেখার চেয়ে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যেখানে বোর্ডভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হয় শিক্ষার্থীর স্তর বিবেচনা না করে, বরং পাস-হার ঠিক রাখতে। যেখানে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন হয় কোটা পূরণ করার জন্য, যেখানে ফলাফল ঘোষণা মানে সরকারপ্রধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আরেকটি অনুষঙ্গ মাত্র।
২০২৫ সালের ফলাফলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা কমেছে ৪৩ হাজারের বেশি, শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো—সারা দেশের ১৩৪টি স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করেনি। এই সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। এতে বোঝা যায়, শিক্ষার মান বা গভীরতা বাড়েনি, বরং আগে সেটিকে কৃত্রিমভাবে উঁচু দেখানো হয়েছিল। এ বছর যখন ‘গোপন হাত’ একটু সরে গেছে, তখন প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠেছে।
শিক্ষকদের নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা কারণে কিছু ক্ষোভ জমেছে। এই ক্ষোভ অনেকাংশে যৌক্তিকও। অনেক শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না, পাঠ্যবই শেষ করেন না, বরং কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করেও মাসের পর মাস বেতন তোলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের ছায়ায় তাঁরা ‘অধরা’ হয়ে ওঠেন। অনেক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই, আবার কোথাও শিক্ষক আছে কিন্তু পাঠদানের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর কিছু শিক্ষক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত হয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, বরং নিজের নিরাপদ ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন।
শিক্ষকেরা কেন এমন হলেন, তার কার্যকারণও খুঁজে দেখা দরকার। ব্যবস্থাটাই এখন এমনভাবে তৈরি, যেখানে একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলেও মানসম্মত পাঠদান করতে পারেন না। পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়, কিন্তু প্রশিক্ষণ হয় না। সৃজনশীল প্রশ্ন আসে, কিন্তু উত্তর লেখার দক্ষতা গড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম আছে, কিন্তু ইন্টারনেট নেই বা শিক্ষক তা ব্যবহার করতে জানেন না। আবার গ্রামাঞ্চলে একজন শিক্ষক হয়তো একাই বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ধর্ম—সব পড়াচ্ছেন। এই বৈষম্য, দুর্বলতা এবং অব্যবস্থাপনা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলে, তবে দোষ দেওয়া হবে কাকে?
এবারের ফলাফল কি এই ভয়াবহ বার্তাই দিচ্ছে না যে আমরা হয়তো আমাদের আগামী প্রজন্মকে নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি? বছরের পর বছর তারা সাফল্যের ভ্রান্ত আয়নায় নিজেদের দেখেছে। ফল ভালো হওয়ায় ভাবা হয়েছিল শিক্ষার মান বেড়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো—এসব শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি, চাকরির পরীক্ষায় টিকতে পারেনি। কারণ, তারা শিখতে শেখেনি, কেবল ‘পাস’ করতে শিখেছে। আজ সেই মুখোশ সরিয়ে রাখলে দেখা যায়, প্রজন্মের হাতে কিছুই নেই—না জ্ঞান, না দক্ষতা, না আত্মবিশ্বাস।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ একটাই—রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করা। শিক্ষাব্যবস্থায় দলীয়করণ যত দিন চলবে, তত দিন ফলাফল হবে সাজানো, আর ভবিষ্যৎ হবে ধ্বংস। শিক্ষামন্ত্রী কে হবেন, কোন শিক্ষক কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, কে কোন সংগঠনের সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন—এসব বিষয় বিবেচনার বাইরে রেখে শিক্ষাকাঠামোকে পুনর্গঠন করতে হবে। সব নিয়োগে যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষককে রাজনীতির হাত থেকে বের করে পুনরায় শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিদ্যালয় হবে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র এবং শিক্ষার্থী হবে শেখার কেন্দ্রবিন্দু।
এ ছাড়া দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। বছরের পর বছর যারা ফলাফল শূন্য রাখে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় সৎ ও দক্ষ পরীক্ষক নিয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, প্রধান মাধ্যম নয়। পাঠ্যবই সহজ করতে হবে, সৃজনশীলতা বাড়াতে হবে। বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সাপোর্ট, মাসিক মূল্যায়ন এবং অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং চালু করা জরুরি।
সবচেয়ে বড় কথা—আমাদের শিক্ষা নিয়ে বক্তৃতা নয়, বরং ধৈর্যশীল এবং গভীরভাবে মানবিক কাজ দরকার। ফলাফল নিয়ে বাহবা নেওয়া নয়, বরং একজন শিক্ষার্থীর চোখে আত্মবিশ্বাস দেখতে চাওয়া উচিত। এসএসসি ২০২৫ আমাদের সামনে যে বাস্তবতা তুলে ধরেছে, তা যদি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি, তবে শুধু ফল নয়—ভবিষ্যৎও হবে শূন্য।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১০ জুলাই বিকেলে। ফল ঘোষণার পরপরই সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা—এবার ফল কেমন যেন ঠাস করে মুখে এসে আঘাত করল। গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ পয়েন্ট কম। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ৪৩ হাজার কমে এসেছে। তারও বেশি উদ্বেগজনক হলো—১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এই ফলাফল কেবল শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা, নাকি একটি ব্যর্থ নীতির চূড়ান্ত ফল?
এ বছর ফলাফলের এই বিপর্যয়ের মধ্যেই অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরাম’ এক বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ করেছে, গত ১৬ বছর ধরে সরকার পরীক্ষার ফল ‘ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে’ দেখিয়ে এসেছে। সংগঠনটির সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর অকৃতকার্যের সংখ্যা বেড়েছে, জিপিএ-৫ কমেছে—এটি প্রমাণ করে যে, অতীতে ফলাফল ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, শিক্ষকেরা ক্লাসে পাঠদান না করে দলীয় রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ ও কোচিং-বাণিজ্যে মত্ত ছিলেন। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সরকার, শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষকেরা। এমন বক্তব্য শুধু একটি অভিভাবক সংগঠনের ক্ষোভই প্রকাশ করে না, বরং তা দেশের হাজারো হতাশ অভিভাবকের অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি।
এই অভিযোগকে এক পাশে সরিয়ে রাখা সহজ, কিন্তু একেবারে এড়িয়ে যাওয়া কি সম্ভব? বাস্তবতা হলো, বিগত এক দশকে সরকার জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে ‘উন্নয়ন’ ও ‘স্মার্ট শিক্ষা’ নামক ব্র্যান্ডিং তৈরি করেছে। প্রতিটি বছর ফলাফলের দিনই মন্ত্রীদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে, ‘এই ফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষাবান্ধব নীতির ফসল।’ কিন্তু এই বছর যখন গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশে নেমে এল, তখন সেই মন্ত্রীদের মতামত নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, তাঁরা হয় জেলে অথবা পলাতক। তবে এটা ঠিক, আমরা গত ১৬ বছর ধরে একটি সাজানো ফলাফল বিশ্বাস করে এসেছি!
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে ফল বিপর্যয়ের এই বিষয়টি আমাকে পীড়া দিচ্ছে। আমি জানি, মুখস্থনির্ভর না হওয়ায় অনেক ভালো শিক্ষার্থীও এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে না। আবার, আমি দেখেছি বহু শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়, অথচ উচ্চমাধ্যমিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে টিকতে পারে না। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বৃহৎ একটি ব্যবস্থার কাঠামোগত অসুখের লক্ষণ।
এমন একটি শিক্ষা ও পরীক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, যেখানে প্রকৃত শেখার চেয়ে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যেখানে বোর্ডভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হয় শিক্ষার্থীর স্তর বিবেচনা না করে, বরং পাস-হার ঠিক রাখতে। যেখানে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন হয় কোটা পূরণ করার জন্য, যেখানে ফলাফল ঘোষণা মানে সরকারপ্রধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আরেকটি অনুষঙ্গ মাত্র।
২০২৫ সালের ফলাফলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা কমেছে ৪৩ হাজারের বেশি, শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো—সারা দেশের ১৩৪টি স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করেনি। এই সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। এতে বোঝা যায়, শিক্ষার মান বা গভীরতা বাড়েনি, বরং আগে সেটিকে কৃত্রিমভাবে উঁচু দেখানো হয়েছিল। এ বছর যখন ‘গোপন হাত’ একটু সরে গেছে, তখন প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠেছে।
শিক্ষকদের নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা কারণে কিছু ক্ষোভ জমেছে। এই ক্ষোভ অনেকাংশে যৌক্তিকও। অনেক শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না, পাঠ্যবই শেষ করেন না, বরং কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করেও মাসের পর মাস বেতন তোলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের ছায়ায় তাঁরা ‘অধরা’ হয়ে ওঠেন। অনেক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই, আবার কোথাও শিক্ষক আছে কিন্তু পাঠদানের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর কিছু শিক্ষক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত হয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, বরং নিজের নিরাপদ ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন।
শিক্ষকেরা কেন এমন হলেন, তার কার্যকারণও খুঁজে দেখা দরকার। ব্যবস্থাটাই এখন এমনভাবে তৈরি, যেখানে একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলেও মানসম্মত পাঠদান করতে পারেন না। পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়, কিন্তু প্রশিক্ষণ হয় না। সৃজনশীল প্রশ্ন আসে, কিন্তু উত্তর লেখার দক্ষতা গড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম আছে, কিন্তু ইন্টারনেট নেই বা শিক্ষক তা ব্যবহার করতে জানেন না। আবার গ্রামাঞ্চলে একজন শিক্ষক হয়তো একাই বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, ধর্ম—সব পড়াচ্ছেন। এই বৈষম্য, দুর্বলতা এবং অব্যবস্থাপনা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলে, তবে দোষ দেওয়া হবে কাকে?
এবারের ফলাফল কি এই ভয়াবহ বার্তাই দিচ্ছে না যে আমরা হয়তো আমাদের আগামী প্রজন্মকে নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি? বছরের পর বছর তারা সাফল্যের ভ্রান্ত আয়নায় নিজেদের দেখেছে। ফল ভালো হওয়ায় ভাবা হয়েছিল শিক্ষার মান বেড়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো—এসব শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি, চাকরির পরীক্ষায় টিকতে পারেনি। কারণ, তারা শিখতে শেখেনি, কেবল ‘পাস’ করতে শিখেছে। আজ সেই মুখোশ সরিয়ে রাখলে দেখা যায়, প্রজন্মের হাতে কিছুই নেই—না জ্ঞান, না দক্ষতা, না আত্মবিশ্বাস।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ একটাই—রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করা। শিক্ষাব্যবস্থায় দলীয়করণ যত দিন চলবে, তত দিন ফলাফল হবে সাজানো, আর ভবিষ্যৎ হবে ধ্বংস। শিক্ষামন্ত্রী কে হবেন, কোন শিক্ষক কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, কে কোন সংগঠনের সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন—এসব বিষয় বিবেচনার বাইরে রেখে শিক্ষাকাঠামোকে পুনর্গঠন করতে হবে। সব নিয়োগে যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষককে রাজনীতির হাত থেকে বের করে পুনরায় শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিদ্যালয় হবে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র এবং শিক্ষার্থী হবে শেখার কেন্দ্রবিন্দু।
এ ছাড়া দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। বছরের পর বছর যারা ফলাফল শূন্য রাখে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় সৎ ও দক্ষ পরীক্ষক নিয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, প্রধান মাধ্যম নয়। পাঠ্যবই সহজ করতে হবে, সৃজনশীলতা বাড়াতে হবে। বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সাপোর্ট, মাসিক মূল্যায়ন এবং অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং চালু করা জরুরি।
সবচেয়ে বড় কথা—আমাদের শিক্ষা নিয়ে বক্তৃতা নয়, বরং ধৈর্যশীল এবং গভীরভাবে মানবিক কাজ দরকার। ফলাফল নিয়ে বাহবা নেওয়া নয়, বরং একজন শিক্ষার্থীর চোখে আত্মবিশ্বাস দেখতে চাওয়া উচিত। এসএসসি ২০২৫ আমাদের সামনে যে বাস্তবতা তুলে ধরেছে, তা যদি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি, তবে শুধু ফল নয়—ভবিষ্যৎও হবে শূন্য।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতি, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিষয়ে দেশের তরুণদের ভাবনা সম্পর্কিত একটি জরিপের ফলাফল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
৭ ঘণ্টা আগেএক বছর আগে এই জুলাই মাসেই দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখে লাখে তরুণ-তরুণী রাজপথে নেমে এসেছিল।
৭ ঘণ্টা আগেবিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দখলদার, চাঁদাবাজদের স্থান বিএনপিতে হবে না। খুব ভালো কথা। দেশের সাধারণ জনগণ দখলদার ও চাঁদাবাজবিহীন রাজনৈতিক দলই চায়।
৭ ঘণ্টা আগেশিল্পের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য চলচ্চিত্র ব্যয়বহুল মাধ্যম। যখন জিরো বাজেটে কেউ ছবি বানান, তখনো ছবিটি বানাতে ন্যূনতম কয়েক হাজার টাকা লেগে যায়। কাজেই শূন্য বাজেট আসলে শূন্য নয়। এ কারণেই বড় ক্যানভাসের ছবি বানাতে গেলে লগ্নিকারক প্রয়োজন হয়। মূলধারার চলচ্চিত্রে সূত্র মেনে যাঁরা ছবি বানান...
১ দিন আগে