অনলাইন ডেস্ক
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছিল। জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়। এই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া র্যাপ গান, মিম এবং গ্রাফিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এখন এই মাধ্যমগুলোই হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে, যা নতুন শাসকদেরও জবাবদিহির মুখোমুখি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠা র্যাপ গান
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। ঢাকার রাস্তায় শিক্ষার্থীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়ন চলছে। ঠিক তখনই বাংলাদেশি র্যাপার মোহাম্মদ সেজান প্রকাশ করেন তাঁর গান ‘কথা ক’। বাংলা ভাষায় গাওয়া এই গানের একটি লাইন—‘কথা ক, দেশটা বলে স্বাধীন তাইলে খ্যাচটা কই রে’—গানটি দ্রুত তরুণদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়। একই দিনে রংপুরে আন্দোলনকারী আবু সাঈদ নিহত হন। পরে তিনিই শেখ হাসিনাকে সরানোর আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন। আবু সাঈদের মৃত্যু জনরোষ আরও বাড়িয়ে দেয়, যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেজানের ‘কথা ক’ এবং আরেক র্যাপার হান্নান হোসেন শিমুলের গাওয়া আরেকটি গান আন্দোলনের উজ্জীবনী সংগীতে পরিণত হয়। একপর্যায়ে আগস্টে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে সম্প্রতি সেজান আরও একটি র্যাপ গান প্রকাশ করেছেন, যার নাম, ‘হুদাই হুতাশে’। এই গানে তিনি এমন সব ‘চোরদের’ তুলাধোনা করেছেন, যাঁরা এখন ফুলের মালা পরছেন এবং অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন।
‘মবোপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’: মিমের বিদ্রুপাত্মক ভাষা
গত বছর শেখ হাসিনার পতনের পর যখন বাংলাদেশে মবের ঘটনা বেড়ে যায়, তখন একটি ফেসবুক মিম ভাইরাল হয়। এই মিমে বাংলাদেশ সরকারের লাল-সবুজ সিলের ভেতর দেশের মানচিত্রের জায়গায় লাঠি হাতে কয়েকজন ব্যক্তির ছবি দেখা যায়, যারা মাটিতে পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে পেটাচ্ছে। সিলের চারপাশের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ কথাটি মুছে লেখা হয়েছিল ‘মবোপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’।
এই মিম তৈরি করেছেন সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী ইমরান হোসেন। এই বিদ্রুপাত্মক মিমের মধ্য দিয়ে মূলত হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের এক অস্বস্তিকর দিক তুলে ধরা হয়েছে। ইমরান বলেন, ‘এই হতাশার কারণে আমি এই ইলাস্ট্রেশন তৈরি করেছি, যা জনরোষের শাসন এবং সরকারের দৃশ্যমান নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে একধরনের সমালোচনা। অনেকে মিমটিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। কেউ কেউ এটিকে তাঁদের প্রোফাইল ছবি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যা নীরব প্রতিবাদের একটা রূপ।’
ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশের মতো খাতে ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নেয়। তবে মবের ঘটনা সরকারের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যা নিয়ন্ত্রণে সরকার হিমশিম খেতে থাকে। এই সময় পীরের মাজার এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নারীদের ফুটবল মাঠ দখল, এমনকি সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
ইমরান হোসেন বলেন, ‘জুলাইয়ের আন্দোলনের পর আগের সরকারের সময়ে দমন-পীড়নের শিকার হওয়া কিছু গোষ্ঠী হঠাৎ অনেক ক্ষমতা পায়। কিন্তু তারা নতুন পাওয়া সেই ক্ষমতাকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার না করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে শুরু করে।’
‘নাটক কম করো পিও’: হাসিনার প্রতি বিদ্রূপ
র্যাপ গানগুলোর মতোই এ ধরনের মিমগুলোও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলার সময় জনমনের ভাব বুঝতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। গত বছরের ১৮ ও ১৯ জুলাই নিরাপত্তা বাহিনী যখন আন্দোলনকারীদের হত্যা করছিল, তখন শেখ হাসিনা এক মেট্রো স্টেশনের ক্ষতির জন্য কান্নাকাটি করেছিলেন এবং এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করেছিলেন। আর সে সময় বেশ কিছু মিম ছড়িয়ে পড়ে।
একটি ভাইরাল মিম ছিল ‘নাটক কম করো পিও’, যা জুলাইয়ের শেষ ভাগে খুবই জনপ্রিয় হয়। এই মিমটিতে হাসিনার আবেগপ্রবণ প্রকাশকে নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো স্টেশন নিয়ে হাসিনার কান্নাকাটি হোক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর তাঁর নিজের ‘প্রিয়জন হারানোর বেদনা বোঝার’ দাবি নিয়ে বিদ্রূপ করে এসব মিম তৈরি হয়।
জার্মানির কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং সামাজিক মাধ্যম কর্মী পুন্নি কবির বলেন, ‘তখন পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ঠাট্টা করে উপহাস করা ছিল কঠিন কাজ। আগে সংবাদপত্রের কার্টুনিস্টরা রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ঠাট্টা করতেন। ২০০৯ সালে হাসিনার শাসনামল শুরু হওয়ার পর থেকে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, সমালোচকদের গ্রেপ্তার ও গুম করা হতো।’
পুন্নি কবির মজার মজার রাজনৈতিক মিম তৈরি করে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাঁকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক কিছু করাটা গুরুত্বপূর্ণ বা শক্তিশালী হাতিয়ার। ভয় আর নজরদারির শাসনকে জয় করার জন্য এটা দরকার। আমরা এটা সম্ভব করেছি। আর এতে ভয়ের দেয়াল ভেঙে গেছে।’
‘যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ’: দেয়ালে আঁকা সাহসী স্লোগান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যখন শেখ হাসিনার প্রতি ভয় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, তখন আরও বেশি মানুষ নিজের কথা বলতে শুরু করে। এই সাহস শুধু অনলাইনে নয়, রাস্তাঘাটেও ছড়িয়ে পড়ে। শহরের হাজার হাজার দেয়ালে আঁকা হতে থাকে ছবি, গ্রাফিতি। লেখা হয় সাহসী স্লোগান—যেমন ‘খুনি হাসিনা’, ‘গণহত্যা বন্ধ করো’, ‘হাসিনার সময় শেষ’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, এই শিল্পকর্মগুলো আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছে। যেমন স্লোগান ছিল, ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ।’ একটা স্লোগানই অনেক কিছু বদলে দিতে পারে—এখানেও তাই হয়েছে। আলতাফ পারভেজ আরও বলেন, ‘মানুষ সাহস সঞ্চার করছিল। যখন কেউ ভয় কাটিয়ে স্লোগান, গ্রাফিতি, কার্টুন—এসব তৈরি করেছে, তখন সেগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। দাবানলের মতো করে তা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ এগুলোর মধ্য দিয়েই নিজের কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছে।’
আর এই কণ্ঠস্বর হাসিনা চলে যাওয়ার পরেও থেমে যায়নি। আজকাল শুধু সরকার নয়, সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে মিম তৈরি হচ্ছে। ইমরানের তৈরি এক মিমে দেখা যায় ‘দ্য সিম্পসনস’ কার্টুন ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে, আগে হাসিনার শাসনামলে তাঁর পরিবারকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যেভাবে স্তুতি গাওয়া হতো, এখন বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের অনুগামীরাও একইভাবে নিজেদের নেতাদের পরিবারের অবদান নিয়ে স্তুতি গাইছেন।
শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। আর খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন এক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জনপ্রিয় জেন-জি ফেসবুক পেজ ‘উইটিজেনজি’ সম্প্রতি একটি মিম প্রকাশ করে, যেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এই দল গঠন করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই।
ভবিষ্যতে প্রভাব: র্যাপ ও মিমের শক্তিশালী ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে সরাতে মিম, গ্রাফিতি, র্যাপ সংগীতের মতো যেসব মাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছিল, সেগুলো ভবিষ্যতেও রাজনীতিতে প্রভাব রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বাংলাদেশি ভূরাজনৈতিক কলাম লেখক শাফকাত রাব্বী বলেন, ‘পশ্চিমে এক্স যেটা করে, বাংলাদেশে সেটা করে মিম আর ফটোকার্ড। এগুলো খুব ছোট ও কার্যকরী রাজনৈতিক বার্তা দেয়, যা অনেক ভাইরাল হয়।’
গত বছরের জুলাইয়ে অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের আঁকা গ্রাফিতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক নোটের নকশা প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, এই শিল্পমাধ্যম রাজনৈতিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
শাফকাত রাব্বী বলেন, ‘২০২৪ সালে র্যাপ খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিল। তবে জুলাইয়ে সাড়াজাগানো র্যাপ গানগুলো যে সারা দেশে এতটা ছড়িয়ে পড়বে, তা শিল্পীরা নিজেরাও ভাবেননি।’
‘কথা ক’ গানের কথা প্রসঙ্গে র্যাপার সেজান বলেন, ‘এই কথাগুলো আমি নিজেই লিখেছিলাম। মানুষের কেমন সাড়া পাব, সেটা ভাবিনি। যা ঘটছিল, সেটা দেখে শুধু দায়িত্ববোধ থেকেই গানটা আমরা করেছিলাম।’ সেজানের মতোই র্যাপার হান্নান হোসেন শিমুলের ‘আওয়াজ উডা’ শিরোনামের গানটিও অনলাইনে, বিশেষ করে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ১৮ জুলাই গানটি মুক্তি পায় এবং মুক্তি পাওয়ার দিনেই এটি ভাইরাল হয়ে যায়। গানটির একটি লাইন ছিল, ‘একটা মারবি, দশটা পাডাম আর কয়ডারে মারবি তুই।’ শেখ হাসিনার জন্য তা-ই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়।
এই র্যাপাররা শুধু গানই করেননি, আন্দোলনেও নেমেছিলেন। হান্নান গান প্রকাশের এক সপ্তাহের মাথায় গ্রেপ্তার হন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সেজান ছাড়া পান। তিনি বলছেন, র্যাপ এখন বাংলাদেশের জনজীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল থেকে শুরু করে লাইফস্টাইল পর্যন্ত সবখানে র্যাপের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সেজান বলেন, ‘অনেকে সচেতনভাবে, আবার অনেকে না বুঝেই হিপ-হপ সংস্কৃতি গ্রহণ করছে। র্যাপের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
আরও খবর পড়ুন:
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছিল। জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়। এই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া র্যাপ গান, মিম এবং গ্রাফিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এখন এই মাধ্যমগুলোই হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে, যা নতুন শাসকদেরও জবাবদিহির মুখোমুখি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠা র্যাপ গান
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। ঢাকার রাস্তায় শিক্ষার্থীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়ন চলছে। ঠিক তখনই বাংলাদেশি র্যাপার মোহাম্মদ সেজান প্রকাশ করেন তাঁর গান ‘কথা ক’। বাংলা ভাষায় গাওয়া এই গানের একটি লাইন—‘কথা ক, দেশটা বলে স্বাধীন তাইলে খ্যাচটা কই রে’—গানটি দ্রুত তরুণদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়। একই দিনে রংপুরে আন্দোলনকারী আবু সাঈদ নিহত হন। পরে তিনিই শেখ হাসিনাকে সরানোর আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন। আবু সাঈদের মৃত্যু জনরোষ আরও বাড়িয়ে দেয়, যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেজানের ‘কথা ক’ এবং আরেক র্যাপার হান্নান হোসেন শিমুলের গাওয়া আরেকটি গান আন্দোলনের উজ্জীবনী সংগীতে পরিণত হয়। একপর্যায়ে আগস্টে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে সম্প্রতি সেজান আরও একটি র্যাপ গান প্রকাশ করেছেন, যার নাম, ‘হুদাই হুতাশে’। এই গানে তিনি এমন সব ‘চোরদের’ তুলাধোনা করেছেন, যাঁরা এখন ফুলের মালা পরছেন এবং অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন।
‘মবোপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’: মিমের বিদ্রুপাত্মক ভাষা
গত বছর শেখ হাসিনার পতনের পর যখন বাংলাদেশে মবের ঘটনা বেড়ে যায়, তখন একটি ফেসবুক মিম ভাইরাল হয়। এই মিমে বাংলাদেশ সরকারের লাল-সবুজ সিলের ভেতর দেশের মানচিত্রের জায়গায় লাঠি হাতে কয়েকজন ব্যক্তির ছবি দেখা যায়, যারা মাটিতে পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে পেটাচ্ছে। সিলের চারপাশের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ কথাটি মুছে লেখা হয়েছিল ‘মবোপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’।
এই মিম তৈরি করেছেন সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী ইমরান হোসেন। এই বিদ্রুপাত্মক মিমের মধ্য দিয়ে মূলত হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের এক অস্বস্তিকর দিক তুলে ধরা হয়েছে। ইমরান বলেন, ‘এই হতাশার কারণে আমি এই ইলাস্ট্রেশন তৈরি করেছি, যা জনরোষের শাসন এবং সরকারের দৃশ্যমান নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে একধরনের সমালোচনা। অনেকে মিমটিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। কেউ কেউ এটিকে তাঁদের প্রোফাইল ছবি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যা নীরব প্রতিবাদের একটা রূপ।’
ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশের মতো খাতে ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নেয়। তবে মবের ঘটনা সরকারের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যা নিয়ন্ত্রণে সরকার হিমশিম খেতে থাকে। এই সময় পীরের মাজার এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নারীদের ফুটবল মাঠ দখল, এমনকি সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
ইমরান হোসেন বলেন, ‘জুলাইয়ের আন্দোলনের পর আগের সরকারের সময়ে দমন-পীড়নের শিকার হওয়া কিছু গোষ্ঠী হঠাৎ অনেক ক্ষমতা পায়। কিন্তু তারা নতুন পাওয়া সেই ক্ষমতাকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার না করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে শুরু করে।’
‘নাটক কম করো পিও’: হাসিনার প্রতি বিদ্রূপ
র্যাপ গানগুলোর মতোই এ ধরনের মিমগুলোও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলার সময় জনমনের ভাব বুঝতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। গত বছরের ১৮ ও ১৯ জুলাই নিরাপত্তা বাহিনী যখন আন্দোলনকারীদের হত্যা করছিল, তখন শেখ হাসিনা এক মেট্রো স্টেশনের ক্ষতির জন্য কান্নাকাটি করেছিলেন এবং এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করেছিলেন। আর সে সময় বেশ কিছু মিম ছড়িয়ে পড়ে।
একটি ভাইরাল মিম ছিল ‘নাটক কম করো পিও’, যা জুলাইয়ের শেষ ভাগে খুবই জনপ্রিয় হয়। এই মিমটিতে হাসিনার আবেগপ্রবণ প্রকাশকে নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো স্টেশন নিয়ে হাসিনার কান্নাকাটি হোক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর তাঁর নিজের ‘প্রিয়জন হারানোর বেদনা বোঝার’ দাবি নিয়ে বিদ্রূপ করে এসব মিম তৈরি হয়।
জার্মানির কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং সামাজিক মাধ্যম কর্মী পুন্নি কবির বলেন, ‘তখন পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ঠাট্টা করে উপহাস করা ছিল কঠিন কাজ। আগে সংবাদপত্রের কার্টুনিস্টরা রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ঠাট্টা করতেন। ২০০৯ সালে হাসিনার শাসনামল শুরু হওয়ার পর থেকে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, সমালোচকদের গ্রেপ্তার ও গুম করা হতো।’
পুন্নি কবির মজার মজার রাজনৈতিক মিম তৈরি করে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাঁকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক কিছু করাটা গুরুত্বপূর্ণ বা শক্তিশালী হাতিয়ার। ভয় আর নজরদারির শাসনকে জয় করার জন্য এটা দরকার। আমরা এটা সম্ভব করেছি। আর এতে ভয়ের দেয়াল ভেঙে গেছে।’
‘যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ’: দেয়ালে আঁকা সাহসী স্লোগান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যখন শেখ হাসিনার প্রতি ভয় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে, তখন আরও বেশি মানুষ নিজের কথা বলতে শুরু করে। এই সাহস শুধু অনলাইনে নয়, রাস্তাঘাটেও ছড়িয়ে পড়ে। শহরের হাজার হাজার দেয়ালে আঁকা হতে থাকে ছবি, গ্রাফিতি। লেখা হয় সাহসী স্লোগান—যেমন ‘খুনি হাসিনা’, ‘গণহত্যা বন্ধ করো’, ‘হাসিনার সময় শেষ’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, এই শিল্পকর্মগুলো আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছে। যেমন স্লোগান ছিল, ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তুমিই বাংলাদেশ।’ একটা স্লোগানই অনেক কিছু বদলে দিতে পারে—এখানেও তাই হয়েছে। আলতাফ পারভেজ আরও বলেন, ‘মানুষ সাহস সঞ্চার করছিল। যখন কেউ ভয় কাটিয়ে স্লোগান, গ্রাফিতি, কার্টুন—এসব তৈরি করেছে, তখন সেগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। দাবানলের মতো করে তা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ এগুলোর মধ্য দিয়েই নিজের কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছে।’
আর এই কণ্ঠস্বর হাসিনা চলে যাওয়ার পরেও থেমে যায়নি। আজকাল শুধু সরকার নয়, সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে মিম তৈরি হচ্ছে। ইমরানের তৈরি এক মিমে দেখা যায় ‘দ্য সিম্পসনস’ কার্টুন ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে, আগে হাসিনার শাসনামলে তাঁর পরিবারকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যেভাবে স্তুতি গাওয়া হতো, এখন বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের অনুগামীরাও একইভাবে নিজেদের নেতাদের পরিবারের অবদান নিয়ে স্তুতি গাইছেন।
শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। আর খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন এক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জনপ্রিয় জেন-জি ফেসবুক পেজ ‘উইটিজেনজি’ সম্প্রতি একটি মিম প্রকাশ করে, যেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এই দল গঠন করেছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই।
ভবিষ্যতে প্রভাব: র্যাপ ও মিমের শক্তিশালী ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে সরাতে মিম, গ্রাফিতি, র্যাপ সংগীতের মতো যেসব মাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছিল, সেগুলো ভবিষ্যতেও রাজনীতিতে প্রভাব রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বাংলাদেশি ভূরাজনৈতিক কলাম লেখক শাফকাত রাব্বী বলেন, ‘পশ্চিমে এক্স যেটা করে, বাংলাদেশে সেটা করে মিম আর ফটোকার্ড। এগুলো খুব ছোট ও কার্যকরী রাজনৈতিক বার্তা দেয়, যা অনেক ভাইরাল হয়।’
গত বছরের জুলাইয়ে অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের আঁকা গ্রাফিতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক নোটের নকশা প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, এই শিল্পমাধ্যম রাজনৈতিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
শাফকাত রাব্বী বলেন, ‘২০২৪ সালে র্যাপ খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিল। তবে জুলাইয়ে সাড়াজাগানো র্যাপ গানগুলো যে সারা দেশে এতটা ছড়িয়ে পড়বে, তা শিল্পীরা নিজেরাও ভাবেননি।’
‘কথা ক’ গানের কথা প্রসঙ্গে র্যাপার সেজান বলেন, ‘এই কথাগুলো আমি নিজেই লিখেছিলাম। মানুষের কেমন সাড়া পাব, সেটা ভাবিনি। যা ঘটছিল, সেটা দেখে শুধু দায়িত্ববোধ থেকেই গানটা আমরা করেছিলাম।’ সেজানের মতোই র্যাপার হান্নান হোসেন শিমুলের ‘আওয়াজ উডা’ শিরোনামের গানটিও অনলাইনে, বিশেষ করে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ১৮ জুলাই গানটি মুক্তি পায় এবং মুক্তি পাওয়ার দিনেই এটি ভাইরাল হয়ে যায়। গানটির একটি লাইন ছিল, ‘একটা মারবি, দশটা পাডাম আর কয়ডারে মারবি তুই।’ শেখ হাসিনার জন্য তা-ই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়।
এই র্যাপাররা শুধু গানই করেননি, আন্দোলনেও নেমেছিলেন। হান্নান গান প্রকাশের এক সপ্তাহের মাথায় গ্রেপ্তার হন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সেজান ছাড়া পান। তিনি বলছেন, র্যাপ এখন বাংলাদেশের জনজীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল থেকে শুরু করে লাইফস্টাইল পর্যন্ত সবখানে র্যাপের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সেজান বলেন, ‘অনেকে সচেতনভাবে, আবার অনেকে না বুঝেই হিপ-হপ সংস্কৃতি গ্রহণ করছে। র্যাপের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
আরও খবর পড়ুন:
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক দীর্ঘ ও বর্ণময় অধ্যায়ের সাক্ষী মাহাথির মোহাম্মদ। গতকাল ১০ জুলাই ১০০ বছর পূর্ণ করলেন তিনি। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল এবং ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ আজও দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।
১ দিন আগেভারত-চীনের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার (২১০০ মাইল) দীর্ঘ এক সীমান্ত। তবে সীমান্তের এই দৈর্ঘ্যও সুনির্দিষ্ট নয়। সীমান্তে নদী, হ্রদ আর বরফে ঢাকা পর্বত থাকায় এই হিসাবে প্রায় সময় গরমিল দেখা যায়। আর এর প্রভাবে উত্তেজনা বেড়ে যায় দুই দেশের মধ্যে। অনেক সময় সীমান্তে পাহারারত দুই দেশের সেনারা পড়ে...
২ দিন আগেদেশ থেকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বিতাড়নের উদ্যোগের অংশ হিসেবে ভারতের নির্বাচন কমিশন ৮০ মিলিয়ন তথা ৮ কোটি মানুষকে তাদের পরিচয় নতুন করে প্রমাণ করার নির্দেশ দিয়েছে। এর ফলে, এই ৮ কোটি মানুষকে ভোট বঞ্চিত করার এবং দেশ থেকে বের করে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশ্বের কথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশটিতে।
২ দিন আগেউচ্চপ্রযুক্তির এই প্রতিযোগিতা কেবল যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বেই সীমাবদ্ধ নয়। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এখন উচ্চপ্রযুক্তি অস্ত্র কিনছে চীন থেকে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার ও সমুদ্রপথে ব্যবহারের জন্য উন্নত সেন্সর সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ অন্যতম।
৩ দিন আগে