Ajker Patrika

বদলে যাচ্ছে যুদ্ধকৌশল, উচ্চপ্রযুক্তির অস্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হয়ে উঠছে চীন

অনলাইন ডেস্ক
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

যুদ্ধের চেহারা এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। একসময় যেখানে সামরিক শক্তির পরিমাপক ছিল—সৈন্যসংখ্যা, ট্যাংক কিংবা কামান, সেখানে এখন যুদ্ধের মূল নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ড্রোন, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র, কোয়ান্টাম রাডার ও সাইবার অস্ত্র—এসবই আধুনিক যুদ্ধে টেকসই বিজয়ের চাবিকাঠি হয়ে উঠছে। এই প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই দুটি পরাশক্তির মধ্যে যে উচ্চপ্রযুক্তি-নির্ভর অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে, তা শুধু সামরিক ভারসাম্য নয়, বৈশ্বিক কূটনীতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই বিশ্বে সামরিক প্রযুক্তির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রথমবারের মতো স্টিলথ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান (এফ-১৭ নাইটহ্যাক), স্যাটেলাইটভিত্তিক জিপিএস বোমা এবং মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ড্রোন) ব্যবহার করে বিশ্বের সামরিক নীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে এফ-২২ র‍্যাপ্টর, এফ-৩৫ লাইটনিং ২, বি-২১ রেইডারের মতো যুদ্ধবিমান ও এমকিউ-৯ রিপারের মতো অ্যাটাক ড্রোন। এ ছাড়া দেশটির একটি স্বাধীন মহাকাশ সামরিক শাখা আছে ‘স্পেস ফোর্স’ নামে।

২০২৩ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ঘোষণা দেয়, তারা এজিএম-১৮৩এ এআরআরডব্লিউ নামে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের ৫ গুণ গতিতে ছুটতে পারে। এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (ডারপা-DARPA) পরিচালিত অনেক গোপন গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র এআইচালিত যুদ্ধ ব্যবস্থা, ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন (লেজার অস্ত্র) ও কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনের মতো প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এসব প্রযুক্তি শুধু যুদ্ধের ধরনই বদলে দিচ্ছে না, বরং সাইবার-নির্ভর নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ রূপরেখাও নির্ধারণ করছে।

বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সামরিক অপারেশনে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার চোখে পড়ে। আফগানিস্তান ও ইরাকে পরিচালিত ড্রোন হামলাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর’ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহ করেছে উন্নত এআই-চালিত ড্রোন এবং সাইবার নিরাপত্তা সরঞ্জাম, যা রুশ সেনাদের সামরিক কার্যক্রমে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।

চীনও গত ২০ বছরে অবিশ্বাস্য গতিতে সামরিক প্রযুক্তিতে অগ্রসর হয়েছে। চীন মূলত সোভিয়েত আমলের বিভিন্ন সমরাস্ত্রের নকল করার মধ্য দিয়ে নিজেদের সমরাস্ত্র ভান্ডার গড়ার যাত্রা শুরু করে। তবে চীন এখন নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার বানাতে সক্ষম। ২০২৫ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দেশ হিসেবে উঠে এসেছে। দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট ২২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

চীনের তৈরি জে-২০ স্টিলথ ফাইটার, ডিএফ-১৭ এবং ডিএফ-২৭ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, উইং লুং-২ এবং সিএইচ-৫ ড্রোন, টাইপ-০৫৫ ডেস্ট্রয়ার ও এআই-নির্ভর কমান্ড সিস্টেম ইতিমধ্যেই কার্যকারিতায় মার্কিন প্রযুক্তির সমপর্যায়ে চলে এসেছে। চীন ২০২৫ সালে সফলভাবে ডিএফ-২৭ হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল পরীক্ষায় সফল হয়, যেটির পাল্টা ৮ হাজার কিলোমিটারের বেশি এবং বর্তমানে যেকোনো মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়।

চীন বাইদু স্যাটেলাইট সিস্টেমের মাধ্যমে নিজস্ব জিপিএস ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা সশস্ত্র ড্রোন, রকেট ও যুদ্ধজাহাজকে আরও নিখুঁতভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চীন সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া ও আলজেরিয়ায় উইং লুং ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্রোহ দমন অভিযানে। মিয়ানমার সরকার ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিয়মিত চীনা প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহার করে। চীনের অস্ত্রের খরচ তুলনামূলক কম এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হওয়ায় বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের জন্য আকর্ষণীয়।

২০২৫ সালের মে মাসে দুই দেশের বিবদমান অঞ্চল কাশ্মীরের সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘটে যাওয়া সীমিত ও ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধকে অনেকে আধুনিক যুগের প্রযুক্তিনির্ভর ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বলেই অভিহিত করেছেন। পাকিস্তান এই সংঘর্ষে চীনের তৈরি উচ্চপ্রযুক্তির অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। জেএফ-১৭ থান্ডারব্লক-৩ যুদ্ধবিমান, পিএল-১৫ এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্রসহ এইএসএ রাডার প্রযুক্তি নিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সুখোই-৩৯ এমকেআই ও রাফালের মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। পাকিস্তানি সূত্রগুলোর দাবি, পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এবং এর রাডার এড়ানোর সক্ষমতা ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল।

এ ছাড়া, উইং লুং-২ ড্রোন ব্যবহার করে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি ও হামলার কার্যক্রম চালানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, এই ড্রোনগুলো এতটাই কম উচ্চতায় ও স্টিলথ মোডে উড়তে পারে যে রাডারে ধরা পড়ে না। ফলে পাকিস্তানের পক্ষে হঠাৎ করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে।

এর বাইরে, এইচকিউ-১৬ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং চীনা জ্যামিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাকিস্তান ভারতের ড্রোন ও নজরদারি সিস্টেমে বিঘ্ন ঘটিয়েছিল বলে কথিত আছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় রেডিও কমিউনিকেশনও ব্যাহত হয়। আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকেরা একে ‘চীনা অস্ত্রের কার্যকারিতার লাইভ ফিল্ড টেস্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

মহাকাশ ও সাইবার যুদ্ধসহ যুক্তরাষ্ট্র এখনো সামরিক প্রযুক্তিতে অনেকখানি এগিয়ে থাকলেও চীনের দ্রুত অগ্রগতি এবং নৈতিক সীমাবদ্ধতা কম হওয়ায় নতুন ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে তাদের উত্থান ঘটছে। মার্কিন অস্ত্র অনেকটাই জটিল ও ব্যয়বহুল, যেখানে চীনা অস্ত্র সহজে পরিচালনা যোগ্য ও তুলনামূলক সস্তা। এই সুবিধা চীনকে উন্নয়নশীল ও সীমিত বাজেটের দেশে অস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক এজিএম-১৩৮-এ যেখানে এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে, সেখানে চীন সফলভাবে ডিএফ-১৭ ও ডিএফ-২৭ ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে পরিচালনা করছে। তবে মার্কিন প্রযুক্তি বহুমুখী এবং সাইবার ডোমেইনে চীনের থেকে বেশ এগিয়ে। অপরদিকে চীনের অস্ত্র দ্রুত উৎপাদন এবং বিতরণে দক্ষ।

উচ্চপ্রযুক্তির এই প্রতিযোগিতা কেবল যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বেই সীমাবদ্ধ নয়। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এখন উচ্চপ্রযুক্তি অস্ত্র কিনছে চীন থেকে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার ও সমুদ্রপথে ব্যবহারের জন্য উন্নত সেন্সর সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ অন্যতম।

বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ইরান, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়াসহ বহু দেশ এখন চীনা অস্ত্র গ্রহণ করছে। কারণ, তা তুলনামূলক সস্তা, সহজে পরিচালনাযোগ্য এবং দ্রুত সরবরাহযোগ্য। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা একটি ‘অস্ত্র কূটনীতি’-তে রূপ নিয়েছে।

তবে এই প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহারের নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এআই-চালিত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, যেগুলো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু বেছে নিতে পারে, তা মানবাধিকারের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। জাতিসংঘ এখনো এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের ওপর সর্বজনীন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি উচ্চপ্রযুক্তি অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ না করা হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধ শুধু আরও ভয়ংকরই নয়, আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠবে।

উচ্চপ্রযুক্তি অস্ত্র ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা একুশ শতকের ভূরাজনীতির অন্যতম প্রধান নির্ধারক হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতা শুধু সামরিক ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং কৌশল, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও কূটনীতির জটিল মিলনবিন্দু। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে চীনা অস্ত্রের ব্যবহার, যুক্তরাষ্ট্রের এআই ও মহাকাশ প্রযুক্তির জয়যাত্রা—সবকিছুই ইঙ্গিত দেয়, আগামী যুদ্ধ হবে প্রযুক্তিনির্ভর, রোবোটিক এবং অনেক বেশি জটিল। এ প্রতিযোগিতায় যে দেশ প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকবে, তার হাতেই থাকবে ভবিষ্যতের বিশ্ব রাজনীতির রাশ।

তথ্যসূত্র: এসআইপিআরআই, দ্য ইকোনমিস্ট, মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং এইচএম ক্রিস্টেনসেন ও এম কোর্দার যৌথ গবেষণা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিদেশ ভ্রমণে ভিসা পাওয়া কঠিন হচ্ছে

পাইলট ইচ্ছে করে বিধ্বস্ত করান এয়ার ইন্ডিয়ার সেই ড্রিমলাইনার: বিশেষজ্ঞ

বিমানের কাঠমান্ডু ফ্লাইটে বোমাতঙ্ক: ছেলের পরকীয়া ঠেকাতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন মা, জানাল র‍্যাব

দিনাজপুর-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে সংঘর্ষ, আহত অন্তত ২৫

চূড়ান্ত সমঝোতা ছাড়াই শেষ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ শুল্ক আলোচনা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত