বিধান রিবেরু
শিল্পের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য চলচ্চিত্র ব্যয়বহুল মাধ্যম। যখন জিরো বাজেটে কেউ ছবি বানান, তখনো ছবিটি বানাতে ন্যূনতম কয়েক হাজার টাকা লেগে যায়। কাজেই শূন্য বাজেট আসলে শূন্য নয়। এ কারণেই বড় ক্যানভাসের ছবি বানাতে গেলে লগ্নিকারক প্রয়োজন হয়। মূলধারার চলচ্চিত্রে সূত্র মেনে যাঁরা ছবি বানান, তাঁদের জন্য প্রযোজক ও লগ্নি দুটোই প্রস্তুত থাকে, কারণ সেখানে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার কিছুটা নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। কিন্তু চলচ্চিত্র তো শুধু ব্যবসা নয়, শিল্পও বটে। কাজেই যাঁরা শিল্পচর্চা করতে চান, বাজারের শর্তকে পাশ কাটিয়ে, তাঁরা অর্থ পাবেন কোত্থেকে? এখানেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় সরকার। শিল্পসম্মত স্বাধীন চলচ্চিত্রের জন্য এটি আশীর্বাদস্বরূপ। এই আশীর্বাদের নাম অনুদান।
বাংলাদেশে প্রথম সরকারি অনুদান নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে। এরপর আরও বহু চলচ্চিত্র সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছে, কিন্তু ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’কে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে কি? বিগত বছরগুলোতে চলচ্চিত্রে অনুদান পাওয়া নিয়ে যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্ম নিতে দেখেছি আমরা, তার ব্যতিক্রম ঘটেনি এই বছরও। বরং এই বছর আরেক কাঠি সরেস। এক দিনে হয়েছে ৯৫টি ছবির পিচিং। পিচিং যাচাই করার জন্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত নন। এ ছাড়া, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটিতে থেকে বা সদ্য বিদায় নিয়ে অথবা অনুদানবিষয়ক একাধিক কমিটির একটিতে থেকে আরেকটিতে আবেদন করে লাখ লাখ টাকার অনুদান নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই অনুদান প্রাপ্তিতে আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়নি। কেন হয়নি? কারণ, আইনের ফাঁকফোকর যে সবারই মাপজোখ করা রয়েছে। সব মাপামাপি শেষে নীতিনৈতিকতা ও চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা বিষয় থাকে। সেটারই অনুপস্থিতি বিস্ময়সূচক চিহ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে।
যুক্তির খাতিরে অনেকেই বলছেন, যাঁরা অনুদান পেয়েছেন (কিংবা নিয়েছেন), তাঁরা সবাই অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোক। আমার প্রশ্ন, তাতে কী? অসততা করে শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব? আর যে শিল্প সৃষ্টির গোড়াতেই অসততা ও অনৈতিক ব্যাপার থাকে, সেটি কি আদৌ শিল্প হয়ে উঠবে? ধরলাম, সেটিও সম্ভব হলো, কায়দা-কসরত করে, প্রভাব খাটিয়ে অর্থ বাগিয়ে একটি শিল্পসম্মত কাজ হলো, কিন্তু তাতে কি সেই কাজ থেকে কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে? চলচ্চিত্রের জাতীয় পরামর্শক কমিটি বলি, আর স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্যের কমিটি বলি, পুরোটাই তো একটি বডির অন্তর্ভুক্ত। তারা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করছে। তাহলে এর অধীনে থেকে, এই মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া অনুদান তাঁরা কেমন করে নেন? বিশেষ করে তাঁরা আবার অনুদান কমিটিরই সদস্য। এটা কি নৈতিক?
যাঁরা এসব অনুদানের জন্য আবেদন করেন, তাঁদের প্রশ্ন করা উচিত: অনুদান দেওয়া হয় বলে কি আপনারা চলচ্চিত্র বানাতে এসেছেন? নাকি চলচ্চিত্র বানাবেন বলে অনুদান নিতে এসেছেন? অনুদান দেয় বলে যদি ছবি বানাতে আগ্রহী হন, তাহলে বলব অযথা টাকার শ্রাদ্ধ না করে, শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আপনার সরে যাওয়া উচিত। আর যদি চলচ্চিত্র বানাবেন বলে অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন, তাহলে আরও একটি প্রশ্ন করা উচিত: এই চলচ্চিত্র নির্মাণ কি আপনার সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার অংশ, না কোনো প্রকল্পের অংশ? যদি প্রকল্পের অংশ হয় তাহলে এই অনুদান আপনার প্রাপ্য নয়। প্রকল্প হলে আপনার যাওয়া উচিত বেসরকারি প্রযোজক ও বিনিয়োগকারীদের কাছে। কারণ, সরকারি অনুদান সে রকম ছবিকে দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব, যেসব ছবিতে বাণিজ্যিক উপাদান নেই, মুনাফা লাভের চাপ নেই এবং যেখানে শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হবে।
আমরা জানি, শিল্পসম্মত ছবি নির্মাণ যাঁরা করেন, তাঁদের লোকে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা বলে থাকেন। গোটা দুনিয়াতেই এই স্বাধীন নির্মাতারা অর্থের জন্য লড়াই করেন। তাঁদের সেই লড়াইকে সহজ করতে এবং স্বাধীন ও শিল্পমানসম্পন্ন ছবি নির্মাণকে উৎসাহিত করাই হওয়া উচিত সরকারি অনুদানের নিয়ত। কিন্তু আমাদের নিয়তি এখন গিয়ে ঠেকেছে এমন জায়গায়, যেখানে অনুদানপ্রত্যাশী হয় ক্ষমতাবান লোক থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরাও। গাছের আগা ও গোড়া সব জায়গা থেকে যদি সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা ফলফলাদি সংগ্রহ করে, তাহলে যাঁরা অর্থাভাবে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারছেন না, তাঁদের কী উপায় হবে? ক্ষমতাবান আর প্রতিষ্ঠিতদের চাপে তাঁরা তো হারিয়ে যাবেন। এতে করে মূল প্রত্যয়ের জায়গাটিই হারিয়ে ফেলবে সরকারি অনুদান। পাশাপাশি জাতিও বঞ্চিত হবে স্বাধীন ধারার, স্বতন্ত্র ও ভিন্ন কণ্ঠস্বরসংবলিত ছবি থেকে।
সাধারণত যাঁরা বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করেন তাঁরা গৎবাঁধা সূত্র থেকে বেরোতে পারেন না। তাঁরা বাইরের প্রযোজক পেলে কি, আর সরকারি অনুদান পেলে কি, তাঁরা তাঁদের ছবিটিই বানাবেন, যেটা তাঁরা কারখানায় এত দিন ধরে উৎপাদন করে আসছিলেন। আর যাঁরা প্রভাব খাটিয়ে ছবি বানাতে আসেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, অর্থাৎ তাঁরা সৃজনের আনন্দে ও শিল্পীর যন্ত্রণা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসেন না। তাঁদের কারও নাম ও যশ দরকার, কারওবা অর্থ। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। সেই ব্যতিক্রম এতই বিরল যে তা নিয়ে আলোচনা করার অর্থ নেই।
জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। সেসব দেশে স্বচ্ছতার সঙ্গে, যথাযথ পদ্ধতি মেনে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। কানাডা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কিন্তু প্রতিবছর সেসব তহবিল বরাদ্দ হওয়ার পর বাংলাদেশের মতো এত সমালোচনা হয় কি না জানা নেই। হলে জানা যেত নিশ্চয়ই। ওই সব দেশে সমালোচনার ঝড় যে ওঠে না, তার কারণ নিশ্চয়ই আছে। ওখানে ‘যে যায় লঙ্কা, সে-ই হয় রাবণ’, এই দর্শনে মানুষ বিশ্বাস করে না। আমাদের দেশের মানুষ করে। তাই দেখবেন, লাল-নীল-সাদা-কালো যে রঙের দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, একদল লোক আছে, যারা ওই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আর যারা আগে সুযোগের অভাবে সৎ ছিল, তারা সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুযোগটি কড়ায়-গণ্ডায় কাজে লাগিয়ে ফেলে। কাজেই আমাদের লোম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার দশা হয়।
তাহলে এই দুরবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? পথ একটাই, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিটি ধাপে কাজ করা। যেন সবকিছু শেষ হওয়ার পর সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় না ওঠে, সেভাবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা। কমিটিগুলোতে চলচ্চিত্র বোঝে, সে ধরনের লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে, জবাবদিহির ভেতর এনে যদি সত্যিকারের ভালো কাজ যাচাই-বাছাই করা যায়, তাহলে আমার মনে হয় সমালোচনা কমতে শুরু করবে।
আমাদের দেশে সমস্যা হলো, চলচ্চিত্র দেখে বোঝা যায় বলে, সবাই নিজেদের চলচ্চিত্র বোদ্ধা মনে করেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না, চলচ্চিত্র দেখে সহজে বোঝা যায় বলেই, সেটিকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এবং ব্যাখ্যা করার কাজটি করতে হলে চলচ্চিত্র বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করার কোনো বিকল্প নেই। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে অনুদান দেওয়ার কথা বলি, আর পুরস্কার প্রদান—সেসব পরিষদে এমন সব লোকজন উপবিষ্ট হন, যাঁদের অধিকাংশের চলচ্চিত্র জ্ঞান প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাঁরা, বিশেষ করে আমলারা, সবকিছুই বিবেচনা করেন দল ও ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে। যে চিত্রনাট্য বা ছবি ক্ষমতাসীন দলকে অস্বস্তির ভেতর ফেলতে পারে, সেই ছবির ছায়াও তাঁরা মাড়ান না।
তো এই আমলাতান্ত্রিক চলচ্চিত্র বিচারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন চলচ্চিত্রকর্মীরা দেখেছিলেন ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর, তখন যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ হচ্ছিল, এক বছর পর তার প্রতিফলন কতটুকু দেখা গেল? এক বছর আগে নয়া বন্দোবস্তের মাধ্যমে যাঁদের হাতে চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝান্ডা দেওয়া হলো, তাঁদের ভূমিকা আসলে কী? কয়েকজন তো নিজেই অনুদান বাগিয়ে নিয়েছেন, বাকিরাও নিষ্ক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে আসলে সেই পুরোনো কথাই বলতে হয়, আমাদের সংস্কার প্রয়োজন নেই, আমাদের দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মানুষের মন ও মগজে লুটেরা ও ফ্যাসিবাদী মনোবৃত্তি রেখে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। আমূল পরিবর্তন দরকার।
শিল্পের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য চলচ্চিত্র ব্যয়বহুল মাধ্যম। যখন জিরো বাজেটে কেউ ছবি বানান, তখনো ছবিটি বানাতে ন্যূনতম কয়েক হাজার টাকা লেগে যায়। কাজেই শূন্য বাজেট আসলে শূন্য নয়। এ কারণেই বড় ক্যানভাসের ছবি বানাতে গেলে লগ্নিকারক প্রয়োজন হয়। মূলধারার চলচ্চিত্রে সূত্র মেনে যাঁরা ছবি বানান, তাঁদের জন্য প্রযোজক ও লগ্নি দুটোই প্রস্তুত থাকে, কারণ সেখানে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার কিছুটা নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। কিন্তু চলচ্চিত্র তো শুধু ব্যবসা নয়, শিল্পও বটে। কাজেই যাঁরা শিল্পচর্চা করতে চান, বাজারের শর্তকে পাশ কাটিয়ে, তাঁরা অর্থ পাবেন কোত্থেকে? এখানেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় সরকার। শিল্পসম্মত স্বাধীন চলচ্চিত্রের জন্য এটি আশীর্বাদস্বরূপ। এই আশীর্বাদের নাম অনুদান।
বাংলাদেশে প্রথম সরকারি অনুদান নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে। এরপর আরও বহু চলচ্চিত্র সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছে, কিন্তু ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’কে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে কি? বিগত বছরগুলোতে চলচ্চিত্রে অনুদান পাওয়া নিয়ে যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্ম নিতে দেখেছি আমরা, তার ব্যতিক্রম ঘটেনি এই বছরও। বরং এই বছর আরেক কাঠি সরেস। এক দিনে হয়েছে ৯৫টি ছবির পিচিং। পিচিং যাচাই করার জন্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত নন। এ ছাড়া, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটিতে থেকে বা সদ্য বিদায় নিয়ে অথবা অনুদানবিষয়ক একাধিক কমিটির একটিতে থেকে আরেকটিতে আবেদন করে লাখ লাখ টাকার অনুদান নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই অনুদান প্রাপ্তিতে আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়নি। কেন হয়নি? কারণ, আইনের ফাঁকফোকর যে সবারই মাপজোখ করা রয়েছে। সব মাপামাপি শেষে নীতিনৈতিকতা ও চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা বিষয় থাকে। সেটারই অনুপস্থিতি বিস্ময়সূচক চিহ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে।
যুক্তির খাতিরে অনেকেই বলছেন, যাঁরা অনুদান পেয়েছেন (কিংবা নিয়েছেন), তাঁরা সবাই অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোক। আমার প্রশ্ন, তাতে কী? অসততা করে শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব? আর যে শিল্প সৃষ্টির গোড়াতেই অসততা ও অনৈতিক ব্যাপার থাকে, সেটি কি আদৌ শিল্প হয়ে উঠবে? ধরলাম, সেটিও সম্ভব হলো, কায়দা-কসরত করে, প্রভাব খাটিয়ে অর্থ বাগিয়ে একটি শিল্পসম্মত কাজ হলো, কিন্তু তাতে কি সেই কাজ থেকে কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে? চলচ্চিত্রের জাতীয় পরামর্শক কমিটি বলি, আর স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্যের কমিটি বলি, পুরোটাই তো একটি বডির অন্তর্ভুক্ত। তারা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করছে। তাহলে এর অধীনে থেকে, এই মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া অনুদান তাঁরা কেমন করে নেন? বিশেষ করে তাঁরা আবার অনুদান কমিটিরই সদস্য। এটা কি নৈতিক?
যাঁরা এসব অনুদানের জন্য আবেদন করেন, তাঁদের প্রশ্ন করা উচিত: অনুদান দেওয়া হয় বলে কি আপনারা চলচ্চিত্র বানাতে এসেছেন? নাকি চলচ্চিত্র বানাবেন বলে অনুদান নিতে এসেছেন? অনুদান দেয় বলে যদি ছবি বানাতে আগ্রহী হন, তাহলে বলব অযথা টাকার শ্রাদ্ধ না করে, শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আপনার সরে যাওয়া উচিত। আর যদি চলচ্চিত্র বানাবেন বলে অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন, তাহলে আরও একটি প্রশ্ন করা উচিত: এই চলচ্চিত্র নির্মাণ কি আপনার সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার অংশ, না কোনো প্রকল্পের অংশ? যদি প্রকল্পের অংশ হয় তাহলে এই অনুদান আপনার প্রাপ্য নয়। প্রকল্প হলে আপনার যাওয়া উচিত বেসরকারি প্রযোজক ও বিনিয়োগকারীদের কাছে। কারণ, সরকারি অনুদান সে রকম ছবিকে দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব, যেসব ছবিতে বাণিজ্যিক উপাদান নেই, মুনাফা লাভের চাপ নেই এবং যেখানে শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হবে।
আমরা জানি, শিল্পসম্মত ছবি নির্মাণ যাঁরা করেন, তাঁদের লোকে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা বলে থাকেন। গোটা দুনিয়াতেই এই স্বাধীন নির্মাতারা অর্থের জন্য লড়াই করেন। তাঁদের সেই লড়াইকে সহজ করতে এবং স্বাধীন ও শিল্পমানসম্পন্ন ছবি নির্মাণকে উৎসাহিত করাই হওয়া উচিত সরকারি অনুদানের নিয়ত। কিন্তু আমাদের নিয়তি এখন গিয়ে ঠেকেছে এমন জায়গায়, যেখানে অনুদানপ্রত্যাশী হয় ক্ষমতাবান লোক থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরাও। গাছের আগা ও গোড়া সব জায়গা থেকে যদি সুবিধাপ্রাপ্ত লোকেরা ফলফলাদি সংগ্রহ করে, তাহলে যাঁরা অর্থাভাবে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারছেন না, তাঁদের কী উপায় হবে? ক্ষমতাবান আর প্রতিষ্ঠিতদের চাপে তাঁরা তো হারিয়ে যাবেন। এতে করে মূল প্রত্যয়ের জায়গাটিই হারিয়ে ফেলবে সরকারি অনুদান। পাশাপাশি জাতিও বঞ্চিত হবে স্বাধীন ধারার, স্বতন্ত্র ও ভিন্ন কণ্ঠস্বরসংবলিত ছবি থেকে।
সাধারণত যাঁরা বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করেন তাঁরা গৎবাঁধা সূত্র থেকে বেরোতে পারেন না। তাঁরা বাইরের প্রযোজক পেলে কি, আর সরকারি অনুদান পেলে কি, তাঁরা তাঁদের ছবিটিই বানাবেন, যেটা তাঁরা কারখানায় এত দিন ধরে উৎপাদন করে আসছিলেন। আর যাঁরা প্রভাব খাটিয়ে ছবি বানাতে আসেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, অর্থাৎ তাঁরা সৃজনের আনন্দে ও শিল্পীর যন্ত্রণা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসেন না। তাঁদের কারও নাম ও যশ দরকার, কারওবা অর্থ। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। সেই ব্যতিক্রম এতই বিরল যে তা নিয়ে আলোচনা করার অর্থ নেই।
জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। সেসব দেশে স্বচ্ছতার সঙ্গে, যথাযথ পদ্ধতি মেনে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। কানাডা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কিন্তু প্রতিবছর সেসব তহবিল বরাদ্দ হওয়ার পর বাংলাদেশের মতো এত সমালোচনা হয় কি না জানা নেই। হলে জানা যেত নিশ্চয়ই। ওই সব দেশে সমালোচনার ঝড় যে ওঠে না, তার কারণ নিশ্চয়ই আছে। ওখানে ‘যে যায় লঙ্কা, সে-ই হয় রাবণ’, এই দর্শনে মানুষ বিশ্বাস করে না। আমাদের দেশের মানুষ করে। তাই দেখবেন, লাল-নীল-সাদা-কালো যে রঙের দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, একদল লোক আছে, যারা ওই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আর যারা আগে সুযোগের অভাবে সৎ ছিল, তারা সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুযোগটি কড়ায়-গণ্ডায় কাজে লাগিয়ে ফেলে। কাজেই আমাদের লোম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার দশা হয়।
তাহলে এই দুরবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? পথ একটাই, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিটি ধাপে কাজ করা। যেন সবকিছু শেষ হওয়ার পর সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় না ওঠে, সেভাবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা। কমিটিগুলোতে চলচ্চিত্র বোঝে, সে ধরনের লোকের সংখ্যা বাড়িয়ে, জবাবদিহির ভেতর এনে যদি সত্যিকারের ভালো কাজ যাচাই-বাছাই করা যায়, তাহলে আমার মনে হয় সমালোচনা কমতে শুরু করবে।
আমাদের দেশে সমস্যা হলো, চলচ্চিত্র দেখে বোঝা যায় বলে, সবাই নিজেদের চলচ্চিত্র বোদ্ধা মনে করেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না, চলচ্চিত্র দেখে সহজে বোঝা যায় বলেই, সেটিকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। এবং ব্যাখ্যা করার কাজটি করতে হলে চলচ্চিত্র বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করার কোনো বিকল্প নেই। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে অনুদান দেওয়ার কথা বলি, আর পুরস্কার প্রদান—সেসব পরিষদে এমন সব লোকজন উপবিষ্ট হন, যাঁদের অধিকাংশের চলচ্চিত্র জ্ঞান প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাঁরা, বিশেষ করে আমলারা, সবকিছুই বিবেচনা করেন দল ও ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে। যে চিত্রনাট্য বা ছবি ক্ষমতাসীন দলকে অস্বস্তির ভেতর ফেলতে পারে, সেই ছবির ছায়াও তাঁরা মাড়ান না।
তো এই আমলাতান্ত্রিক চলচ্চিত্র বিচারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন চলচ্চিত্রকর্মীরা দেখেছিলেন ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর, তখন যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ হচ্ছিল, এক বছর পর তার প্রতিফলন কতটুকু দেখা গেল? এক বছর আগে নয়া বন্দোবস্তের মাধ্যমে যাঁদের হাতে চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝান্ডা দেওয়া হলো, তাঁদের ভূমিকা আসলে কী? কয়েকজন তো নিজেই অনুদান বাগিয়ে নিয়েছেন, বাকিরাও নিষ্ক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে আসলে সেই পুরোনো কথাই বলতে হয়, আমাদের সংস্কার প্রয়োজন নেই, আমাদের দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মানুষের মন ও মগজে লুটেরা ও ফ্যাসিবাদী মনোবৃত্তি রেখে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। আমূল পরিবর্তন দরকার।
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতি, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিষয়ে দেশের তরুণদের ভাবনা সম্পর্কিত একটি জরিপের ফলাফল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১০ জুলাই বিকেলে। ফল ঘোষণার পরপরই সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা—এবার ফল কেমন যেন ঠাস করে মুখে এসে আঘাত করল। গড় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ পয়েন্ট কম।
১০ ঘণ্টা আগেএক বছর আগে এই জুলাই মাসেই দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখে লাখে তরুণ-তরুণী রাজপথে নেমে এসেছিল।
১০ ঘণ্টা আগেবিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দখলদার, চাঁদাবাজদের স্থান বিএনপিতে হবে না। খুব ভালো কথা। দেশের সাধারণ জনগণ দখলদার ও চাঁদাবাজবিহীন রাজনৈতিক দলই চায়।
১১ ঘণ্টা আগে