Ajker Patrika

ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব নিয়ে ইউক্রেনীয়রা আতঙ্কিত

অনলাইন ডেস্ক
যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার শুরু তিন নেতার। ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার শুরু তিন নেতার। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের দক্ষিণের নদী ডনিপ্রোতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন ওলেক্সান্ডার বেজান। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আমার কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। আমি সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠলে, সেটাই অনেক।’

ওলেক্সান্ডার ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের মালোকাটেরিনিভকা গ্রামের বাসিন্দা। রাশিয়া ও ইউক্রেন যেখানে মুখোমুখি লড়াই করছে অর্থাৎ ফ্রন্ট লাইনের মাত্র ১৫ কিলোমিটার উত্তরে এই গ্রামটি।

ওলেক্সান্ডার বলেন, আমি শেষবার ফ্রন্ট লাইনের কাছে গিয়েছিলাম ২০২৩ সালে, যখন ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছিল। সে সময় ইউক্রেনীয়রা এই যুদ্ধ জেতার স্বপ্ন দেখার সাহস করেছিল। কারণ তারা কিয়েভে জয় পেয়েছিল। অন্য জায়গায়ও অনেক এলাকা মুক্ত করেছিল। কিন্তু ১৮ মাস লড়াইয়ের পর এখন মনে হচ্ছে সেই অভিযান সফল হয়নি। রাশিয়া এখন শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ‘ফ্রন্ট লাইন’ প্রায় একই জায়গায় রয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, নদীটিও এখন আর আগের মতো নেই। শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ আমাদের অবস্থানকে রাশিয়ার দখলে থাকা ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে রেখেছে। যখন রাশিয়ার দখলে থাকা কাখোভকা বাঁধ ভেঙে যায়, তখন এই জায়গাটি বিশাল ও শুকনো জমিতে পরিণত হয়। এই শূন্য ও প্রাণহীন পরিবেশ ইউক্রেনের স্থবির পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। হোয়াইট হাউস যুদ্ধ বন্ধ করতে চায়, কিন্তু এটি ফুটবল ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজানোর মতো সহজ নয়।

ওলেক্সান্ডার বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হন, তাহলে তাঁরা ফ্রন্ট লাইনের সঠিক পাশে থাকবেন। তবে যদি ফ্রন্ট লাইন একটি সীমান্তে পরিণত হয়, তাহলে তা ভয়ংকর হবে। যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ আবার শুরু হতে পারে।

ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই শান্তি চায়, কিন্তু এখানেই তাদের মতের মিল শেষ হয়ে যায়। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি ও যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয়, রাশিয়া সম্ভবত ইউক্রেনের দখল করা ভূখণ্ড ধরে রাখবে। আর ইউক্রেন এমন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়, যা রাশিয়াকে নদী পেরিয়ে তাদের ভূখণ্ডে অগ্রসর হতে বাধা দেবে। কিন্তু এর পরিবর্তে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোতে কিয়েভের যোগদানের স্বপ্ন নাকচ করে দিয়েছেন এবং তিনি রাশিয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।

বেজান বলেন, নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটি ইউক্রেনের ভবিষ্যতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রাজনীতিবিদরা আলোচনার কথা বললেও, ইউক্রেনীয়রা এখনো যুদ্ধ করছে এবং প্রাণ দিচ্ছে।

মালোকাটেরিনিভকা গ্রামটির কবরস্থানে একজন স্থানীয় সৈনিকের শেষকৃত্যের আয়োজন করতে দেখা যায়, সেই সৈন্যের নামও ওলেক্সান্ডার। কবরস্থানটির অর্ধেক কবরই নতুন করে খোঁড়া হয়েছে।

মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো অনুষ্ঠানটি মাত্র ২৫ মিনিট চলে। যত জলদি সম্ভব শেষ করার চেষ্টা ছিল কারণ গোলাবর্ষণের ঝুঁকি রয়েছে। যখন তাঁর সহযোদ্ধারা বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিদায় জানান, তখন শোকাহত মানুষজন আতঙ্কে ঝুঁকে পড়ে ও আশ্রয় খোঁজে।

নিহত সৈন্য ওলেক্সান্ডারের বিধবা স্ত্রী নাতালিয়া বলেন, ‘আমি অস্ত্রবিরতির কোনো আশা দেখি না। তারা শুধু আমাদের ছেলেদের ফ্রন্ট লাইনে পাঠিয়েই যাচ্ছে। যদি কেবল তারা এটি শেষ করার কোনো উপায় খুঁজে পেত!’

নদীর পাশে একটি পরিত্যক্ত রেললাইন রয়েছে, যা কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা। মালোকাতেরিনিভকার বাসিন্দা ল্যুদমিলা ভলিক বলেন, ‘এটি রাশিয়ান এজেন্টদের ট্র্যাক ধ্বংস করা থেকে আটকানোর জন্য। একসময় ট্রেন এই পথ ধরে দক্ষিণে ক্রিমিয়া পর্যন্ত চলত। আমরা আশা করি এই রেলপথ আবার একদিন চালু হবে। একদিন আমরা আমাদের ক্রিমিয়ায় ফিরে যাব।’

যদিও ক্রিমিয়ার ১১ বছরের রুশ দখলদারিত্বের কারণে এটি এখন কল্পনা করাও কঠিন।

প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি জোর দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে কোনো শান্তি চুক্তি হলে তা মেনে নেবে না কিয়েভ। গতকাল বৃহস্পতিবার পশ্চিম ইউক্রেনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় জেলেনস্কি বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা আমাদের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া কোনো চুক্তি মেনে নিতে পারি না। আমি এটি আমাদের অংশীদারদের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছি। ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে কোনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনা আমরা মেনে নেব না।’

ল্যুদমিলার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁর কি মনে হয়, প্রেসিডেন্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি ভালো সমঝোতা করবেন?’

গভীর শ্বাস নিয়ে ৬৫ বছর বয়সী ল্যুদমিলা উত্তর দেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যিই ইউক্রেনে শান্তি আনতে পারেন, তবে অনেকেই তা স্বাগত জানাবে। নির্বিঘ্নে রাত কাটানো, সাইরেনের শব্দ বন্ধ হওয়া এবং সৈন্যরা ঘরে ফিরবে—বহু মানুষই এসবের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কামনা করছে।

ট্রাম্পের শান্তি চাওয়া প্রসঙ্গে জেলেনস্কি বলেন, ‘ইউক্রেনের চেয়ে বেশি শান্তির প্রত্যাশা আর কারও নেই। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে রাশিয়ার আগ্রাসন থামানো এবং একটি স্থায়ী, নির্ভরযোগ্য শান্তিপূর্ণ পরিস্থিত নিশ্চিত করার পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করছি।’

তবে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর জেলেনস্কি বলেন, ট্রাম্পের প্রথমে পুতিনের সঙ্গে কথা বলাটা ‘সুখকর ছিল না’। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা তখনই হতে পারে, যখন পুতিনকে থামানোর একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে।

এই জটিল পরিস্থিতিতে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও ইউক্রেনের বাসিন্দাদের যে কোনো স্বস্তি দ্রুতই চাপা পড়ে যাবে— প্রশ্ন উঠবে, ‘এই যুদ্ধবিরতি কত দিন টিকবে এবং কে এর নিশ্চয়তা দেবে?’ কিয়েভ এই অনিশ্চয়তাকে অবশ্য আলোচনার সুযোগ হিসেবে দেখছে। তবে রাশিয়াও ঠিক এভাবেই ভাববে, আর সেটা ইউক্রেনের জন্য বড় সমস্যার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত