Ajker Patrika

যে যুদ্ধে বারুদের গন্ধ নেই, বিনিয়োগই দেশপ্রেমিকের অস্ত্র

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ২১: ৩৯
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ৪ এপ্রিল চীনের শেয়ারবাজারে বড় ধস হয়। ছবি: এএফপি
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ৪ এপ্রিল চীনের শেয়ারবাজারে বড় ধস হয়। ছবি: এএফপি

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা কখনো ভাবেননি কাও মিনজিয়ে। কিন্তু চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য রকম এক যুদ্ধ দেশপ্রেমিক হিসেবে তাঁকে বিনিয়োগকারীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় গুয়াংডং প্রদেশের গৃহসজ্জাবিদ কাওয়ের মতো বহু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে শেয়ারবাজারে টেনে এনেছে বারুদের গন্ধবিহীন এই যুদ্ধ।

বাণিজ্যযুদ্ধ নামে এর মধ্যেই পরিচিতি পাওয়া এই যুদ্ধের শুরু হল সেদিন, যেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ববাণিজ্যের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক কাণ্ড করে বসলেন! মূলত চীনকে টার্গেট করে কয়েক ডজন দেশের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু সেটাকে গ্রহণযোগ্য করতে নাম দেন ‘পাল্টা শুল্ক’ এবং ঘোষণার দিন ২ এপ্রিলকে ‘লিবারেশন ডে’ বা মুক্তির দিন ঘোষণা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণার সেই দিনেই বাজারে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন কাও মিনজিয়ে। দেশের অর্থনীতি বাঁচানোর লড়াইয়ে শামিল হতে প্রতি মাসে দুই হাজার ইউয়ান (প্রায় ২৭৪ ডলার) চীনের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

কাও জানান, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর চীনা শেয়ারবাজারে ধস নামলে তিনি ব্রোকারেজ হাউসে নিজের অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেন। কাও বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য মুনাফা নয়। এটা আমার দেশের জন্য কিছু করা। এই বাণিজ্যযুদ্ধে প্রতিটি নাগরিকের উচিত শেষ পর্যন্ত দেশের পাশে থাকা।’

ব্যবসায়ী ও ব্রোকাররা বলছেন, জাতীয় চেতনা থেকে হাজারো বিনিয়োগকারী চীনের শেয়ারবাজার রক্ষায় এগিয়ে আসছেন। প্রধানত প্রতিরক্ষা, ভোক্তাসামগ্রী ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের মতো চীনের জাতীয় স্বার্থের জন্য উপকারী খাতগুলোতে বিনিয়োগ করছেন তাঁরা।

চীনের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সাধারণত লাভের আশায় শেয়ারবাজারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবার অন্য রকম দেশপ্রেম তাঁদের উদ্বুদ্ধ করছে। এই ‘দেশপ্রেমিক মনোভাব’ চীন সরকারের জন্য স্বস্তির। কারণ, তাঁরা বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক দূর করে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে চাইছে।

ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ৪ এপ্রিল চীনের শেয়ারবাজারে বড় ধস হয়। কিন্তু এরপর বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারে ৪৫ বিলিয়ন ইউয়ান নিট বিনিয়োগ করেছেন। আর ঘোষণার আগের ছয় কার্যদিবসে মোট ৯১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউয়ান মূলধন হারায় চীনের শেয়ারবাজার।

এর আগে ২০১৫ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর সরকারের কড়াকড়ির সময় বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এবার ট্রাম্পের চোখ ধাঁধানো শুল্কের হুমকি তাঁদের এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৭ এপ্রিল চীনের শেয়ারবাজারের সূচকে ৭ শতাংশ পতনের পর রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি করে শেয়ার কেনার অঙ্গীকার করে; শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসগুলো বাজার স্থিতিশীল রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং অনেক কোম্পানি শেয়ার কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা জানায়। গত সপ্তাহেই চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারি কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।

এপ্রিলের শুরুতে চীনের শেয়ারবাজারের সূচকের পতন হয়ে সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছানোর পর ৮ শতাংশ উঠে দাঁড়িয়েছে। আর এই মাসে দরপতন হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে মার্কিন শেয়ারবাজারে এই সময়ে ৮ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে।

ইউবিএস সিকিউরিটিজের চীনা শেয়ারবাজারবিষয়ক কৌশলবিদ মেং লেই বলেন, ‘আমরা মনে করি, চীনের এই শেয়ারবাজার এখন কৌশলগতভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেমিক বিনিয়োগগুলো বিনিয়োগকারীদের মনোবল অনেকটাই বাড়িয়েছে।’

শেয়ারবাজার যেভাবে লড়াইয়ের ক্ষেত্র

চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নিংশিয়া অঞ্চলের বিনিয়োগকারী ঝৌ লিফেং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন। এমনকি তাতে লোকসানের আশঙ্কা থাকলেও তিনি পিছু হটবেন না। পর্বতারোহী ঝৌয়ের কাছে এখন দেশপ্রেম মানে ‘শেয়ার ধরে রাখা’। তিনি জানান, ভোক্তা ও প্রতিরক্ষা খাতের শেয়ারে তাঁর ৩০ লাখ ইউয়ান বিনিয়োগ আছে। বিনিয়োগ করার মতো আরো ৭০ লাখ ইউয়ান তাঁর হাতে আছে।

রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী শু হাও বলেন, তিনিও প্রযুক্তি ও ভোক্তা খাতের শেয়ারে কয়েক মিলিয়ন ইউয়ান বিনিয়োগ করেছেন। বাণিজ্যযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের সহায়তায় দেশীয় খুচরা জায়ান্টদের নানা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে।

চীনা রপ্তানিকারকদের জন্য নানা সহায়তা ঘোষণা করেছে জেডি.কম, আলিবাবার মালিকানাধীন ফ্রেশিপ্পো, সুপার মার্কেট চেইন সিআর ভ্যানগার্ড ও ইয়ংহুই সুপারস্টোরস। শু বলেন, মানুষ এখন নানা উপায়ে দেশপ্রেম প্রকাশ করছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্র নির্বাচনেও ফুটে উঠেছে এই দেশপ্রেম। যেসব খাতে বেইজিংয়ের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্য আছে এবং শুল্কের কারণে যেসব খাতের চীনা কোম্পানি বিশ্ববাজার থেকে ছিটকে পড়ছে, সেসব খাতেই মানুষ অর্থ ঢালছে। ভোক্তা ও চিপসংশ্লিষ্ট শেয়ারগুলোর দাম বেড়েছে। পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক শেয়ারগুলোও দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সাংহাইয়ের একটি ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের ভিড়। ছবি: এএফপি
সাংহাইয়ের একটি ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের ভিড়। ছবি: এএফপি

চীনে দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকা এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ডেও (ইটিএফ) অর্থ ঢুকছে। ৭ এপ্রিলের ধসের পর থেকে চীনা ইটিএফে ২৩০ বিলিয়ন ইউয়ানের বেশি বিনিয়োগ এসেছে। এর ফলে এই খাতের আকার প্রথমবারের মতো ৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে গেছে।

বারুদের গন্ধ নেই, তবু চলছে যুদ্ধ

পেশাদার বিনিয়োগকারীরাও দেশপ্রেমের টানে নতুন করে নিজেদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিও সাজাচ্ছেন। হেজ ফান্ড ম্যানেজার ইয়াং টিংউ বলেন, তিনি নিজের পোর্টফোলিওতে বসে থাকা সব অর্থ শেয়ারবাজারে ঢেলে দিয়েছেন। কৃষি, শক্তি, আর্থিক ও প্রতিরক্ষা খাতে তিনি বিনিয়োগ করেছেন।

টংহেং ইনভেস্টমেন্টের পোর্টফোলিও ম্যানেজার ইয়াং বলেন, ‘এটা যুদ্ধ, শুধু বারুদের গন্ধ নেই। এটা শুধু আপনার পোর্টফোলিও নয়, আপনার দেশের ভবিষ্যতের ওপরও বাজি ধরা।’

শাংহাইভিত্তিক মাইনরিটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াম ঝৌ জানান, তিনি এক বিলিয়ন ডলারের পুরো পোর্টফোলিও চীনা শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন।

এই বাণিজ্যযুদ্ধ জিয়াংসু প্রদেশের শিক্ষিকা ন্যান্সি লুর মতো, অনেক চীনা বিনিয়োগকারীকে আবার ‘উগ্র দেশপ্রেমিক’ করে তুলেছে। ন্যান্সি বলেন, ‘আমার পোর্টফোলিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কিন্তু আমি পরোয়া করি না। যুক্তরাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমি সরকারের পাশে থাকব।’

তিনি বলেন, ‘আমি একটি শেয়ারও বিক্রি করব না। আমি আমার দেশের বাজার রক্ষা করব। একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হিসেবে কখনো এত গর্ব অনুভব করিনি।’ মার্কিন ব্র্যান্ড বয়কটের অংশ হিসেবে আর কখনো কফির জন্য স্টারবাকে যাবেন না বা নাইকি পরবেন না বলে ন্যান্সি লু প্রতিজ্ঞা করেন।

(১ ডলার = ৭.২৯১৭ ইউয়ান)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত