Ajker Patrika

স্বাস্থ্যসেবার ওপর হামলা কেন

ড. টেডরস আধানম ঘেব্রেইয়েসুস
স্বাস্থ্যসেবার ওপর হামলা কেন

গত বছর আফ্রিকার দেশ সুদানে ক্ষমতার লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী আধা সামরিক বাহিনীর সংঘাত রাজধানী খার্তুমকে ছিন্নভিন্ন করার পাশাপাশি অনেক সুদানি নাগরিককে নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। যুদ্ধের যে নেতিবাচক প্রভাব রাজধানীর স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার ওপর পড়েছিল, তাতে অনেক পরিবারের জন্য খার্তুম ছেড়ে যাওয়াটাকে আরও জরুরি করে তুলেছিল।

২০২৩ সালে খার্তুমে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর ওপর হামলার ফলে রাজধানীজুড়ে ওষুধের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে অনেক অসুস্থ ব্যক্তি তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো আর পায়নি। 

শুধু সুদানে নয়, বিশ্বের আরও অনেক স্থানে যেখানে সংঘাত চলছে লাখ লাখ মানুষের জন্য এটাই বাস্তবতা। গাজায় হাসপাতালগুলোর ওপর একাধিক হামলায় শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী এবং বাস্তুচ্যুত মানুষ ছিল, যারা নিরাপদ ভেবে হাসপাতালগুলোয় আশ্রয় নিয়েছিল। 

ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর (ডিআরসি) গোমা শহরে বাস্তুচ্যুত মানুষের চিকিৎসা দেওয়ার সময় ডাক্তার ও নার্সদের হত্যা করা হয়েছে। ইউক্রেনে ওখমাদিত শিশু হাসপাতালে বিমান হামলায় একজন চিকিৎসক এবং একজন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত এবং সাত শিশুসহ ১৬ জন আহত হয়। পাকিস্তানে এক বোমা হামলায় পোলিও টিকাদানকর্মীদের সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক হিসেবে আমি বারবার এ ধরনের হামলার নিন্দা জানিয়েছি এবং বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা ও সম্মান দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু আমার এই আহ্বানে কেউ খুব একটা কান দেয়নি। যদিও সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিশ্বজুড়ে আমাদের মানবিক অংশীদারদের স্বাস্থ্যসুবিধা, তাদের কর্মী, রোগী এবং অন্যান্য বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষিত থাকার কথা। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুধু ২০২৩ সালে স্বাস্থ্যসেবার ওপর ১ হাজার ৫২০টি হামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে, যাতে কমপক্ষে ৭৫০ জন রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে এবং ১ হাজার ২৫০ জন আহত হয়েছে। এ বছর এ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবার ওপর ৭০০টির বেশি হামলা হয়েছে। এই সংখ্যা ভয়ংকর, তারা সম্ভবত সমস্যার প্রকৃত স্কেলকে অবমূল্যায়ন করে।

যদিও একটি আক্রমণই অনেক বেশি, তবে কিছু জায়গায় অল্প সময়ের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেশিবার আক্রমণ হয়েছে। গাজায় গত অক্টোবরে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ৫০০ জনের বেশি চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর অনেক সহকর্মী এবং আমাদের ডব্লিউএইচও পরিবারের একজন সদস্য দিমা আলহাজসহ কমপক্ষে ২৮৭ জন সাহায্যকর্মী তাঁদের জীবন হারিয়েছেন।

ইউক্রেন, সুদান, ডিআরসি, হাইতির মতো গাজায়ও সংঘাতের পক্ষগুলো মানবিক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ও তারা যেসব মানুষকে সেবা দিচ্ছেন, তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি জনস্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট হুমকির সময়েও, যেমন বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারি এবং কঙ্গোয় ইবোলার প্রাদুর্ভাবের সময়, মানবিক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নজিরবিহীন মাত্রায় মারাত্মক আক্রমণ, শারীরিক হুমকি এবং মানসিক ভীতির সম্মুখীন হয়েছেন। 

১৯ আগস্ট যখন আমরা বিশ্ব মানবিক দিবস পালন করছি, তখন আমাদের অবশ্যই সাহায্যকর্মীদের ওপর তীব্র আক্রমণ মোকাবিলা করতে হবে। এই দিনে আমি স্বাস্থ্যকর্মীসহ মানবতাবাদীদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা, হুমকি এবং আক্রমণের নিন্দা পুনর্ব্যক্ত করছি। আমি মানবিক কর্মীদের জন্য পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সম্মিলিত দায়িত্ব এবং পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সব দেশকে আহ্বান জানাতে সহযোগী জাতিসংঘ এবং মানবিক নেতাদের সঙ্গে যোগ দিই। আমাদের অবশ্যই মানবতাবাদী বীরদের জীবন বাঁচাতে তাঁদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার ওপর আক্রমণ স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম বিতরণ ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা, যেমন টিকা, প্রসবপূর্ব যত্ন এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটায়, ফলে প্রতিরোধযোগ্য রোগেও মানুষের মৃত্যু হয় এবং দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। এমনকি একটি হাসপাতালের ওপর একক আক্রমণ অবিলম্বে গোটা দেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তা ধ্বংসাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার সব মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সেটা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পূর্ণ সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল।’

বিশ্ব মানবিক দিবসে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার ওপর তীব্র আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছি। আমাদের সহকর্মীরা যারা মানবিক পরিবেশে কাজ করে, তাদের অপরিমেয় মূল্য সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানে। সশস্ত্র সহিংসতার জন্য তারা অকারণে হারিয়ে গেলে আমরা অপরিসীম বেদনা অনুভব করি। এসব মানবতাবাদীকে সুরক্ষার মাধ্যমে, সমবেদনা এবং সংহতির নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখতে আরও মানবিক বিশ্ব গড়ার প্রতি আমরা আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। 

লেখক: ড. টেডরস আধানম ঘেব্রেইয়েসুস 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক

(আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত