Ajker Patrika

মিরপুরে ডাকাতি

তোমাদের যে কিছু করিনি, তা-ই ভাগ্য—ডাকাতির সময় দুই কিশোরীকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৩৫
প্রতীকী ছবি, এআই দিয়ে তৈরি
প্রতীকী ছবি, এআই দিয়ে তৈরি

‘জিনসপত্র যা নিয়েছি; নিলাম, কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি করবা না, তোমাদের যে কিছু করিনি, তা-ই ভাগ্য।’ রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসের একটি বাসায় ডাকাতি করে বের হয়ে যাওয়ার সময় ডাকাত দলের নেতা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট (অব.) মোহাম্মদ ফিরজো ইফতেখার বাসায় থাকা দুই কিশোরীকে এভাবে হুমকি দেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়া হোসনে আরা চম্পা।

গত ২০ জুলাই বেলা ২টার দিকে পল্লবী থানার ডিওএইচএসের ৬ নম্বর অ্যাভিনিউর ১১ নম্বর ‘সাবের অ্যান্ড ডেইজি ড্রিম’ নামের বাড়ির ষষ্ঠ তলায় তাঁর ভাড়া ফ্ল্যাটে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। বাড়িটির মালিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাবের আলী। হোসনে আরা চম্পা চার মাস ধরে ওই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। তিনি ছাড়াও ফ্ল্যাটটিতে তাঁর ছেলে অহিদুল ইসলাম অহিদ (২৪), কিশোরী মেয়ে (১৭) ও কিশোরী গৃহকর্মী থাকে। ঘটনার দিন ২০ জুলাই দুপুরে হোসনে আরা চম্পা তাঁর অসুস্থ ছেলে অহিদুল ইসলাম অহিদকে নিয়ে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে ছিলেন। বাসায় ছিল তাঁর কিশোরী মেয়ে ও গৃহকর্মী।

সূত্রমতে, ঘটনার দিন বেলা ২টার দিকে বাড়ির সামনে একটি আকাশি রঙের প্রাইভেট কার এসে থামে। ডাকাত দলের সাত থেকে আটজন সদস্য সেখানে ছিলেন। বাড়ির প্রধান ফটকে নিরাপত্তাকর্মী মাসুম আলী ও তাঁর স্ত্রী রেশমা বেগম কেউ না কেউ সারাক্ষণ থাকেন। সেদিন ফটকে ছিলেন রেশমা বেগম, আর বাড়ির ছাদে এসিমিস্ত্রিরা কাজ করায় সেখানে ছিলেন নিরাপত্তাকর্মী মাসুম আলী।

রেশমা বেগম আজকের পত্রিকা বলেন, গেটটি খোলাই ছিল, কয়েকজন (পাঁচজন) লোক দ্রুত ওপরে চলে যান, তাঁরা কিছু জানতেই চাইলেন না।

নিরাপত্তাকর্মী মাসুম আলী বলেন, ‘বাড়ির বাইরে একটি গাড়ি থাকায় গেট খোলা ছিল। ডাকাতেরা কিছু না বলেই ওপরে চলে যায়। আমি ছাদে ছিলাম, ছাদ থেকে কিছুক্ষণ পর নিচে নেমে স্ত্রীর কাছে জানতে পারি, ওপরে পাঁচজন লোক গিয়েছে, আমি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যাই, গিয়ে দেখতে পারি, ভাড়াটিয়ার মেয়ে ও গৃহকর্মী কাঁপছে আর কান্না করছে। তারা জানায়, সব নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন।’

তিনি সেদিন পুরো ফ্ল্যাটে তছনছ অবস্থায় দেখতে পেয়ে দৌড়ে নিচে নামেন। সবাইকে ঘটনাটি বলেন। তবে অনেকেই ভেবেছিলেন এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তল্লাশি। মাত্র ১৫ মিনিটে ডাকাতি শেষ করে চলে যায় ডাকাতেরা।

এদিকে ডাকাতেরা ডাকাতি করে চলে যাওয়ার সময় একটি অপরিচিত নম্বর থেকে হোসনে আরা চম্পাকে ফোন করে বলা হয়, ‘আপনি কোথায় আছেন? আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন, আমরা সরকারি লোক। আপনার বাসা ডিজিএফআই ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তল্লাশি করবে।’ এই বলে ফোনটি কেটে দেন।

হোসনে আরা চম্পা পরে ওই নম্বরে আবার কল দেন। তিনি জানতে চান, কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট আছে কি না, অপরিচিত ব্যক্তি বলেন, বাসায় এলেই জানতে পারবেন।

বিষয়টি হোসনে আরা চম্পার সন্দেহ হলে তিনি মোবাইল নম্বরটি ডিওএইচএসের সেনা কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দেন। পাশাপাশি ধানমন্ডি থেকে তিনি বাসায় আসেন। বাসায় এসে দেখতে পান, তাঁর পুরো ঘর এলোমেলো। ঘর থেকে গয়না, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, প্রসাধনীসহ দামি সব জিনিস নিয়ে গেছে।

হোসনে আরা চম্পার কাছ থেকে খবর পেয়ে ডিওএইচএসের নিরাপত্তায় থাকা সেনাসদস্যরা প্রাইভেট কারসহ চারজনকে আটক করেন। অন্যরা পালিয়ে যান। আটক ব্যক্তিদের পরে পল্লবী থানায় হস্তান্তর করা হয়। এই ঘটনায় হোসনে আরা চম্পা বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন।

সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় লেফটেন্যান্ট (অব.) মোহাম্মদ ফিরজো ইফতেখার, সাবেক করপোরাল মুকুল হোসেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হারুন অর রশীদ ওরফে রাকিব হাওলাদার ও প্রাইভেট কার-চালক মোন্তাছির আহম্মেদ মাসুমকে। বর্তমানে সাত দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন তাঁরা। তাঁরা ছাড়াও এই চক্রের আরও পলাতক দুজনকে খুঁজছে পুলিশ। তাঁরাও একটি বাহিনীর সাবেক সদস্য। মামলাটি তদন্ত করছেন পল্লবী থানার এসআই মাসুদুর রহমান।

হারুনের বিরুদ্ধে মাদক ও চুরি ডাকাতিরও তিনটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া অন্য সদস্যরাও একাধিক ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত গাড়ি থেকে ইয়াবাও উদ্ধার করেছে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডাকাত দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট (অব.) মোহাম্মদ ফিরজো ইফতেখার। সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করেন সাবেক করপোরাল মুকুল হোসেন। তাঁদের ডাকাতির জন্য বাড়ি ঠিক করে দিতেন রাকিব হাওলাদার। এরপর দলের সদস্যদের নিয়ে ফিরজো ইফতেখার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তল্লাশির নামে বাড়িতে গিয়ে ডাকাতি করতেন। দলটিতে অবসর ও চাকরিচ্যুত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।

সোর্স রাকিব হাওলাদারের সঙ্গে হোসনে আরা চম্পার ছেলে অহিদের সঙ্গে মিরপুর ১০ নম্বরে পরিচয় হয়। এরপর একদিন তিনি (রাকিব) বাসার নিচে এসেছিলেন। বাসার পুরো তথ্য তাঁর কাছে ছিল। এর কয়েক মাস পর তাঁরা ডাকাতি করতে আসেন। ডাকাতির সময় চক্রটি দুই কিশোরীকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ছবিও তোলে।

হোসনে আরা চম্পা ডাকাতির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ডাকাতেরা ফ্ল্যাটে কলিং বেল দেয়, গৃহকর্মী দরজা খুলে বলতে চেয়েছিল, কেউ নেই বাসায়। এর মধ্যেই ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা গৃহকর্মী ও তাঁর মেয়েকে একটি কক্ষে যেতে বলে, সব চাবি দিতে বলে। এরপর তারা লুটতরাজ চালায়। তারা অস্ত্র ও মাদক খোঁজার কথা বলে সব নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় দুই মেয়েকে, কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি না করতে হুমকি দিয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ইফতেখার বলেন, ‘যা নিলাম নিয়েছি, তোমাদের যে কোনো ক্ষতি করিনি, তা-ই ভাগ্য।’

সেদিনের ঘটনা নিয়ে বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাবের আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঘটনাটি যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটা কেবল ডাকাতির ঘটনাই।

মামলার তদন্তের বিষয়ে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিছু মালামাল উদ্ধার হয়েছে, আরও কিছু উদ্ধারে অন্যদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোমাদের যে কিছু করিনি, তা-ই ভাগ্য—ডাকাতির সময় দুই কিশোরীকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা

সাধুর বেশে এসে সাবেক স্ত্রীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা

বরিশাল-১: স্বপন-কুদ্দুসের দ্বন্দ্বে নির্বাচনের আগে দলে অস্থিরতা

স্টার্টআপ থেকে স্মার্ট সিটি: যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ টানছে বাংলাদেশ

গাজীপুরে ইট দিয়ে সাংবাদিকের পা থেঁতলে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত