কামরুল হাসান
ভারি মিষ্টি মুখের এক তরুণী এসেছেন তাঁরই বয়সী এক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে। অনেকক্ষণ বসে আছেন অভ্যর্থনার সামনে। একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে চান। সহকর্মী মর্জিনা বেগম এইটুকু বলে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তরুণ-তরুণীর কথাটা শুনি।
হাতে জরুরি কাজ ছিল। সেটা শেষ করে গেলাম মিনিট বিশেক পরে। দেখি অনেকগুলো কাগজ হাতে দুজনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। মনে হলো আমাকে দেখে হালে পানি পেলেন। ছেলেটি বেশ ঋজু আর মেয়েটি সপ্রতিভ। যা বলার মেয়েটিই বলবেন। কথা শুরুর আগে মেয়েটি বললেন, ‘আমার ঘটনাটা অনেক লম্বা। একটু বেশি সময় দিতে হবে।’ বললাম, আচ্ছা বলুন।
মেয়েটা বলে চলেন একেবারে খুঁটিনাটি ধরে ধরে। তার পরও কোথাও একটু ছেদ পড়লে ছেলেটা ধরিয়ে দেন। ছেলেটা কখনো দোহারি করলে মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে বলেন…দাঁড়াও আমি সব বলছি। আমি তাঁদের আর থামাতে পারি না, যেন তুফানমেইল। সবই শুনতে হয়। শেষ করি পাক্কা দেড় ঘণ্টায়। এটা ২০০৬ সালের জুন-জুলাইয়ের কথা।
মেয়েটির নাম সুবর্না—সুবর্না সরকার। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন। বাবা নেই, মা একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কাকরাইলের একটি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে। সেখানে পরিচয় হয় একই ক্লাসে পড়া খ্রিষ্টান যুবক এলিন ববির সঙ্গে। প্রথমে সহপাঠী হলেও পরে দুজনকে দুজনের ভালো লেগে যায়। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। দ্বিতীয় বর্ষে উঠে ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ হঠাৎ করে দুজনে আদালতে গিয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেলেন।
প্রথম কিছুদিন সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মাস তিনেক পরে মেয়ের চলাফেরা দেখে সুবর্নার মায়ের সন্দেহ হয়। তিনি মেয়েকে জেরা করতে শুরু করেন। সুবর্না সবকিছু আড়াল করে কিছুদিন কাটিয়ে দেন। সুবর্নার ভয়, হিন্দু মেয়ের সঙ্গে খ্রিষ্টান ছেলের বিয়ে মা কিছুতেই মেনে নেবেন না। দুজনে সিদ্ধান্ত নেন একসঙ্গে থাকার। একদিন বিয়ের অ্যাফিডেভিটের কপি বাড়িতে রেখে চুপচাপ ববির বাড়িতে চলে আসেন সুবর্না। প্রথমে ওঠেন ববিদের আরামবাগের বাড়িতে। কিন্তু ববির মা সুবর্নাকে দেখে ভয় পেয়ে যান। কোনো বিপদ হতে পারে ভেবে বাড্ডায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছেলে ও ছেলের বউকে পাঠিয়ে দেন।
সুবর্নার মা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মেয়ের বিয়ের কাগজ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে মেয়েকে ফোন দেন। টেলিফোনে অনেক কান্নাকাটি করেন। মেয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করেন। সুবর্না ধরে নেন, মেয়ের এই অবাধ্যপনাটা মেনে নিয়েছেন মা।
এভাবে কয়েক দিন যায়। দুই সপ্তাহ পর সুবর্নাকে আবার ফোন করেন তাঁর মা। তিনি মতিঝিলে আসতে বলেন জরুরি কিছু কাগজপত্র নিতে। সুবর্না তাঁর স্বামী ববিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর যে পরিস্থিতির মুখে পড়েন, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তাঁরা। মতিঝিল অগ্রণী ব্যাংকের একটি গলির মুখে যাওয়ার পর ৩০-৪০ জন তাঁদের ঘিরে ধরেন। তাঁরা সুবর্নাকে একদিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর অপহরণকারী বলে ববিকে গণপিটুনি দিতে শুরু করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল অপহরণকারী সাজিয়ে গণপিটুনি দিয়ে ববিকে মেরে ফেলা। সুবর্না এটা বুঝতে পেরে দৌড়ে গিয়ে ববিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকেন। একদিকে ভাড়াটে দুর্বৃত্তরা ববিকে টানছেন, অন্যদিকে সুবর্না তাঁকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছেন।
মুহূর্তে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য এগিয়ে আসেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সুবর্নার মায়ের লোকেরা সরে পড়েন। সে যাত্রায় ববিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান সুবর্না।
মাস তিনেক পর আবার মায়ের ফোন। এবার একেবারে নরম সুর। আগে যা হয়েছে সব ভুলে যেতে বলেন। মেয়েকে তাঁর কর্মস্থলে ডেকে নেন ব্যাংকে ঋণের কিছু কাগজে সই দিতে হবে বলে। সুবর্না মায়ের কথা শুনে সই করে চলে আসেন। কয়েক দিন পর আবার মায়ের ফোন। এবার আবদার, মায়ের বাড়িতে কয়েক দিন কাটাতে হবে। রাজি হন সুবর্না। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দেখেন পরিস্থিতি অন্য রকম। মায়ের বাড়ির একটি ঘরে তাঁকে আটকে ফেলা হয়, তাঁর ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়।
ঋণের কাগজে সই দেওয়ার কথা বলে সুবর্না যে কাগজে সই দিয়েছিলেন, তা দিয়ে ডিভোর্সের কাগজ তৈরি করা হয়। একদিন রাতে সুবর্নাকে জোর করে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিকগঞ্জে সুবর্নার খালাতো বোনের বাড়িতে। সেখানেও বন্দিদশা। সবাই নিয়ম করে তাঁকে পাহারা দিতে থাকেন, যাতে পালাতে না পারেন। সেই বাড়িতে থাকার সময় সুবর্না জানতে পারেন ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে তাঁকে রোগী সাজিয়ে ভারতে পাঠানো হবে। এ জন্য তাঁকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে। ভারতে পাঠানোর সব বন্দোবস্ত পাকা—এ কথা কানে আসামাত্র প্রাণপণে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে ভুল বাসে উঠে চলে যান পাটুরিয়া ঘাটে। সেখান থেকে ফোন করলে ববি তাঁকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন।
কয়েক দিন পর ববিদের আরামবাগের বাড়িতে পুলিশ আসে। অভিযোগ, সুবর্নাকে অপহরণ করার অভিযোগে ববি, তাঁর মাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সুবর্নার মা সেই মামলা করেছেন। পুলিশ ববিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। সুবর্নাও স্বামীর সঙ্গে থানায় চলে যান। পুলিশ তাঁকে চাপ দিতে থাকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুবর্না অটল। পরে পুলিশ ভিকটিম হিসেবে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করে।
আদালত ববিকে কারাগারে আর সুবর্নাকে নিরাপদ হেফাজতে পাঠান। ৯ দিন পর জামিনে বেরিয়ে আসেন ববি। সুবর্নাকে নিরাপদ হেফাজতে কাটাতে হয় ২১ দিন। এর মধ্যে নিরাপদ হেফাজতে মায়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁদের কথায় রাজি না হলে তাঁরা ববিকে মেরে ফেলবেন। এই হুমকিতেও টলেননি তিনি। এরপর সুবর্নাকে আদালতে নেওয়া হলে নিজেই আদালতে বলেন, তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকতে চান। এরপর আদালত তাঁকে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেন।
এভাবে মাস তিনেক চলে যায়। হঠাৎ একদিন আদালতে হাজিরা দিতে গেলে জামিন বাতিল করে ববিকে কারাগারে পাঠান আদালত। তিন মাস কয়েদ খেটে বেরিয়ে আসেন ববি।
সুবর্নার ঘণ্টা দেড়েকের নিখুঁত বিবরণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি। মনে হয় কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। মেয়েটির দিকে তাকালে বিস্ময় লাগে। তাঁর দাবি, তাঁকে নিয়ে যেন একটা নিউজ করি। সুবর্নার দাবি মেনে একটি খবর প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয়। তাতে অবশ্য কিছুটা লাভ হয় তরুণ দম্পতির। তাঁরা বিচারক ও আইনজীবীদের সহানুভূতি পান।
এর পর থেকে ববি-সুবর্না প্রায়ই ফোন করেন। নানা সুখ-দুঃখের কথা জানান। একদিন প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার খবরও দেন ববি। বাচ্চা প্রসবের জন্য মগবাজারের আদ্-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি হন সুবর্না। তবু বিপদ তাঁদের পিছু ছাড়ে না। প্রথম বাচ্চা জন্মের পরদিন দুপুরে হঠাৎ সুবর্নার ফোন। কান্নাকাটি করে বলছেন, ‘ভাই, এবার র্যাব এসেছে। ববিকে তুলে নিয়ে যেতে চায়।’ হাসপাতালে এক দিনের সন্তান ফেলে স্বামীকে বাঁচাতে র্যাবের মুখোমুখি দাঁড়ান সুবর্না। তারা সুবর্নার কাছে হার মেনে ফিরে যায়।
মামলা চলতেই থাকে। প্রথম সন্তান জন্মের পাঁচ দিনের মাথায় মামলায় হাজিরার দিন। পাঁচ দিনের সন্তান কোলে নিয়ে আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী অপহরণের মামলার হাজিরা দিতে যান সুবর্না। বিচারক সব দেখে নীরব থাকেন। এভাবে মামলা চলে। বিচারক যান বিচারক আসেন, কিন্তু মামলা আর শেষ হয় না। দুই সন্তানের মা হন সুবর্না। একদিন দুই সন্তান সঙ্গে নিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে যান। তখন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের পিপি আলী আসগর স্বপন সন্তানদের দেখিয়ে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বলুন কে অপহরণের ভিকটিম, আর কে আসামি?’ সব শুনে আদালত ববিসহ সবাইকে খালাস দেন। কিন্তু তত দিনে হারিয়ে গেছে আটটি বছর।
মামলায় খালাস পেয়ে মিষ্টি হাতে ববি-সুবর্না আসেন প্রথম আলোয়, কৃতজ্ঞতা জানাতে। আমি তাঁর শেষ লড়াই শুনে আবারও আপ্লুত হই। ববি-সুবর্না এখন সাভারে নিজেদের বাড়িতে থাকেন। মায়ের সঙ্গেও মিল হয়েছে তাঁদের। ববি শাশুড়ির আদরের জামাতা। সুবর্নার তিন সন্তানের দুজন স্কুলে যায়। ববি একটি সরকারি ব্যাংকে চড়া বেতনের আইটি কর্মকর্তা। আর সুবর্ণা হলেন ওমর আলীর কবিতা… ‘সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ/এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন’।
এই লেখার আগে ফোন করেছিলাম সুবর্নাকে। বললেন, ১৭ বছরের সংসারে এখন সুখের বন্যা। জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই তাঁর। ফেলে আসা দিনের কথা এক ফাঁকে মনে করিয়ে দিতেই আবারও দেড় ঘণ্টা সেই পুরোনো কাসুন্দি। তারপর আবদার, ‘ভাই, কবে আসবেন আমাকে দেখতে?’
বললাম, আসব, নিশ্চয় একদিন আসব।
ভারি মিষ্টি মুখের এক তরুণী এসেছেন তাঁরই বয়সী এক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে। অনেকক্ষণ বসে আছেন অভ্যর্থনার সামনে। একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে চান। সহকর্মী মর্জিনা বেগম এইটুকু বলে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তরুণ-তরুণীর কথাটা শুনি।
হাতে জরুরি কাজ ছিল। সেটা শেষ করে গেলাম মিনিট বিশেক পরে। দেখি অনেকগুলো কাগজ হাতে দুজনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। মনে হলো আমাকে দেখে হালে পানি পেলেন। ছেলেটি বেশ ঋজু আর মেয়েটি সপ্রতিভ। যা বলার মেয়েটিই বলবেন। কথা শুরুর আগে মেয়েটি বললেন, ‘আমার ঘটনাটা অনেক লম্বা। একটু বেশি সময় দিতে হবে।’ বললাম, আচ্ছা বলুন।
মেয়েটা বলে চলেন একেবারে খুঁটিনাটি ধরে ধরে। তার পরও কোথাও একটু ছেদ পড়লে ছেলেটা ধরিয়ে দেন। ছেলেটা কখনো দোহারি করলে মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে বলেন…দাঁড়াও আমি সব বলছি। আমি তাঁদের আর থামাতে পারি না, যেন তুফানমেইল। সবই শুনতে হয়। শেষ করি পাক্কা দেড় ঘণ্টায়। এটা ২০০৬ সালের জুন-জুলাইয়ের কথা।
মেয়েটির নাম সুবর্না—সুবর্না সরকার। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন। বাবা নেই, মা একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কাকরাইলের একটি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে। সেখানে পরিচয় হয় একই ক্লাসে পড়া খ্রিষ্টান যুবক এলিন ববির সঙ্গে। প্রথমে সহপাঠী হলেও পরে দুজনকে দুজনের ভালো লেগে যায়। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। দ্বিতীয় বর্ষে উঠে ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ হঠাৎ করে দুজনে আদালতে গিয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেলেন।
প্রথম কিছুদিন সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। মাস তিনেক পরে মেয়ের চলাফেরা দেখে সুবর্নার মায়ের সন্দেহ হয়। তিনি মেয়েকে জেরা করতে শুরু করেন। সুবর্না সবকিছু আড়াল করে কিছুদিন কাটিয়ে দেন। সুবর্নার ভয়, হিন্দু মেয়ের সঙ্গে খ্রিষ্টান ছেলের বিয়ে মা কিছুতেই মেনে নেবেন না। দুজনে সিদ্ধান্ত নেন একসঙ্গে থাকার। একদিন বিয়ের অ্যাফিডেভিটের কপি বাড়িতে রেখে চুপচাপ ববির বাড়িতে চলে আসেন সুবর্না। প্রথমে ওঠেন ববিদের আরামবাগের বাড়িতে। কিন্তু ববির মা সুবর্নাকে দেখে ভয় পেয়ে যান। কোনো বিপদ হতে পারে ভেবে বাড্ডায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছেলে ও ছেলের বউকে পাঠিয়ে দেন।
সুবর্নার মা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মেয়ের বিয়ের কাগজ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে মেয়েকে ফোন দেন। টেলিফোনে অনেক কান্নাকাটি করেন। মেয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করেন। সুবর্না ধরে নেন, মেয়ের এই অবাধ্যপনাটা মেনে নিয়েছেন মা।
এভাবে কয়েক দিন যায়। দুই সপ্তাহ পর সুবর্নাকে আবার ফোন করেন তাঁর মা। তিনি মতিঝিলে আসতে বলেন জরুরি কিছু কাগজপত্র নিতে। সুবর্না তাঁর স্বামী ববিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর যে পরিস্থিতির মুখে পড়েন, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তাঁরা। মতিঝিল অগ্রণী ব্যাংকের একটি গলির মুখে যাওয়ার পর ৩০-৪০ জন তাঁদের ঘিরে ধরেন। তাঁরা সুবর্নাকে একদিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর অপহরণকারী বলে ববিকে গণপিটুনি দিতে শুরু করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল অপহরণকারী সাজিয়ে গণপিটুনি দিয়ে ববিকে মেরে ফেলা। সুবর্না এটা বুঝতে পেরে দৌড়ে গিয়ে ববিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকেন। একদিকে ভাড়াটে দুর্বৃত্তরা ববিকে টানছেন, অন্যদিকে সুবর্না তাঁকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছেন।
মুহূর্তে অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য এগিয়ে আসেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সুবর্নার মায়ের লোকেরা সরে পড়েন। সে যাত্রায় ববিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান সুবর্না।
মাস তিনেক পর আবার মায়ের ফোন। এবার একেবারে নরম সুর। আগে যা হয়েছে সব ভুলে যেতে বলেন। মেয়েকে তাঁর কর্মস্থলে ডেকে নেন ব্যাংকে ঋণের কিছু কাগজে সই দিতে হবে বলে। সুবর্না মায়ের কথা শুনে সই করে চলে আসেন। কয়েক দিন পর আবার মায়ের ফোন। এবার আবদার, মায়ের বাড়িতে কয়েক দিন কাটাতে হবে। রাজি হন সুবর্না। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দেখেন পরিস্থিতি অন্য রকম। মায়ের বাড়ির একটি ঘরে তাঁকে আটকে ফেলা হয়, তাঁর ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়।
ঋণের কাগজে সই দেওয়ার কথা বলে সুবর্না যে কাগজে সই দিয়েছিলেন, তা দিয়ে ডিভোর্সের কাগজ তৈরি করা হয়। একদিন রাতে সুবর্নাকে জোর করে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিকগঞ্জে সুবর্নার খালাতো বোনের বাড়িতে। সেখানেও বন্দিদশা। সবাই নিয়ম করে তাঁকে পাহারা দিতে থাকেন, যাতে পালাতে না পারেন। সেই বাড়িতে থাকার সময় সুবর্না জানতে পারেন ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে তাঁকে রোগী সাজিয়ে ভারতে পাঠানো হবে। এ জন্য তাঁকে এই বাড়িতে আনা হয়েছে। ভারতে পাঠানোর সব বন্দোবস্ত পাকা—এ কথা কানে আসামাত্র প্রাণপণে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে ভুল বাসে উঠে চলে যান পাটুরিয়া ঘাটে। সেখান থেকে ফোন করলে ববি তাঁকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন।
কয়েক দিন পর ববিদের আরামবাগের বাড়িতে পুলিশ আসে। অভিযোগ, সুবর্নাকে অপহরণ করার অভিযোগে ববি, তাঁর মাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সুবর্নার মা সেই মামলা করেছেন। পুলিশ ববিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। সুবর্নাও স্বামীর সঙ্গে থানায় চলে যান। পুলিশ তাঁকে চাপ দিতে থাকে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুবর্না অটল। পরে পুলিশ ভিকটিম হিসেবে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করে।
আদালত ববিকে কারাগারে আর সুবর্নাকে নিরাপদ হেফাজতে পাঠান। ৯ দিন পর জামিনে বেরিয়ে আসেন ববি। সুবর্নাকে নিরাপদ হেফাজতে কাটাতে হয় ২১ দিন। এর মধ্যে নিরাপদ হেফাজতে মায়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁদের কথায় রাজি না হলে তাঁরা ববিকে মেরে ফেলবেন। এই হুমকিতেও টলেননি তিনি। এরপর সুবর্নাকে আদালতে নেওয়া হলে নিজেই আদালতে বলেন, তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকতে চান। এরপর আদালত তাঁকে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেন।
এভাবে মাস তিনেক চলে যায়। হঠাৎ একদিন আদালতে হাজিরা দিতে গেলে জামিন বাতিল করে ববিকে কারাগারে পাঠান আদালত। তিন মাস কয়েদ খেটে বেরিয়ে আসেন ববি।
সুবর্নার ঘণ্টা দেড়েকের নিখুঁত বিবরণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি। মনে হয় কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। মেয়েটির দিকে তাকালে বিস্ময় লাগে। তাঁর দাবি, তাঁকে নিয়ে যেন একটা নিউজ করি। সুবর্নার দাবি মেনে একটি খবর প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয়। তাতে অবশ্য কিছুটা লাভ হয় তরুণ দম্পতির। তাঁরা বিচারক ও আইনজীবীদের সহানুভূতি পান।
এর পর থেকে ববি-সুবর্না প্রায়ই ফোন করেন। নানা সুখ-দুঃখের কথা জানান। একদিন প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার খবরও দেন ববি। বাচ্চা প্রসবের জন্য মগবাজারের আদ্-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি হন সুবর্না। তবু বিপদ তাঁদের পিছু ছাড়ে না। প্রথম বাচ্চা জন্মের পরদিন দুপুরে হঠাৎ সুবর্নার ফোন। কান্নাকাটি করে বলছেন, ‘ভাই, এবার র্যাব এসেছে। ববিকে তুলে নিয়ে যেতে চায়।’ হাসপাতালে এক দিনের সন্তান ফেলে স্বামীকে বাঁচাতে র্যাবের মুখোমুখি দাঁড়ান সুবর্না। তারা সুবর্নার কাছে হার মেনে ফিরে যায়।
মামলা চলতেই থাকে। প্রথম সন্তান জন্মের পাঁচ দিনের মাথায় মামলায় হাজিরার দিন। পাঁচ দিনের সন্তান কোলে নিয়ে আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী অপহরণের মামলার হাজিরা দিতে যান সুবর্না। বিচারক সব দেখে নীরব থাকেন। এভাবে মামলা চলে। বিচারক যান বিচারক আসেন, কিন্তু মামলা আর শেষ হয় না। দুই সন্তানের মা হন সুবর্না। একদিন দুই সন্তান সঙ্গে নিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে যান। তখন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের পিপি আলী আসগর স্বপন সন্তানদের দেখিয়ে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বলুন কে অপহরণের ভিকটিম, আর কে আসামি?’ সব শুনে আদালত ববিসহ সবাইকে খালাস দেন। কিন্তু তত দিনে হারিয়ে গেছে আটটি বছর।
মামলায় খালাস পেয়ে মিষ্টি হাতে ববি-সুবর্না আসেন প্রথম আলোয়, কৃতজ্ঞতা জানাতে। আমি তাঁর শেষ লড়াই শুনে আবারও আপ্লুত হই। ববি-সুবর্না এখন সাভারে নিজেদের বাড়িতে থাকেন। মায়ের সঙ্গেও মিল হয়েছে তাঁদের। ববি শাশুড়ির আদরের জামাতা। সুবর্নার তিন সন্তানের দুজন স্কুলে যায়। ববি একটি সরকারি ব্যাংকে চড়া বেতনের আইটি কর্মকর্তা। আর সুবর্ণা হলেন ওমর আলীর কবিতা… ‘সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ/এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন’।
এই লেখার আগে ফোন করেছিলাম সুবর্নাকে। বললেন, ১৭ বছরের সংসারে এখন সুখের বন্যা। জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই তাঁর। ফেলে আসা দিনের কথা এক ফাঁকে মনে করিয়ে দিতেই আবারও দেড় ঘণ্টা সেই পুরোনো কাসুন্দি। তারপর আবদার, ‘ভাই, কবে আসবেন আমাকে দেখতে?’
বললাম, আসব, নিশ্চয় একদিন আসব।
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪