কামরুল হাসান
আজকের গল্পে দুটি চরিত্র। একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী আর অন্যজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষ। এই সন্ত্রাসীর গল্পের সঙ্গে সাধারণ মানুষটিকে টেনে আনার একটি যোগসূত্র আছে। সেটা হলো, একদিন এই সন্ত্রাসী খুন হন। আর সেই খুনের মামলায় জড়ানো হয় এই সাধারণ মানুষটিকে। এরপর ফাঁসির আসামি হয়ে তিনি দুই বছর ‘কনডেম সেলে’ কাটান। পরে বেঁচে ফিরে আসেন দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। সে ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
দুই ব্যক্তির মধ্যে প্রথমে বলি সেই সন্ত্রাসী লোকটির গল্প। তাঁর নাম গাজি লিয়াকত ওরফে কালা লিয়াকত। নামটি শুনেই আশা করি বুঝতে পারছেন, কী ভয়ংকর লোকটি। কালা লিয়াকত থাকতেন পুরান ঢাকার জুড়িয়াটুলি লেনে। তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল সূত্রাপুরজুড়ে। ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে কালা লিয়াকতের নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠতেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। তাঁর আধিপত্য ছিল শ্যামবাজার থেকে শুরু করে বাবুবাজার পর্যন্ত। একদিন সকালে সেই কালা লিয়াকত খুন হন প্রতিপক্ষের হাতে।
জনকণ্ঠ অফিস তখন মতিঝিলে। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রিপোর্টারদের মিটিং। সকালে অফিসে এসে শুনি পিএবিএক্স নম্বরে ফোন এসেছে—কালা লিয়াকত খুন। সবার হাতে-হাতে তখন মোবাইল ফোন ছিল না। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর সাধারণ মানুষ ছিল খুবই শ্রদ্ধাশীল। কোনো কিছু ঘটলেই তারা সংবাদপত্র অফিসে ফোন করে খবর দিত। অনেক সময় থানার ওসিরাও ফোন করে লোক পাঠাতে বলতেন।
খুনের খবর শুনে গেলাম জুড়িয়াটুলি লেনে। দেখি, কালা লিয়াকতের লাশ বাসার সামনে ফাঁকা একটা জায়গায় খাটিয়ার ওপর রাখা। তার চারপাশে একদল যুবক ঘোরাঘুরি করছে, যাদের চলাফেরা অন্যরকম। কেমন যেন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ। যাকে জিজ্ঞাসা করি কেউ কিছু বলে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সব দেখছি। একজন এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। একটু পর এক নারী এসে আমাকে নিয়ে একটি ঘরের ভেতরে গেলেন। বলেন, ‘ওখানে যারা আছে সবার মাথা গরম, হাতে অস্ত্র আছে। কোনো কিছু জানতে চাইলে আমাকে বলেন।’ তিনি আমার দরকারি প্রশ্নগুলোর জবাব দিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা শেষ করে বের হব—এমন সময় তিনি একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। ফিরে এলেন এক প্লেট বিরিয়ানি হাতে নিয়ে। সামনে লাশ পড়ে আছে, আর তার সামনে বসে আমি বিরিয়ানি খাব? খুবই অস্বাভাবিক মনে হলো। কিন্তু তিনি নাছোড়। পরে অনেক অনুনয়বিনয় করে বেরিয়ে এলাম।
পরে জানলাম তিনিই কালা লিয়াকতের স্ত্রী। নাম রোকেয়া বেগম। আমাকে বলেছিলেন, তাঁর স্বামীকে যাঁরা খুন করেছেন তিনি তাঁদের চেনেন। এই খুনের নেতৃত্ব দিয়েছেন কালা লিয়াকতের প্রতিপক্ষ সুন্দর বাবু নামের আরেক সন্ত্রাসী। রোকেয়া বেগম সুন্দর বাবুসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন।
এরপর দিন যায়। কালা লিয়াকতের কথা ভুলে যাই। জনকণ্ঠ ছেড়ে আসি প্রথম আলোয়। ২০০৬ সালে পুরোনো মামলা নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে আবার সামনে আসে কালা লিয়াকতের নাম। তত দিনে ডিবির পরিদর্শক রেজাউল করিম এই খুনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন, বিচারও শেষ হয়েছে।
আমার উদ্দেশ্য ছিল, সন্ত্রাসীরা খুন হওয়ার পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেমন আছে, তা তুলে আনা। সেই তালিকায় এলো কালা লিয়াকতের নাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম কালা লিয়াকতের স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে। কথা বলতে গিয়ে তিনি দিলেন বিস্ফোরক তথ্য। বললেন, সুন্দর বাবু নামে যাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তিনি তাঁর স্বামীর খুনি সুন্দর বাবু নন। এই কথা তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং আদালতকে বলেছেন। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি। তাঁর এই কথা কয়েকটি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। রোকেয়া বেগমের কাছে মামলার নথিপত্র ছিল। দেখি, শাহ আলম বাবু ওরফে সুন্দর বাবু নামের যে আসামি আছেন, তাঁর বাবার নাম আফজাল হোসেন। ৫৭ নম্বর নয়াপল্টনের বাসিন্দা তিনি। ২০০৩ সালের ২৬ জুন সেই শাহ আলম বাবু আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সেই থেকে তিনি কনডেম সেলে।
মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। এবার যেতে হবে ৫৭ নম্বর নয়াপল্টনে শাহ আলম বাবুর বাড়িতে। এসে পেয়ে গেলাম শাহ আলমের স্ত্রী জমিলা খাতুনকে। তিনি আমাকে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেন। তারপর খুব ভালো করে দেখলেন। একটি ঘরে বসতে দিয়ে বললেন, এই ঘরে ব্লক ও বাটিকের কারখানা ছিল। সেই কারখানার কাপড় বিক্রি করা হতো নিউমার্কেটে। ব্যবসা ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারেন, তাঁর স্বামী খুনের আসামি। যে লোকটি কোনো দিন নিজের সন্তানের গায়ে হাত তোলেননি, তিনি কী করে মানুষ খুন করবেন? কোনো কিছুতেই হিসাব মেলে না।
জমিলা বলেন, তাঁদের বাড়ির একটি কক্ষে ভাড়া থাকতেন আবদুল গণি নামের এক মুহুরি। তিনি প্রথম এ ঘটনাটি জানান। এরপর গণিকে দিয়ে মামলার নকল তোলেন। কয়েক দিন পর বাড়িতে পুলিশ আসে। জমিলা এরপর শাহ আলমকে নিয়ে যান এপিপি গোলাম মোস্তফার কাছে। তিনি সব শুনে বলেন, আত্মসমর্পণের সময় কাগজপত্রে শাহ আলম বাবু নামের সঙ্গে ‘সুন্দর বাবু’ লিখতে হবে। শাহ আলম এতে রাজি না হলেও পরে সুন্দর বাবু নামেই আদালতে হাজির হতে বাধ্য হন।
২০০৩ সালের ২৬ জুন শাহ আলম বাবু আদালতে হাজির হয়ে জানান, তিনি প্রকৃত ‘সুন্দর বাবু’ নন। মামলার বাদীও আদালতে হাজির হয়ে জানান, এই বাবু তাঁর স্বামীর হত্যাকারী নন। আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে সাক্ষীরাও শাহ আলমকে শনাক্ত করেননি। তবুও তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়।
জমিলা বলেন, রেজাউল করিম নামের সেই পুলিশ তাঁর স্বামীর কাছে টাকা চেয়েছিলেন। টাকা না পেয়ে তিনি অভিযোগপত্রে শাহ আলমের নাম ঢুকিয়ে দেন। ফাঁসির আসামি হয়ে শাহ আলম যান কারাগারে। কিন্তু জমিলা দমার পাত্র নন। তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এক অফিস থেকে অন্য অফিস, এক আদালত থেকে আরেক আদালতে। মামলা হাইকোর্টে আসে।
জমিলাকে নিয়ে প্রতিবেদন করি প্রথম আলোয়। এতে বেশ সাড়া পড়ে। এরপর ফলোআপ চলতে থাকে। একটি মানবাধিকার সংস্থা এগিয়ে আসে। জমিলা একটু ভরসা পান। তিনি প্রায়ই ফোনে তাঁর কষ্টের কথা বলেন। একদিন বলেন, স্বামীর জন্য এত কিছু করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। শাহ আলম জেলে যাওয়ার পর প্রথমে হাত পড়ে কারখানাটায়। এরপর একে একে গ্রামের জমি, ভিটের গাছপালা, গাভি, গয়না, ঘরের আসবাব, টিভি, ফ্রিজ সবকিছু বিক্রি হয়ে যায়। জমিলার তিন সন্তানের মধ্যে মেজ ছেলে সেলিম পড়ত বিকেএসপিতে। তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়। বড় মেয়ে আফসানার বিয়ের চিন্তা করছিলেন জমিলা। তা-ও থেমে যায়। ছোট ছেলে রাকিব মহল্লার পাশে একটি স্কুলে পড়ত। বাবার জেল হওয়ার পর কয়েক দিন সে ঠিকমতো খায়নি। বায়না ধরেছিল, বাবা না এলে কিছুই খাবে না। কিন্তু ক্ষুধার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানে ছেলেটি। তবু লড়াই চালিয়ে যান জমিলা। তাঁর জয়ও হয়। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ শাহ আলমকে মুক্তি দেন। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। তখনো আসল খুনি ‘সুন্দর বাবু’ ধরা পড়েননি।
পরদিন শুক্রবার সকালে যাই শাহ আলমের নয়াপল্টনের বাসায়। দেখি আশপাশের শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করেছে। জমিলার বাড়িতে যেন ঈদের আনন্দ। অনেকবার রিপোর্টের কারণে ওই পরিবারের সবাই আমাকে চেনে। আমাকে দেখে এগিয়ে আসেন জমিলা। আমাকে নিয়ে যান শাহ আলমের কাছে। শাহ আলম শোনান তাঁর কনডেম সেলের গল্প। বলেন, ‘রাত এলেই মনে হতো আমাকে মেরে ফেলা হবে। যেকোনো মুহূর্তে কনডেম সেল থেকে নেওয়া হবে ফাঁসির মঞ্চে। ভয়ে দুই চোখ এক করতে পারতাম না। এভাবে দুই বছর নির্ঘুম কেটেছে, প্রায় অন্ধকারে ছিলাম। এখন স্বাভাবিক আলোয় এসে তাকাতে পারছি না। নিজের কাছে বিশ্বাস হয় না, আমি বেঁচে আছি।’
শাহ আলমের সব বক্তব্য রেকর্ড করি। রেকর্ডার পকেটে ঢুকিয়ে জমিলাকে বলি, এবার তাহলে যাই। গাড়ির সামনে আসতেই জমিলা ছেলে-মেয়েদের নাম ধরে ডাকেন। সবাইকে বলেন, আংকেলকে সালাম করো। ছেলে-মেয়েরা লাইন ধরে সালাম করে। আমি জমিলার মেয়ে আফসানার মাথায় হাত রাখতেই সে আমাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে কান্না সংক্রমিত করে জমিলা ও শাহ আলমকে। আমাকেও। নয়াপল্টনের রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। তাদের চোখও তখন ভেজা।
আজকের গল্পে দুটি চরিত্র। একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী আর অন্যজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষ। এই সন্ত্রাসীর গল্পের সঙ্গে সাধারণ মানুষটিকে টেনে আনার একটি যোগসূত্র আছে। সেটা হলো, একদিন এই সন্ত্রাসী খুন হন। আর সেই খুনের মামলায় জড়ানো হয় এই সাধারণ মানুষটিকে। এরপর ফাঁসির আসামি হয়ে তিনি দুই বছর ‘কনডেম সেলে’ কাটান। পরে বেঁচে ফিরে আসেন দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। সে ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
দুই ব্যক্তির মধ্যে প্রথমে বলি সেই সন্ত্রাসী লোকটির গল্প। তাঁর নাম গাজি লিয়াকত ওরফে কালা লিয়াকত। নামটি শুনেই আশা করি বুঝতে পারছেন, কী ভয়ংকর লোকটি। কালা লিয়াকত থাকতেন পুরান ঢাকার জুড়িয়াটুলি লেনে। তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল সূত্রাপুরজুড়ে। ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে কালা লিয়াকতের নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠতেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। তাঁর আধিপত্য ছিল শ্যামবাজার থেকে শুরু করে বাবুবাজার পর্যন্ত। একদিন সকালে সেই কালা লিয়াকত খুন হন প্রতিপক্ষের হাতে।
জনকণ্ঠ অফিস তখন মতিঝিলে। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রিপোর্টারদের মিটিং। সকালে অফিসে এসে শুনি পিএবিএক্স নম্বরে ফোন এসেছে—কালা লিয়াকত খুন। সবার হাতে-হাতে তখন মোবাইল ফোন ছিল না। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর সাধারণ মানুষ ছিল খুবই শ্রদ্ধাশীল। কোনো কিছু ঘটলেই তারা সংবাদপত্র অফিসে ফোন করে খবর দিত। অনেক সময় থানার ওসিরাও ফোন করে লোক পাঠাতে বলতেন।
খুনের খবর শুনে গেলাম জুড়িয়াটুলি লেনে। দেখি, কালা লিয়াকতের লাশ বাসার সামনে ফাঁকা একটা জায়গায় খাটিয়ার ওপর রাখা। তার চারপাশে একদল যুবক ঘোরাঘুরি করছে, যাদের চলাফেরা অন্যরকম। কেমন যেন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ। যাকে জিজ্ঞাসা করি কেউ কিছু বলে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সব দেখছি। একজন এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। একটু পর এক নারী এসে আমাকে নিয়ে একটি ঘরের ভেতরে গেলেন। বলেন, ‘ওখানে যারা আছে সবার মাথা গরম, হাতে অস্ত্র আছে। কোনো কিছু জানতে চাইলে আমাকে বলেন।’ তিনি আমার দরকারি প্রশ্নগুলোর জবাব দিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা শেষ করে বের হব—এমন সময় তিনি একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। ফিরে এলেন এক প্লেট বিরিয়ানি হাতে নিয়ে। সামনে লাশ পড়ে আছে, আর তার সামনে বসে আমি বিরিয়ানি খাব? খুবই অস্বাভাবিক মনে হলো। কিন্তু তিনি নাছোড়। পরে অনেক অনুনয়বিনয় করে বেরিয়ে এলাম।
পরে জানলাম তিনিই কালা লিয়াকতের স্ত্রী। নাম রোকেয়া বেগম। আমাকে বলেছিলেন, তাঁর স্বামীকে যাঁরা খুন করেছেন তিনি তাঁদের চেনেন। এই খুনের নেতৃত্ব দিয়েছেন কালা লিয়াকতের প্রতিপক্ষ সুন্দর বাবু নামের আরেক সন্ত্রাসী। রোকেয়া বেগম সুন্দর বাবুসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন।
এরপর দিন যায়। কালা লিয়াকতের কথা ভুলে যাই। জনকণ্ঠ ছেড়ে আসি প্রথম আলোয়। ২০০৬ সালে পুরোনো মামলা নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে আবার সামনে আসে কালা লিয়াকতের নাম। তত দিনে ডিবির পরিদর্শক রেজাউল করিম এই খুনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন, বিচারও শেষ হয়েছে।
আমার উদ্দেশ্য ছিল, সন্ত্রাসীরা খুন হওয়ার পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেমন আছে, তা তুলে আনা। সেই তালিকায় এলো কালা লিয়াকতের নাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম কালা লিয়াকতের স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে। কথা বলতে গিয়ে তিনি দিলেন বিস্ফোরক তথ্য। বললেন, সুন্দর বাবু নামে যাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তিনি তাঁর স্বামীর খুনি সুন্দর বাবু নন। এই কথা তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং আদালতকে বলেছেন। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি। তাঁর এই কথা কয়েকটি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। রোকেয়া বেগমের কাছে মামলার নথিপত্র ছিল। দেখি, শাহ আলম বাবু ওরফে সুন্দর বাবু নামের যে আসামি আছেন, তাঁর বাবার নাম আফজাল হোসেন। ৫৭ নম্বর নয়াপল্টনের বাসিন্দা তিনি। ২০০৩ সালের ২৬ জুন সেই শাহ আলম বাবু আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সেই থেকে তিনি কনডেম সেলে।
মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। এবার যেতে হবে ৫৭ নম্বর নয়াপল্টনে শাহ আলম বাবুর বাড়িতে। এসে পেয়ে গেলাম শাহ আলমের স্ত্রী জমিলা খাতুনকে। তিনি আমাকে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেন। তারপর খুব ভালো করে দেখলেন। একটি ঘরে বসতে দিয়ে বললেন, এই ঘরে ব্লক ও বাটিকের কারখানা ছিল। সেই কারখানার কাপড় বিক্রি করা হতো নিউমার্কেটে। ব্যবসা ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারেন, তাঁর স্বামী খুনের আসামি। যে লোকটি কোনো দিন নিজের সন্তানের গায়ে হাত তোলেননি, তিনি কী করে মানুষ খুন করবেন? কোনো কিছুতেই হিসাব মেলে না।
জমিলা বলেন, তাঁদের বাড়ির একটি কক্ষে ভাড়া থাকতেন আবদুল গণি নামের এক মুহুরি। তিনি প্রথম এ ঘটনাটি জানান। এরপর গণিকে দিয়ে মামলার নকল তোলেন। কয়েক দিন পর বাড়িতে পুলিশ আসে। জমিলা এরপর শাহ আলমকে নিয়ে যান এপিপি গোলাম মোস্তফার কাছে। তিনি সব শুনে বলেন, আত্মসমর্পণের সময় কাগজপত্রে শাহ আলম বাবু নামের সঙ্গে ‘সুন্দর বাবু’ লিখতে হবে। শাহ আলম এতে রাজি না হলেও পরে সুন্দর বাবু নামেই আদালতে হাজির হতে বাধ্য হন।
২০০৩ সালের ২৬ জুন শাহ আলম বাবু আদালতে হাজির হয়ে জানান, তিনি প্রকৃত ‘সুন্দর বাবু’ নন। মামলার বাদীও আদালতে হাজির হয়ে জানান, এই বাবু তাঁর স্বামীর হত্যাকারী নন। আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে সাক্ষীরাও শাহ আলমকে শনাক্ত করেননি। তবুও তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়।
জমিলা বলেন, রেজাউল করিম নামের সেই পুলিশ তাঁর স্বামীর কাছে টাকা চেয়েছিলেন। টাকা না পেয়ে তিনি অভিযোগপত্রে শাহ আলমের নাম ঢুকিয়ে দেন। ফাঁসির আসামি হয়ে শাহ আলম যান কারাগারে। কিন্তু জমিলা দমার পাত্র নন। তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এক অফিস থেকে অন্য অফিস, এক আদালত থেকে আরেক আদালতে। মামলা হাইকোর্টে আসে।
জমিলাকে নিয়ে প্রতিবেদন করি প্রথম আলোয়। এতে বেশ সাড়া পড়ে। এরপর ফলোআপ চলতে থাকে। একটি মানবাধিকার সংস্থা এগিয়ে আসে। জমিলা একটু ভরসা পান। তিনি প্রায়ই ফোনে তাঁর কষ্টের কথা বলেন। একদিন বলেন, স্বামীর জন্য এত কিছু করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। শাহ আলম জেলে যাওয়ার পর প্রথমে হাত পড়ে কারখানাটায়। এরপর একে একে গ্রামের জমি, ভিটের গাছপালা, গাভি, গয়না, ঘরের আসবাব, টিভি, ফ্রিজ সবকিছু বিক্রি হয়ে যায়। জমিলার তিন সন্তানের মধ্যে মেজ ছেলে সেলিম পড়ত বিকেএসপিতে। তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়। বড় মেয়ে আফসানার বিয়ের চিন্তা করছিলেন জমিলা। তা-ও থেমে যায়। ছোট ছেলে রাকিব মহল্লার পাশে একটি স্কুলে পড়ত। বাবার জেল হওয়ার পর কয়েক দিন সে ঠিকমতো খায়নি। বায়না ধরেছিল, বাবা না এলে কিছুই খাবে না। কিন্তু ক্ষুধার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানে ছেলেটি। তবু লড়াই চালিয়ে যান জমিলা। তাঁর জয়ও হয়। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ শাহ আলমকে মুক্তি দেন। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। তখনো আসল খুনি ‘সুন্দর বাবু’ ধরা পড়েননি।
পরদিন শুক্রবার সকালে যাই শাহ আলমের নয়াপল্টনের বাসায়। দেখি আশপাশের শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করেছে। জমিলার বাড়িতে যেন ঈদের আনন্দ। অনেকবার রিপোর্টের কারণে ওই পরিবারের সবাই আমাকে চেনে। আমাকে দেখে এগিয়ে আসেন জমিলা। আমাকে নিয়ে যান শাহ আলমের কাছে। শাহ আলম শোনান তাঁর কনডেম সেলের গল্প। বলেন, ‘রাত এলেই মনে হতো আমাকে মেরে ফেলা হবে। যেকোনো মুহূর্তে কনডেম সেল থেকে নেওয়া হবে ফাঁসির মঞ্চে। ভয়ে দুই চোখ এক করতে পারতাম না। এভাবে দুই বছর নির্ঘুম কেটেছে, প্রায় অন্ধকারে ছিলাম। এখন স্বাভাবিক আলোয় এসে তাকাতে পারছি না। নিজের কাছে বিশ্বাস হয় না, আমি বেঁচে আছি।’
শাহ আলমের সব বক্তব্য রেকর্ড করি। রেকর্ডার পকেটে ঢুকিয়ে জমিলাকে বলি, এবার তাহলে যাই। গাড়ির সামনে আসতেই জমিলা ছেলে-মেয়েদের নাম ধরে ডাকেন। সবাইকে বলেন, আংকেলকে সালাম করো। ছেলে-মেয়েরা লাইন ধরে সালাম করে। আমি জমিলার মেয়ে আফসানার মাথায় হাত রাখতেই সে আমাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে কান্না সংক্রমিত করে জমিলা ও শাহ আলমকে। আমাকেও। নয়াপল্টনের রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। তাদের চোখও তখন ভেজা।
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪