Ajker Patrika

৪০০ কিমি হাঁটার সেই দুঃসহ গল্প

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০৯
Thumbnail image

ভারতের ওডিশা রাজ্যে বন বিভাগের একটি চাকরির জন্য ২৫ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সঞ্জীব পুরোহিত। চাকরির শর্তই ছিল প্রার্থীকে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য এতটা পথ হেঁটে দেখাতে হবে। সঞ্জীব পুরোহিত সেই যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ২৫ কিলোমিটার যেখানে শেষ হয়, সেখানে তিনি পড়ে মারা যান।

‘কবীর সুমন’ হিসেবে নাম বদলের আগে গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘সঞ্জীব পুরোহিত হাঁটলেন চাকরি পাবেন এই ভরসায়...’। আর আমাদের রমিজউদ্দিন কত পথ হেঁটেছেন জানেন? ৪০০ কিলোমিটার! গিনেস বুকে নাম লেখানোর জন্য অনেকে হয়তো এর চেয়েও বেশি পথ হাঁটেন। কিন্তু রমিজউদ্দিন হেঁটেছেন ভিন দেশে, জীবন বাঁচাতে।

নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, শোয়ার জায়গা নেই, শুধু হাঁটা আর হাঁটা—যেন সুকান্তের সেই রানারের চলার মতো। ২৬ দিন ধরে তিনি শুধু হেঁটেই চলেছেন। অচেনা কোনো দেশে একজন নিরন্ন মানুষ এত পথ হাঁটলেন কী করে? সতিই বড় বিস্ময়কর।

রমিজউদ্দিনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে। তখন পুলিশের আইজি ছিলেন কিশোরগঞ্জ-২ এলাকার বর্তমান সাংসদ নূর মোহাম্মদ। তিনি একদিন ফোন করে আমাকে তাঁর অফিসে আসতে বললেন। বললেন, এলে পাচার হওয়া একজনের দুঃসহ জীবনের গল্প শোনা যাবে। যে লোকটি আফ্রিকার নাইজার, আলজেরিয়া, মরক্কো হয়ে জিব্রাল্টার প্রণালি পেরিয়ে স্পেনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এই অখ্যাত গ্রাম্য লোকটির যোগাযোগের কাহিনিটি বললেন তিনি। হাতে কোনো কাজ ছিল না, গেলাম পুলিশ সদর দপ্তরে।

আইজি নূর মোহাম্মদের অফিসে সাধারণত দর্শনার্থীর কোনো ভিড় থাকত না। পরিপাটি অফিসরুম সেদিনও ফাঁকা। যে লোকটির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন, তাঁকে বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমি যাওয়ার পর তাঁকে ডেকে আনা হলো। দেখি, খুবই সাধারণ একজন মানুষ, কথা বলেন সিলেটি উচ্চারণে। আইজিপির কাছে জানতে চাইলাম, তাঁকে পেলেন কোথায়? বললেন, ২০০৭ সালের ৫ থেকে ৮ নভেম্বর মরক্কোতে ছিলেন ইন্টারপোলের বার্ষিক সাধারণ সভায়। সেই সভায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন র‍্যাবের তখনকার মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার। তখন বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা রমিজের কথা তাঁকে বলেন। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, ৪০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে রমিজ দূতাবাসে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দূতাবাস তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেনি। নূর মোহাম্মদ দেশে ফিরে রমিজউদ্দিনকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশনের (আইওএম) সাহায্য নিয়ে ২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাঁকে মরক্কো থেকে ঢাকায় আনা হয়।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ওর সঙ্গে কথা বলে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। একটি মানুষ খালি পেটে হেঁটে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারেন, শুনে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। প্রথম মনে হয়েছিল লোকটি বানিয়ে বানিয়ে বলছে। পরে তাঁর সব কথা শুনে বিশ্বাস হয়। কারণ, এত দীর্ঘ পথে রমিজ যা দেখেছেন, তার সবকিছুর নিখুঁত বিবরণ দিতে পারেন। রমিজের কথা না শুনলে বোঝা যাবে না কত ভয়ংকর কষ্ট লোকটি সহ্য করেছেন।’ বললেন, লোকটা পথে পথে ভিক্ষা করে নিজের খাবার জোগাড় করেছেন। মানুষের কাছে জানতে চেয়েছেন মরক্কোর রাজধানী কত দূরে, যেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস আছে। কেউ দেখিয়ে দিয়েছে, কেউ সহযোগিতা করেছে, আবার কেউ তিরস্কার করেছে। পথে দু-একবার বাসে ওঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভাড়ার টাকা না থাকায় বাসের লোকজন তাঁকে নামিয়ে দিয়েছেন।

আইজিপির সামনে রমিজ তাঁর বেঁচে ফেরার গল্প বলে যান। আর আমি মোবাইল ফোনে রেকর্ড করি। নিজের ভাষায় রমিজ বলেন, ‘আমার বাড়িত সিলটর বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা ইউনিয়নের বড় সালেশ্বর গ্রামত। পিতা মরহুম রওশন মোহাম্মদ। তিন পুউয়া (ছেলে) আর দুই পুরির (মেয়ে) বাপ আমি। দুবাইত কামলার কাম করতাম। আমার চাচা হউর (চাচাশ্বশুর শামসুর রহমান) আদম ব্যাপারী। দেশ থাকি মানুষ বিদেশ পাচার করইন। বিলাত দেড়-দুই লাখ টেখা বেতন পাওয়ার লোভ দেখাইন আমারে তাইন। বেশি রুজির লোভে পইরা বিলাত যাইবার লাগি পেরেশান অই যাই আমি।’

রমিজ বলেন, টানাটানির সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আশপাশের গ্রামের অনেকেই বিদেশে থাকেন। বিদেশ থেকে তাঁরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠান। সেই টাকা দিয়ে নতুন নতুন বাড়ি ওঠে। প্রতিবেশীদের দেখাদেখি তাঁরও লোভ হয় বিদেশে গিয়ে অনেক টাকা আয় করে নিজের ভাগ্য বদলের। স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন, কিন্তু সাহস পান না। এর মাঝে এক প্রভাবশালী প্রতিবেশী তাঁর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা ঠুকে দেন। ভয় দেখান, মামলায় রমিজকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হবে। এলাকার লোকজনও তাঁকে ভয় দেখায়, বাকি জীবন জেলে কাটাতে হবে। লোকজনের কথা শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যান রমিজ। গ্রাম থেকে কিছুদিন গা-ঢাকা দেন। কিন্তু কত দিন এভাবে থাকবেন? একপর্যায়ে বিদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রজিমের নিজের ভাই থাকেন দুবাই, তাঁদের কাছে ফোন করে ভিসা পাঠানোর অনুরোধ করেন। কিছুদিন পরে ভাইয়ের পাঠানো ভিসা আসে। সেই ভিসায় ২০০৪ সালে দুবাই চলে যান। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। আয়ও মোটামুটি মন্দ নয়। দুবাইতে সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল। তবু ইচ্ছে হলো ইউরোপে যাবেন। তাতে বেশি টাকা আয় করতে পারবেন। দুবাইয়ে পরিচয় হয় মানব পাচারকারী শামসুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর কথায় প্রলুব্ধ হয়ে ২০০৫ সালের ২৮ মে স্পেনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রাপথ ছিল আফ্রিকার নাইজার, আলজেরিয়া, মরক্কো হয়ে জিব্রাল্টার প্রণালি দিয়ে স্পেন। পুরোটাই অবৈধ উপায়ে।

দুবাই থেকে তাঁরা প্রথমে যান পশ্চিম আফ্রিকার দেশে নাইজারে। সেখানে আমাদাও খালিহা নামের এক (নাইজেরিয়ান নাগরিক) লোক তাঁকে একটি হোটেলে নিয়ে যান, যেখানে আরও ১৩ জন বাংলাদেশি অপেক্ষা করছিলেন। দুই মাস সেখানে থাকার পর সেই দলের আটজনকে নিয়ে বাস রওনা দেয় আলজেরিয়ার উদ্দেশে। যাত্রা শুরুর আগেই আদম ব্যাপারীর লোকেরা তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নেন। বাস থেকে নেমে হাঁটা। ১৫ দিন ধরে মরুভূমির পথে হেঁটে চলতে থাকেন। যাওয়ার সময় সঙ্গে সামান্য যে খাবার ছিল, তা শেষ হয়ে যায়। খিদের জ্বালায় আর চলতে পারেন না। তাঁরা পৌঁছে যান আলজেরিয়া সীমান্তে।

এরপর তাদের তুলে দেওয়া হয় মরক্কোর এক আদম ব্যাপারীর হাতে। উজদা নামের একটি শহরে তাঁদের কিছুদিন রাখা হয়, সেখান থেকে নাদোর হয়ে টিটুয়ান। সেখানে তাঁদের রাখা হয় জঙ্গলে। কয়েক দিন পর সেখানে হামলা করে একদল কৃষ্ণাঙ্গ। তারা সব নিয়ে যায়। একেবারে নিঃস্ব হয়ে যান রমিজউদ্দিন। উপায় না দেখে দিনের আলোয় লোকালয়ে বেরিয়ে আসেন, মরক্কো পুলিশ তাঁদের আটক করে আলজেরিয়ায় ফেরত পাঠায়।

রমিজ জানালেন, এবার সবাই মিলে দেশে ফেরার চিন্তা করেন। কিন্তু কারও পকেটে পয়সা নেই। শুরু করেন হাঁটা। পেটেও দানাপানি নেই। হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। লোকজন দরিদ্র ভেবে ভিক্ষা দিতে শুরু করে।

রজিম বললেন, ‘আমি আর আলমগীর হোসেন নামে এক বাংলাদেশি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা আবার হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে ২৬ দিনে ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মরক্কোর রাজধানী রাবায় আসি। দূতাবাসের লোকেরা আমাদের কথা শুনে আশ্রয় দেন। দূতাবাসে আসার আগ পর্যন্ত আড়াই বছর কারও সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারিনি। পরিবারের লোকজন ভেবেছিল আমি মরে গেছি।’

দেশে ফিরে সোজা গ্রামে চলে যান রমিজ। তাঁকে দেখেই ‘রমিজ আইছে...’ বলে গ্রামে রব পড়ে যায়। ছেলেমেয়েরা স্বপ্নের মতো বাবাকে দেখে। উৎসুক মানুষ ভিড় করেন তাঁর বাড়িতে। আর রমিজ, গল্পের মতো বলে যান সেই দুঃসহ কষ্টের কথা। গ্রামের মানুষ এত দিন রমিজকে নিখোঁজই ভাবতেন। আড়াই বছর খোঁজখবর না থাকা মানুষকে এর চেয়ে আর কী ভাবা যায়?

রমিজ বললেন, এখন তাঁর দিন কাটে গল্প করে। গ্রামের মানুষ সেই গল্পের মুগ্ধ শ্রোতা। রজিমের গল্প ছড়িয়ে পড়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। সেই গল্পের ডালপালা গজায়। রমিজ সেসব বলেন আর হাসেন, কিন্তু আমরা হাসতে পারি না। একটা অদ্ভুত কষ্ট এসে বুকের ভেতরে আটকে যায়, দেখি আইজিপির চোখেও পানি। 

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত