Ajker Patrika

সিমিকে কী জবাব দেবেন সুইডেন আসলাম

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ২১
Thumbnail image

ব্যস্ত ফার্মগেটে হঠাৎ গুলির শব্দ। সুদর্শন এক তরুণ দুই হাত প্রসারিত করে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দুই হাতে দুটি অস্ত্র ধরা। সেই অস্ত্র দুটি থেকে খইয়ের মতো গুলি ফুটছে। বেপরোয়া তরুণের কাছে ঘেঁষার সাধ্য কারও নেই। গুলি থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থানে যেতে মরিয়া মানুষ।

এই অবস্থায় পাল্টা গুলি চালালে প্রাণহানি অনিবার্য। দূরে দাঁড়ানো পুলিশের ছোট দলটির প্রধান পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে চুপ হয়ে গেলেন। আর সেই সুযোগে অস্ত্রধারী যুবকটি একটি মোটরবাইকেলের পেছনে উঠে চম্পট দেন।

এ ঘটনা আমাকে বলেছিলেন একসময়ের ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা এসি আকরাম হোসেন। তবে সেই অভিযানে তিনি নিজে ছিলেন না, ছিলেন তাঁর টিমের এক পরিদর্শক। এরপর সেই তরুণ সন্ত্রাসীকে ধরতে প্রায় এক বছর ছক কষেছিলেন তিনি। ধরেছিলেন ১৯৯৭ সালে ২৬ মে বিকেলে পুরোনো ডিওএইচএসের বাসা থেকে। সেই বাসা চিনতেও ফ্রিজ বহন করা একটি ভ্যানের পিছু নিতে হয়েছিল পুলিশকে। নতুন কেনা ফ্রিজ সেই সন্ত্রাসীর বাসায় যাচ্ছে শুনেই ভ্যানের পিছু নিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ।

সেদিনের সেই ভয়ংকর তরুণ এখন কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি সুইডেন আসলাম নামে পরিচিত। আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেলে। তবে কারাগারে থাকলেও লক্ষ্মী ছেলের মতো ভেতরে বসে নেই। মোবাইল ফোনে নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার অপরাধজগৎ। কারাগারে তাঁর সেল থেকে দুটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়েছিল। এসব ফোন দিয়ে তিনি কারাগারের বাইরে থাকা পাণ্ডাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা মামলা করেছিলেন, তাঁদের এবং সেই সব মামলার সাক্ষীদের হুমকি দিতেন। সেই হুমকিতে বাদী ও সাক্ষী আর আদালতে যান না। সাক্ষীর অভাবে বেশির ভাগ মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। এখন বাকি আছে মাত্র একটি মামলা। সেই মামলা থেকে খালাস পেলেই কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন অনায়াসে।

ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের সুবাদে প্রায় প্রতিদিন বিকেলের দিকে দল বেঁধে আমরা যেতাম মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে। সেখানে সহকারী পুলিশ সুপার পদের একজন কর্মকর্তা জনসংযোগের দায়িত্বে থাকতেন। তাঁর কক্ষে বসে দিনের বিভিন্ন ঘটনা শুনতাম। দরকার হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলতাম। জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বসতেন ডিবি অফিসের ভেতরে একটি টিনশেডে। ডিবি অফিসের মূল ভবনের দোতলায় বসতেন দক্ষিণের ডিসি আর নিচতলায় ডিবির ডিসি। নিচের একটি বড় কক্ষের ভেতরে হার্ডবোর্ড দিয়ে ছোট ছোট কক্ষ বানানো। এ রকম একটি কক্ষে বসতেন এসি আকরাম হোসেন। ’৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল খুনের ঘটনায় তাঁর কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর গত বছরের ১৬ জুলাই তিনি মারা যান।

১৯৯৭ সালে ২৬ মে বিকেলে আমরা বসে আছি জনসংযোগ শাখার সহকারী কমিশনার মিয়া আব্দুস ছালামের রুমে। হঠাৎ ওয়াকিটকিতে ব্যাপক শোরগোল। বড় এক আসামি ধরা পড়েছে। ঘণ্টাখানেক পর সেই আসামিকে আনা হয় কড়া পাহারায়। আমরা দৌড়ে গেলাম আকরাম হোসেনের রুমে। দেখি হ্যান্ডকাফ পরা তরুণকে আরও শক্ত করে বাঁধা হচ্ছে। সেই তরুণকে আমরা সহজেই চিনে ফেললাম, তিনিই হলেন সুইডেন আসলাম। এসি আকরাম তাঁর অভিযান নিয়ে সহজে কিছু বলতেন না, সেদিনও বললেন না। তবে তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা সুইডেন আসলামের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম; কিন্তু আসলাম কোনো কথা বললেন না। যা জিজ্ঞাসা করি, মাথা নিচু করে থাকেন। তাঁকে দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হলেও মুখ খোলেন না। পরে আমরা খোঁজ করে বের করি ভয়ংকর সব তথ্য। সে কথায় পরে আসি।

আসলামের বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ জিন্নাত আলী। পরিবারটির আদি বাস ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার আলগা ইউনিয়নের সাঁথিয়া গ্রামে। তবে পরিবারের কেউ এই গ্রামে থাকেন না। আসলামের বাবা-চাচারা স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকার ইন্দিরা রোডে বসবাস শুরু করেন। স্বাধীনতার পর জিন্নাত আলী ফার্মগেটে রড-সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আসলাম দ্বিতীয়।

আসলাম এসএসসি পাস করেন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল (বর্তমানে তেজগাঁও সরকারি বিদ্যালয়) থেকে। স্কুলজীবনে তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন। আন্তজেলা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলেছেন। তেজগাঁও কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েই বনে যান উঠতি রংবাজ। সে সময় ফার্মগেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-বাপ্পি নামে দুই ভাই। একদিন ফার্মগেটের নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পিকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম ও তাঁর লোকজন। এরপর মারধর করে রাস্তায় ফেলে দেন। এতে দুই ভাইয়ের পতন ঘটে, উত্থান হয় আসলামের। শাকিল নামের এক কিশোর হত্যার মধ্য দিয়ে আসলামের এই কাজে হাতেখড়ি বলে অভিযোগ আছে। ১৯৮৭ সালে পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুলের ভেতরে মায়ের সামনে খুন হয় শাকিল। তখন সুইডেন আসলামের সঙ্গে ছিলেন পূর্ব রাজাবাজারের সুমন ওরফে চাংখা সুমন, ব্যাটারি বাবু ওরফে কিলার বাবু, মণিপুরিপাড়ার বিআরটিসি কোয়ার্টারের আমজাদ হোসেন, পূর্ব রাজাবাজারের বাবু এবং কলাবাগানের সাবু।

ফার্মগেট এলাকায় সে সময় চাইনিজ নামের আরেক সন্ত্রাসীর বেশ নামডাক ছিল। তাঁর সহযোগী ছিলেন শাকিল। চাইনিজের সঙ্গে সম্পর্ক করতে তাঁর সুইডেনপ্রবাসী বোন ইতিকে বিয়ে করেন সুইডেন আসলাম। চাইনিজ তাঁর বোনের সঙ্গে সুইডেনে চলে গেলে শাকিলকে নৃশংসভাবে খুন করেন আসলাম। এরপর তিনিও স্ত্রীর কাছে সুইডেনে চলে যান। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই সম্পর্কে চিড় ধরে। সুইডেনেই ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আসলামের। ইতি ঢাকায় এসে মামুন নামের এক সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেন। আসলামের সহযোগীরা এর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ’৯৫ সালের মে মাসে পুরান ঢাকার সন্ত্রাসী আগা শামীমের আস্তানায় সমঝোতার কথা বলে মামুনকে ডাকা হয়। মামুন সেখানে যান ভারতীয় সন্ত্রাসী গোপাল কর ও নুরুল ইসলামকে নিয়ে। আসলামের লোকেরা সেখানেই তাঁদের তিনজনকে গুলি করে খুন করেন। ২০০৪ সালের জুন মাসে এ মামলার রায় হয়। সন্ত্রাসী আগা শামীমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও আসলাম এ মামলা থেকে খালাস পান। সে সময় মামুন ও ইতির বিয়েতে সহায়তা করেছিলেন আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুল। একদিন মধুবাগের মাঠে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিপুলের দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে আসলাম তাঁকে খুন করান বলে অভিযোগ। বিপুলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কলাবাগানের কিসলুকেও মেরে ফেলা হয়। আসলামের আরেক সহযোগী ছিলেন গাব্বু। তাঁর স্ত্রী আসমা একবার পুলিশকে আসলামের গতিবিধির কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন তেজগাঁও রেললাইনের বস্তিতে গাব্বুর সামনেই তাঁর স্ত্রী আসমাকে বুকে গুলি করে খুন করা হয়। তখনো মূল অভিযোগ ছিল আসলামের দিকে। মিরপুরে রানা, সাজ্জাদ, টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতা শামীম তালুকদারও তাঁর হাতে খুন হয়েছিলেন। নিজের সাম্রাজ্য ঠিক রাখতে কারওয়ান বাজারের পিচ্চি হান্নান, মগবাজারের সুব্রত বাইন ও টিক্কার সঙ্গে এক হয়েছিলেন আসলাম। তখন শোনা যেত, বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয় পাচ্ছিলেন আসলাম। অবশ্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তাঁকে শীর্ষসন্ত্রাসী ঘোষণা দিয়ে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে।

এটা মনে আছে, সুইডেন আসলাম গ্রেপ্তারের পর তাঁর সাবেক স্ত্রী ইতি তাঁর মাকে নিয়ে ভোরের কাগজের তৎকালীন ক্রাইম রিপোর্টার পারভেজ খানের কাছে এসেছিলেন তাঁর ওপর নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটের অভিযোগ জানাতে। পরে পারভেজ খান তাঁদের ইস্কাটনের জনকণ্ঠ ভবনে আমার কাছে নিয়ে আসেন। ইতির করা অভিযোগের ভিত্তিতে জনকণ্ঠে রিপোর্টও হয়। ইতি আমাকে বলেছিলেন, তিনি সুইডেন আসলামকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে ফেরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, আসলাম মনে করতেন, হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিলেই তাঁকে মরতে হবে। ইতির বিষয়ে দুই দিন আগে কথা বলেছিলাম সুইডেন আসলামের এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন, ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ইতি সুইডেনে চলে যান। সেখানে বিষাদগ্রস্ত হয়ে একপর্যায়ে আত্মহত্যা করেন।

এই লেখার জন্য সুইডেন আসলামের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হালনাগাদ তথ্য নিয়েছিলাম গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে। তাতে দেখা গেল, বিভিন্ন সময়ে সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা হয়েছে, যার ৯টি হত্যা মামলা। বাকিগুলো অপহরণ ও চাঁদাবাজি। অস্ত্র আইনের দুটি মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন এবং ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে এসব মামলায় তিনি উচ্চ আদালত থেকে অব্যাহতি পান। এখন তাঁর বিরুদ্ধে আছে শুধু একটি হত্যা মামলা। সেটা হলো গালিব হত্যা মামলা। এই খুনের পরই গ্রেপ্তার হন আসলাম। মাহমুদুল হক খান গালিব ছিলেন তেজগাঁওয়ের যুবলীগের নেতা। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ তেজকুনিপাড়ার বাসার সামনে খুন হন। এ মামলার আসামি শাহীন আদালতে জবানবন্দি দিয়ে বলেছিলেন, সুইডেন আসলামের উপস্থিতিতে দেলু ও মাসুদ গুলি করে খুন করেন গালিবকে। গালিবের স্ত্রী শাহেদা নাসরিন শম্পা তেজগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। কিন্তু আসলামের ভয়ে এই মামলার সাক্ষীরা আর আদালতে যান না। ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৪ জন। এই একটি মামলাতেই আসলামের জামিন হয়নি।

ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আসলাম তাঁর চাচা শেখ মো. আবদুল লতিফের মেয়ে সিমিকে বিয়ে করেন। সিমি এখন তাঁর ছোট বোন শ্যামলী আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ইন্দিরা রোডের বাড়িতেই থাকেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন তরুণ রিপোর্টার শাহরিয়ার হাসান। কিন্তু স্বামী সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাননি সিমি। এত দিন পর এই পরিচয়ে তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না, এই পরিচয়ও বহন করতে চান না। সারাক্ষণ থাকেন অজানা এক আশঙ্কায়।

সিমি এখন একাকী। তিনি বিশ্বাস করেন, বাকি জীবন আসলামকে জেলেই কাটাতে হবে। তাঁর সঙ্গে ছোট বোন শ্যামলীও বললেন, ‘মামলাগুলো যে অবস্থায় থাকুক না কেন, তিনি যে কখনো জেল থেকে বের হতে পারবেন, এটা আর আমাদের বিশ্বাস হয় না।’

সিমির কাছে প্রশ্ন ছিল, এমন একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসীর সঙ্গে জীবন বেঁধে কী পেলেন, তাঁর হিসাব কষেছেন? সিমি কোনো জবাব দেন না, শূন্যের দিকে চেয়ে থাকেন, সেই প্রশ্নের জবাব হয়তো তাঁর নিজের কাছেও নেই। 

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নারীদের খেলায় আর নাক গলাবে না, দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চাইল ভাঙচুরকারীরা

বিয়ে করলেন সারজিস আলম

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়ছে শ্রীলঙ্কা, ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ কোথায় দেখবেন

ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় ফরিদপুরের ২ জনকে গুলি করে হত্যা

সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট কারে ধাক্কা, জাবিতে ১২ বাস আটকে ক্ষতিপূরণ আদায় ছাত্রদলের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত