Ajker Patrika

ডিপি ওয়ার্ল্ডের ২১ ভারতীয় কর্মকর্তা ঢুকলেন বন্দরে, চট্টগ্রামে উত্তেজনা

সবুর শুভ, চট্টগ্রাম    
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ১৩: ৫৬
নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)
নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ইজারা ইস্যু ঘিরে চট্টগ্রামে উত্তেজনা চরমে। দুবাইভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটির দায়িত্ব দেওয়ার উদ্যোগ ঘিরে শ্রমিকদের ক্ষোভ, রাজনৈতিক প্রতিবাদ এবং নিরাপত্তা সংশয়—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল আকার নিয়েছে। সর্বশেষ এই উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে ডিপি ওয়ার্ল্ডের ৩৪ জন কর্মকর্তার এনসিটিতে প্রবেশ, যার মধ্যে ২১ জনই ভারতীয় নাগরিক।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এনসিটির ইজারা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এখনো ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ (জিটুজি) ভিত্তিতে প্রস্তাব বিবেচনার পর্যায়ে থাকলেও ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তারা টার্মিনালের ভেতরে ঢুকে কার্যত পর্যবেক্ষণ ও ‘প্রাথমিক দখলদারি’র আচরণ শুরু করেছেন। এর ফলে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা এবং চাকরি হারানোর আতঙ্ক।

‘ইজারা এখনো হয়নি, অথচ দখলদারি শুরু!’

শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এনসিটির মতো একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হস্তান্তরের আগে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, “ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এখনো ইজারা দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের কর্মকর্তারা বন্দরের ভেতরে ঘোরাফেরা করছেন। ভবিষ্যতে যাতে তাদের আর দেখা না যায়, আমরা সেই হুঁশিয়ারি দিচ্ছি।”

ডিপি ওয়ার্ল্ডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তানভীর হোসাইন গত ১৫ এপ্রিল বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের কাছে গেটপাস চেয়ে আবেদন করেন। পরদিনই বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের এনসিটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এই প্রতিনিধি দলে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন ২১ জন, বাকি সদস্যরা দক্ষিণ আফ্রিকা, আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ফিনল্যান্ডের নাগরিক।

শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া: কর্মবিরতির হুঁশিয়ারি

চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের প্রধান সমন্বয়ক মো. ইব্রাহিম খোকন বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, বিদেশি অপারেটর ও সাইফ পাওয়ারটেক কাউকে চাই না। এটি দেশের সম্পদ, কোনো একক স্বার্থের বিষয় নয়।”

তিনি আরও জানান, ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ টার্মিনালের অভ্যন্তরে গিয়ে বলছেন, “এই কক্ষটি আমার দরকার হবে।” কেউ আবার যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে জেনে নিচ্ছেন, বর্তমান কর্মীরা তা পরিচালনা করতে সক্ষম কি না। এর ফলে কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা সরকারকে ১৬ জুন পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে বিদেশি অপারেটরকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল না হলে ২২ জুন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চার ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করব।”

ইজারার ভবিষ্যৎ কী?

চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটি চালু হয় ২০০৭ সালে। দেশের মোট কন্টেইনার পণ্যের প্রায় ৫৫ শতাংশ এই টার্মিনালের মাধ্যমে ওঠানামা করে। টার্মিনালটি আধুনিক যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ও অত্যন্ত লাভজনক—বছরে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দেয়।

তারপরও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিল। এমনকি পিপিপি কর্তৃপক্ষ ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার পর্যন্ত নিয়োগ করেছিল। তবে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই উদ্যোগ পুনরায় বিবেচনায় নেয়। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক মহলে প্রতিবাদ শুরু হয়।

বর্তমানে এনসিটি পরিচালনায় সাইফ পাওয়ারটেকের মেয়াদ আগামী ৬ জুলাই শেষ হচ্ছে। কে দায়িত্ব নেবে, তা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে পরবর্তী করণীয় জানতে চেয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।”

ডিপি ওয়ার্ল্ডের নীরবতা, ভারতীয় প্রতিনিধিদের ঘিরে সন্দেহ

ডিপি ওয়ার্ল্ডের বাংলাদেশ প্রধান নির্বাহী শামীম উল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অন্যদিকে, ভারতীয় প্রতিনিধিদের হঠাৎ বন্দরে প্রবেশকে অনেকে ‘কৌশলগত আগাম দখল’ বলেই মনে করছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ২১ জন ভারতীয় কর্মকর্তার একসঙ্গে বন্দরের অভ্যন্তরে ঢোকা কেবল কারিগরি পর্যবেক্ষণের নাম করে হলেও ভূ-রাজনৈতিকভাবে তা স্পর্শকাতর একটি ঘটনা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপড়েন এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাচ্ছে।

চট্টগ্রাম উত্তাল, সরকারের সিদ্ধান্তের দিকেই চেয়ে সবাই

চট্টগ্রামে এ মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়—ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তাদের এনসিটিতে প্রবেশ। শ্রমিক আন্দোলনের হুমকি, রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ ও কৌশলগত সংশয়—সব কিছুই পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সরকার শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয়—বিদেশি অপারেটর দিয়ে এনসিটি পরিচালনার পথে এগোবে, না কি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাখবে—তা এখন সময়ের অপেক্ষা। তবে ১৬ জুন এবং ২২ জুন—এই দুটি দিন চট্টগ্রাম বন্দর পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় আনতে পারে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত