Ajker Patrika

শাড়ি

নুসরৎ নওরিন
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২: ১৪
শাড়ি

‘বৃষ্টি হলেই আমার একজনের কথা মনে পড়ে।’ 
‘বিশেষ কেউ?’
লোকটা এক মুহূর্ত চিন্তা করল। যেন বিশেষ কেউ কি না—এ ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বিশেষ তো অবশ্যই... বৃষ্টির মতো সুন্দর সময়ে কারও কথা মনে পড়লে সে তো বিশেষই, তাই না?’
আমি বুঝতে পারলাম না, শেষের কথাটায় আমার অনুমোদন জরুরি কেন। তবু ভদ্রতাবশত হালকা মাথা ঝাঁকালাম।

লোকটা বলল, ‘তবে যতটা বিশেষ হয়ে উঠতে পারত, শেষমেশ তা হয়নি। আমিই হতে দিইনি। সত্যি বলতে কি, আমার জীবনে সবচেয়ে বিশেষ মানুষ হওয়ার কথা ছিল তারই।’

কী বলা উচিত বুঝলাম না। বলাটা জরুরিও মনে হলো না। কারণ, লোকটা কথা চালিয়ে যাচ্ছে মোটামুটি একাই। পেটে তিন পেগ পড়াটাই হয়তো কারণ। অনেক চাপা স্বভাবের লোকও দু-তিন পেগের পর বেশ দিলখোলা হয়ে ওঠে। জীবনের সব গল্প বলে দিতে চায়। অন্যদিকে, হাসিখুশি কেউ কেউ মুখে কঠিন কুলুপ এঁটে বসে থাকে। এই অভিজ্ঞতা প্রথম নয়।

আমি যা ভেবেছিলাম তা হলো না অবশ্য। লোকটা গড়গড় করে সেই বিশেষ মানুষের প্রসঙ্গে গেল না, বরং গ্লাসের দিকে স্বপ্নময় চোখে তাকিয়ে থাকল। একসময় গুনগুন করে পরিচিত একটা গানের সুর ভাজতে লাগল। মনে হলো, গ্লাসের মধ্যে কোনো মুখ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়েই গান। অনেকটা ‘এক ঘর বানাউঙ্গা তেরে ঘরকে সামনে’র মতো।

লোকটা কী সুর ভাজছিল, এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে এটুকু মনে আছে, জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা ধীরে ধীরে নামছিল। ঠান্ডা আবহাওয়া। পরদিন ছুটি। কাজের তাড়া নেই। সব মিলিয়ে সেই বিকেলে পৃথিবীটাকে খুব শান্ত, সুন্দর মনে হচ্ছিল।

একসময় গুনগুন থামিয়ে বলল, ‘বৃষ্টি হলেই মনে হয় মেয়েটা ওই শাড়িটা পরেছে... ও বলত, ওই শাড়িটা ও যেদিন পরে, সেদিনই বৃষ্টি নামে।’
আমি কিছু বললাম না। পৃথিবীতে কত পাগল আছে! এ কথা যখন ভাবছি, তখনই লোকটা বলল, ‘আমিও আপনার মতো কথাটা শুনে প্রথম ওকে পাগল ভেবেছিলাম। তবে তত দিনে আমাদের সম্পর্কটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছি। তাই পাগল ভাবলেও সেটাকে খুব বেশিক্ষণ মনের মধ্যে জায়গা দিইনি। তার পরও খেয়াল না করে উপায় ছিল না যে ব্যাপারটা উদ্ভট।’

কথাটা বলে লোকটা একটা চুমুক দিয়ে আবার গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি পরের কথাটা শোনার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকলাম। লোকটা যেন ভুলেই গিয়েছিল। বলল, ‘ওহ, হ্যাঁ... আচ্ছা। এরপর... আমি তো কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলাম। ও বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল। বলল, আমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছ না তুমি। তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব।’

আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, ‘প্রমাণ করতে পেরেছিল?’

‘এগুলো কী প্রমাণ হয় রে ভাই? একটা আজগুবি ক্লেইম। কয়েক দিন সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিজের ছবি পাঠাল। প্রতিটা ছবিতে ওই ছাইরঙা শাড়িটা পরা। অফিসে বসা। ওই দিনগুলোতে দুপুরের দিকে ঘন বৃষ্টি নেমেছে। সকালে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা ছিল না। ওই মাসের অন্য দিনগুলোতে বৃষ্টি হয়নি, তা না। হয়েছে। কিন্তু ওর কথা হলো, ও যেদিন শাড়িটা পরেছে, সেদিন অবশ্যই বৃষ্টি হয়েছে, মিস হয়নি।’

‘তাহলে তো প্রমাণ হয়েই গেল।’
‘হা হা হা। তাতে প্রমাণ হয় না মোটেই। শাড়িটা পরা অবস্থায়ও ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমি হাত দিয়ে ধরে দেখেছি। হিসাব করে দেখেছি, ব্যাপারটা খুব সোজা। অরণি, মানে আমার সেই প্রেমিকার নাম অরণি। অরণির অফিসে শাড়ি হলো ফরমাল ড্রেস। সপ্তাহে চার দিন শাড়ি পরতে হয়। জুলাই, আগস্ট মিলিয়ে পাঁচ দিন শাড়িটা পরেছিল ও। ওই কদিনই রাত থেকে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। ভ্যাপসা গরম। বাতাসে প্রচুর আর্দ্রতা।

ওর অন্য শাড়িগুলোর তুলনায় ওই শাড়িটা খুব মিহি, আরামদায়ক। গরমে কমফোর্টেবল বলেই ও বেছে বেছে ওটা পরত। ওই রকম ওয়েদারে বৃষ্টি নামাটাই স্বাভাবিক।’

‘ওহ। ...তো, আপনি কী করলেন? কথাটা তাকে বললেন?’
‘প্রথমেই বলিনি। প্রথম প্রথম মজা করতাম। বলতাম, অরণি, আজ খুব গরম পড়েছে। তোমার বেদেনী শাড়িটা পর তো!’
‘বেদেনী?’

‘ওহ। বলা হয় নাই, তাই না? বেদেনী শাড়ি বলার কারণ, শাড়িটা কেনার ইতিহাস ছিল। তখন নতুন নতুন অফিসে জয়েন করেছে। আলমারিতে তত শাড়ি নেই। যেখানেই যায়, শাড়ি কেনে। এই সময়েই ফুটপাতে একদিন এক বেদেনীর সঙ্গে দেখা। সাপের খেলা দেখাচ্ছিল, সঙ্গে ছোট একটা বাচ্চা... অন্য গল্পে চলে যাচ্ছি, ভাই। আসলে অরণির এত গল্প জমা আমার কাছে! গল্পগুলো কাউকে বলা হয় নাই।’

সেই মুহূর্তে লোকটাকে খুব দুঃখী মনে হলো আর অ্যালকোহলের প্রভাবেই মনে হয় আমি একটা বেমানান উত্তর দিলাম। থেমে থেমে বললাম, ‘আমাকে বলতে পারেন। আমি খুব...ভালো...শুনতে পারি।’

কী যেন চিন্তা করে নিয়ে লোকটা একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ‘কথাগুলো ওকে বললাম। হ্যাঁ। তবে... আসলে এত খোলাখুলি না বললেও পারতাম।

কষ্ট পেল, কেঁদে ফেলল। ইগোতে লেগেছিল তো! তারপর একসময় শান্ত হলো। বলল, মন থেকে যেদিন ইচ্ছা হয় সেদিনই সে শাড়িটা পরে। আমি বোঝালাম, মন সেদিনই চায়, যেদিন সত্যি খুব গরম পড়ে। বৃষ্টির সঙ্গে গরমের সম্পর্ক থাকতে পারে, শাড়ির না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি কখনো শীত কিংবা সুদিং ওয়েদারে শাড়িটা পরেছ?’ সে একটু চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিল, ‘না।’

‘যাই হোক। সেবারের মতো ব্যাপারটা মিটমাট হলো। কারণ, অরণি খুব ইজিগোয়িং মেয়ে ছিল। তাই সব স্বাভাবিক হয়ে এল। কয়েক দিন পর আমরা আউটিংয়ের একটা প্ল্যান করলাম। প্ল্যানটা তারই। বলল, “আসো পূজার ছুটিতে একদিন আমরা সারা দিন নৌকায় ঘুরব। চরের দোকানে চা খাব। বালুতে গড়াগড়ি দেব, সাঁতার কাটব। ব্যাগে কাপড়-চোপড় নিয়ে যাব। পোলাপানের মতো যা মনে আসে করব...।”’

প্রাপ্তবয়স্ক দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা পোলাপানের মতো কী করতে পারে ভাবতে ভাবতে বললাম, ‘তারপর?’
‘ঘোরা হয় নাই, ভাই।’
‘কেন?’
‘সেদিন ওয়েদার নরমাল ছিল। অক্টোবরের ৩ তারিখ। বাতাসে হিউমিডিটি নাই। গরম নাই। বৃষ্টির কোনো ফোরকাস্ট নাই। সকালে দুজন রেডি হয়ে বের হব, তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি নামতে শুরু করল। সেই বৃষ্টি থামাথামির কোনো খবর নাই। বাসার সামনে নৌকা চালানোর মতো পানি জমে গেল। অরণির বাসার অবস্থা আরও খারাপ। এত বৃষ্টিতে কেন সে বাইরে যাবে, সেই প্রশ্নের কোনো যুক্তিসংগত উত্তর নাই। আমার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হলো, তখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আজ ওই শাড়িটা পরেছ? অরণি বলল, “হ্যাঁ।”’
‘বাহ!’
‘হুমম...তবে শাড়ির সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নাই। আশ্বিন মাসে ঝড়বৃষ্টি খুব সাধারণ ব্যাপার।’
‘আচ্ছা... তারপর? আরেক দিন ছুটি কাটালেন আপনারা?’

‘না। আমাদের আর একসঙ্গে কোনো দিন কাটানো হয় নাই। পরপর কয়েকটা ডেট ক্যানসেল হওয়ার পর একসময় প্রেমটাই ভেঙে যায়।’ কথাটা বলে লোকটা আবার কিছু একটা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। তারপর বলল, ‘আসলে কী জানেন? জীবনে আমরা ম্যাজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার আশা করি।

কিন্তু সত্যিকারের ম্যাজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার আমাদের হজম হয় না। অরণির শাড়ির ব্যাপারটা আমার মধ্যে একটা অস্বস্তি তৈরি করেছিল। আধ্যাত্মিকতার প্রতি ওর খুব ঝোঁক ছিল। আমাকেও ও নিজের জীবনে বিরাট একটা প্রাপ্তি মনে করত। হরোস্কোপ নিয়ে মেতে থাকত। এগুলো যে আমার খুব ভালো লাগত, তা না।’

আমি বুঝতে পারলাম না কেউ কাউকে প্রাপ্তি মনে করলে এমন কী সমস্যা। লোকটা তখন বলছে, ‘...কিন্তু আমি অরণিকে খুব মিস করি। বৃষ্টি হলেই গত পাঁচ বছর ধরে প্রথমে আমার মাথায় যে জিনিসটা কাজ করে সেটা হলো, অরণি কি আজ ওই শাড়িটা পরেছে? আরও অনেক কথা মাথায় আসে। বিশেষ করে...’ 
আমি অপেক্ষায় থাকি। ‘বিশেষ করে’ কথাটা লোকটা আর শেষ করে না। সেদিন সারা সন্ধ্যা আর কোনো কথা হয়নি আমাদের। তার সঙ্গে ওই দিনের আগে আমার মাত্র এক বা দুবার দেখা হয়েছিল। এরপর আর দেখা হয়নি। কিন্তু আমার মাথায় অরণি নামের একটা মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে সে। এখন বৃষ্টি হলেই আমি একটা মেঘরং শাড়ি পরা মেয়ের কথা ভাবি। তার মুখ অবশ্য দেখতে পাই না। 

পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে আসা দিনগুলোতে ভাবি, এই বৃষ্টিটা কার? মেঘের, নাকি অরণির? আরও ভাবি, মানুষ প্রেমের মতো যাদুকরি জিনিস পেয়েও কী সব তুচ্ছ কারণে তাকে দূরে ঠেলে দেয়!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত