সেলিম জাহান

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
সেলিম জাহান

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে—যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটি স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সে সাম্যচিন্তায় বিশ্ব মানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন—
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান’।
মানুষকে সম ভালোবাসায়, সম শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূল কথা।
এ শ্রদ্ধা, এ মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতি জোরালোভাবে তিনি বলেছেন—
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কন্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এ সমতা-বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তেও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে—
‘তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষকে শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন—
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
তুমি জান নাকো,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তাঁর পাওনা গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে—
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’
কিন্তু না, সে ঋণ এখনো শোধ হয়নি, হয়নি সে শোষণের অবসান। আজও বহু সমাজে দরিদ্র মানুষের অবস্থান প্রান্তিক, যেখানে বঞ্চনা তাঁদের নিত্য সঙ্গী এবং ভঙ্গুরতা তাঁদের জীবনের বিশাল এক মাত্রিকতা।
শ্রম আর পুঁজির মধ্যকার অসমতা সমাজে একটি অসাম্যের জন্ম দেয়। শ্রমিক সেখানে শোষিত আর পুঁজিপতি সেখানে শোষক। শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়েই গড়ে ওঠে সভ্যতা, আসে উন্নয়ন। আর শ্রমিকের শোষণের মাঝেই বিত্তের সম্পদ গড়ে তোলে পুঁজিপতিরা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই স্বরূপ—অসাম্যই সেখানে নিয়ম। তাই নজরুলের ভাষ্য—
‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এ-সব কাহাদের দান!’
সাম্যবাদী নজরুল সর্বদা শ্রমিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন শ্রমিকের সঙ্গে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকে পুঁজিপতিদের ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা করেছেন শ্রম ও পুঁজির মধ্যকার অসাম্যকে—
‘যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে,
কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?’
ধর্মের আতশ কাচে নজরুল অসাম্যকে দেখেছেন তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মাঝে বিভাজনের দিক থেকে এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুল সব সময়ে বলেছেন, মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। তাই তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ বোধ তাঁর চিন্তাচেতনায় লালন করেছেন, যার জন্য তিনি একদিকে যেমন শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, অন্যদিকে ইসলামি গানও লিখেছেন। মানবতার মহাবাণীকে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে,
‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!’
ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। মানবতার সবচেয়ে বড় বাধা বলে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক নজরুল মানবিক উদারতাকেই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সকল সংকীর্ণতা, সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন—
‘আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!’
প্রথাগত আনুষ্ঠানিক এবং নিয়মসর্বস্ব ধর্ম মানুষের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে। বিভাজিত হন আল্লাহ্-ভগবান-ঈশ্বর; মসজিদ-মন্দির-গির্জা। সেই বিভাজনের হাত ধরেই আসে অসাম্য। নজরুল তাই প্রশ্ন করেন—
‘কে তুমি?-পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত শখ,
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!
কিন্তু ধর্মীয় এই অসাম্যকে আঘাত করে তিনি শুনিয়েছেন সাম্যের বাণী—
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান! ’
ধর্ম শুকনা কেতাবের নয়, নয় পুঁথির, নয় অসার নিয়মের, নয় আনুষ্ঠানিকতার। ধর্ম আবদ্ধ নয় উপাসনালয়ে, তীর্থস্থানে। ধর্মের মূল আধার মানুষের মন, তার হৃদয়। তাই নজরুল অক্লেশে বলতে পারেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
তবে নজরুল সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করেছেন ধর্মের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। যে তথাকথিত ধর্মীয় আচার দরিদ্রকে পদদলিত করে, বুভুক্ষুকে ক্ষুধার্ত রাখে, সে আচার ভণ্ডামি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এ ভণ্ডামি মানুষে-মানুয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, অসাম্যের জন্ম দেয়। এ ভণ্ডামির সূত্র ধরে ধর্মের তথাকথিত রক্ষকেরা ধর্মকে কুক্ষিগত করে। তখন
‘ভুখারী ফুকারি কয়,
ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
কিংবা
‘তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
ধর্মের নামে ভণ্ডামিতে নজরুল ব্যথিত হন। বড় দুঃখে বলেন, ‘হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!’ তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠ তখন বলে, ‘খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!’
নারী-পুরুষের সমতা প্রশ্নে নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি তাঁর চিন্তাচেতনার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। নারীর অধিকার, সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নানা জোরালো বক্তব্য এসেছে কবিতাটিতে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাকে মাতা হিসেবে, কন্যা হিসেবে, বধূ হিসেবে, প্রেয়সী হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে নারীর অবদানকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নারীর শুদ্ধ ‘মনুষ্য-সত্তাকে’ ততটা পরিস্ফুট করেননি তিনি।
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, সমতার এক অনন্য স্তরে নারীকে স্থাপন করেছেন নজরুল। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন—
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
মানব ইতিহাসে নারীর ভূমিকাকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন নজরুল। তাঁর ভাষ্যেও সে কথাটি সুস্পষ্ট।
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নারী-পুরুষের সাম্য বিষয়ে তিনি সামনের দিকে তাকিয়েছেন, সমাজ-সংস্কারের কথা বলেছেন এবং নারীকে বন্দী করে রাখার ফলাফল সম্পর্কে পুরুষকে সাবধান করে দিয়েছেন।
‘সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই! ’
নজরুলের সাম্যচিন্তা প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংগত প্রশ্ন উঠে আসে—বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নজরুলের সাম্যচিন্তা কতখানি প্রাসঙ্গিক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক, সাম্যের মাত্রিকতায় আমাদের সময়ের রূপ ও প্রকৃতি কী রকম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল এবং অবক্ষয়মান পৃথিবীতে বাস করি।
আজকের বিশ্ব সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অসমতার দ্বারা। অসমতা রয়েছে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, অঞ্চলে-অঞ্চলে। অসমতা রয়েছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, নানান নৃতাত্ত্বিক দলের মধ্যে, নানান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে, নারী-পুরুষের মাঝে। অসমতা রয়েছে সুযোগে, অসমতা রয়েছে ফলাফলে। এই অসম পরিবেশে মানুষে-মানুষে বিভাজন বাড়ছে, মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এক উচ্চ মাত্রায় স্থিতু হয়েছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্র পর্যায়ে ক্ষমতার অসমতা একটি অস্থির, অস্থিতিশীল কাঠামোর জন্ম দিয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। জন্ম নিয়েছে সহিংসতা ও সন্ত্রাস। সামাজিক সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে মানবিক সহনশীলতা। এক অর্থে এর ফলে সামাজিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল বিশ্বমানবতার ধারণা, মানবিকতার চিন্তাচেতনা আমাদের পৃথিবী ও সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে একটি সুষম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নজরুলের সর্বজনীন মানবিকতার বোধের কাছে ফিরে যেতে পারি। সেই মানবিকতার বোধ থেকে মানব উন্নয়নের পথযাত্রা শুরু হতে পারে।
ব্যষ্টিক পর্যায়ে নজরুলের সাম্যচিন্তার যে চতুষ্টয় মাত্রিকতার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান সময়ের জন্য অতি প্রাসঙ্গিক। সে মাত্রিকতা নারী-পুরুষের সাম্যবিষয়ক হতে পারে, ধনী-নির্ধনের অসমতা বিষয়ে হতে পারে, কিংবা শ্রমজীবী বনাম পুঁজিপতি বিষয়ে হতে পারে। বহু অগ্রগতি ও অর্জন সত্ত্বেও নারী-পুরুষের বৈষম্য নানা সমাজে এখনো বিদ্যমান—সে অসমতা শুধু ফলাফলের নয়, সুযোগেরও। নজরুলের নারী-পুরুষ বৈষম্য বিষয়ের চিন্তাচেতনা আমাদের সময়ে এ বৈষম্য রোধে একটা বড় ধারণা দিতে পারে।
ধর্মীয় অসাম্য এবং ধর্মীয় ভণ্ডামি সম্পর্কে নজরুলের বিশ্লেষণ আমাদের সময়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ ও সংহিসতা এবং সন্ত্রাস রোধে একটি দিকনির্দেশনার কাজ করতে পারে। আমাদের সময়ে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা এবং সহিংসতার সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধকে বিনষ্ট করছে, সেটাকে প্রতিহত করার জন্যও আমরা নজরুলে ফেরত যেতে পারি।
নজরুলের সাম্যচিন্তা সর্বযুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। কারণ এ চিন্তা মৌলিক সর্বজনীন কিছু মানবিক চিন্তার ওপরে স্থিত। তবে আমি মনে করি যে নজরুলের সাম্যচিন্তার ওপরে আরও আলাপ-আলোচনা, আরও গবেষণা হওয়া দরকার, যাতে আগামী পৃথিবীর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকেন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৪ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৫ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৫ দিন আগেনিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৪ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৫ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৫ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৪ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
১৫ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

হাঙ্গেরির সাহিত্যে অসীম জনপ্রিয়তা ও প্রভাব তাঁর; বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের দাপটেও শিল্পের শক্তি চেনায় তাঁর কলম। তিনি হাঙ্গেরিয়ান ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই; সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আধুনিক হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব লাসলো। অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতার জন্য তাঁর সাহিত্য সমাদৃত হয়েছে। তাঁকে ফ্রানৎস কাফকা ও স্যামুয়েল বেকেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বজোড়া আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের মধ্যেও শিল্পের লেলিহান ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে লাসলোর লেখায়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ের বুকে ফুলের মতো স্থান করে নিল তাঁর সাহিত্য।
লাসলোর জন্য সাহিত্যে এটা প্রথম পুরস্কার নয়, ২০১৪ সালে সাহিত্যকর্মের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার পান তিনি। এ পুরস্কার বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।
লাসলোর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—স্বতন্ত্র শৈলী ও গঠন। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো—মানবতার অবক্ষয়, ধ্বংসের অনিবার্যতা ও আধুনিক জীবনের লক্ষ্যহীন চলন। তাঁর চরিত্রদের মধ্যে প্রায়ই একধরনের হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা যায়; তারা এমন এক জগতের পথিক, যেখানে নৈতিকতা ও আশা বিলীনপ্রায়।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ নামে প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি পান লাসলো। এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন ও পতিত এক কৃষি সমবায় গ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে একধরনের বিভ্রম ও আশার জন্ম দেয় এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমনে। এই উপন্যাস অবলম্বনে একই শিরোনামে সাত ঘণ্টার কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন বিখ্যাত পরিচালক বেলা টর।
লাসলোর আরেকটি ফিকশন উপন্যাস হলো— ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’। হাঙ্গেরির এক কাল্পনিক শহরের জীবন ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। সামুদ্রিক প্রাণী হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যকার উন্মাদনা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও একনায়কতন্ত্রের উত্থানের চিত্র আঁকা হয়েছে তাতে।
‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লাসলোর আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। লম্বা লম্বা বাক্যে লেখা এই উপন্যাস লাসলোর শৈলী নিয়ে পাঠকদের নতুন করে ভাবায়। উপন্যাসের নায়ক একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বের চূড়ান্ত ধ্বংসের একটি কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
এবার লাসলোকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার নেপথ্যে নোবেল কমিটির বড় কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যে শিল্পের জয়ধ্বনি তোলার প্রচেষ্টা। যখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধের জন্য উৎসুক, তখন বারবার শিল্পের মোহিনী প্রেম ও বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় লাসলোর সাহিত্য।

কবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
২৫ মে ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
৪ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
৯ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১৫ দিন আগে