ড. তাহা ইয়াসিন
বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে নজরুল অন্যতম। সাধারণত জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের বেলায় দেখা যায় কালের সীমা অতিক্রম করলে তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় আর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নজরুলের জীবন ও সাহিত্য কালের সীমা অতিক্রম করে আজও পাঠকপ্রিয় হয়ে আছে। এর মূলে রয়েছে তাঁর সচেতন জীবনবোধ। তিনি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চিন্তাকে যুগ-মানসে ধারণ করেছিলেন। সমকালে মানুষের অন্তরের আকৃতিকে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ছিলেন গতিময়তার প্রতীক এবং জীবন-যাপনে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর কালে যৌবনদীপ্ত তারুণ্যের এমন নজির আর নেই। স্বদেশের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছিলেন নির্ভীক। সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন আপসহীন। অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবী শাসনদণ্ডের কাছে যেমন সর্বকালে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, নজরুল ছিলেন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে ঘোষণা করেছিলেন ‘উন্নত মম শির’। তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন, সংগ্রামী, গণবাদী ও সাম্যবাদী কবি। তাঁর পূর্বে সাহিত্য-সংস্কৃতি, শাস্ত্র ও সমাজ-সংস্কারমূলক রচনা আর কারও মাধ্যমে ফুটে ওঠেনি। সাহিত্যকে তিনি সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সারা দেশে বিশ ও ত্রিশের দশকে রাজনৈতিক যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে সে আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সরাসরি রাজনৈতিক ফ্রন্টে না থেকে সাহিত্য রচনার মাধ্যমেও যে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করা যায়, তিনি তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগে অনেক সাহিত্যিকের গ্রন্থ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কিন্তু তাদের কাউকে জেল খাটতে হয়নি। নজরুলের অনেক গ্রন্থ ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। গ্রন্থ নিষিদ্ধ হওয়া ছাড়াও একটি কবিতার (আনন্দময়ীর আগমনে) জন্য তিনি পুরো এক বছর জেল খাটেন।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ বিশ শতকের অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ বাঙালি মানসের প্রোজ্জ্বল প্রতীক। নতুন আবেগের রূপায়ণে পুরোনো আঙ্গিক ও ভাষার অকিঞ্চিৎকরতা শিল্পীকে দুঃসাহসী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে। বিদ্রোহীর ‘আমি’ কেবল কৰি নিজে নন বরং কোনো উদ্দিষ্ট শ্রোতার আত্মশক্তিই বিদ্রোহীর কেন্দ্রীয় বিষয়। এই উদ্দিষ্ট তাঁর সমকালীন সমাজ। ব্যাপক বিদ্রোহের ভেতরে যার জাগরণ সে জাগরণ তিনি কামনা করেছিলেন। উৎপীড়কের উৎখাত এবং উৎপীড়িতের মুক্তি হলেই সংগ্রাম শেষ হবে, অন্যথায় নয়। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি বিদ্রোহীতে দিয়েছেন।
তিনি ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’ পত্রিকা পরিচালনা করেন। সাংবাদিক হিসেবেও কবিকে দেখা যায় কাব্যিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সাংবাদিক হিসেবে। সংবাদ শিরোনাম, বিজ্ঞাপনের ভাষা, সংবাদ সংক্ষিপ্তকরণ এবং জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লেখার কৌশল তাঁকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোর মাঝেও তাঁর দেশমাতৃকার নানা সমস্যাবলি উদ্ঘাটিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর আবেদন কালোত্তীর্ণ হয়ে আজও সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। নতুন করে জেগে উঠতে চেতনার সঞ্চার করে। বাঙালি পল্টনে থাকার সময় নজরুল রুশ বিপ্লব সম্পর্কে জেনেছিলেন। করাচির সেনা ব্যারাকে তিনি রুশ বিপ্লবের ঘটনাবলিসংবলিত বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা জোগাড় করে গোপনে পড়তেন। সেই প্রভাবও সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবনে পড়ে। তিনি শ্রমিকশ্রেণির শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘দি লেবার স্বরাজ পার্টি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি দল গঠন করেন এবং সেটির মুখপাত্র হিসেবে ‘লাঙল’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। এই পার্টির স্বার্থে তিনি নিদারুণ আর্থিক দুর্দশাও সহ্য করেন। এই পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের অনুবাদ, কার্ল মার্ক্সের জীবনী এবং অনুবাদ করেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। শুধু দল গঠন, পত্রিকা প্রকাশ করেই তিনি থেমে থাকেননি, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনও করেন। সমস্ত ঢাকা বিভাগ অর্থাৎ ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার জন্য দুটি মুসলিম আসন সংরক্ষিত ছিল। এই আসনে মুসলমান ভোটাররাই কেবল ভোট দিতে পারতেন। তখন সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার দেওয়া হতো। ‘ভোটার ছিলেন মোট ১৮,১১৬ জন।’ ভোটার ছিলেন সম্পদশালী মুসলমানেরা। এরা নজরুলের লেখায় খুশি ছিলেন না বরং তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়েছিলেন। ফলে ঘটনা যা হওয়ার তাই হয়। শেষ পর্যন্ত নজরুলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
মুসলমান সমাজের গোঁড়ামিকে আঘাত করার জন্য গোঁড়া মুসলমানেরা তাঁকে পছন্দ করতেন না। বিত্তশালী ভোটারদের ভোটে তাঁদেরই প্রার্থী বরিশালের জমিদার ইসমাইল চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে নাইট উপাধি পাওয়া আবদুল হালিম গজনবি জয়লাভ করেন। এরপর নজরুল কৃষ্ণনগরে ফিরে গিয়ে দেখেন আর্থিক অনটনে স্ত্রী-পুত্রের জীবন ওষ্ঠাগত। সেই পরিস্থিতিকে সর্বংসহা শাশুড়ি প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে সামাল দেন। নজরুল এই দুর্দিনে লেখেন ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি। নিষ্ঠুর বাস্তবের নির্মম কশাঘাত তাঁকে সাহায্য করেছিল মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরতে। সর্বকালেই নিঃসঙ্গ, একলা মানুষ অসহায়। নজরুল লেখনী ধারণ করেছিলেন শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির এবং জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে। এ জন্য তিনি বসে বসে শুধু লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক দল গঠন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এসব কাজের মাধ্যমে জনমানুষের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন। চেষ্টা তিনি কোনো দিক থেকে কম করেননি। কিন্তু প্রতিভাবান এবং জনস্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ জনগণের কাছে প্রিয় হন খুব কম। এসবের পরেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় কবি।
অভাব-অনটন ছিল তাঁর চিরসাথি। কিন্তু মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল প্রগাঢ়। অভাব ছিল সংসারে অথচ হৃদয় ছিল পূর্ণ, মনে ছিলেন ঐশ্বর্যশালী। অর্থকে তিনি গ্রাহ্য করেননি এবং অর্থের প্রতি তাঁর মোহ ছিল না। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি স্নেহ এবং শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি ছিলেন আদর্শ পুরুষ। সাহিত্যিক মহলে তিনি বিদ্রোহী কবি আর সংগীতজগতে ছিলেন সবার কাজীদা বলে পরিচিত। বিশ্বাসে এবং আচরণে তিনি ছিলেন আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ।
চিন্তায় নজরুল যেমন ছিলেন মুক্ত মানুষ, তেমনি বাস্তবজীবনেও ছিলেন উদার।
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠজনদের একজন। তিনি নজরুল সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তাও চমৎকার, ‘চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো সে পেয়ালা খালি নেই প্রাণের অরুণরসে সদাই ভরপুর। গলাটি সারসের মত পাতলা নয়, পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সবল, বীর্য-ব্যঞ্জক। গলার স্বরটি ছিল ভারী, গলায় যে সুর খেলত বেশি তা বলতে পারিনে, কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে ছিল জাদু।...স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর দেহ, ছন্দোময় পদক্ষেপ, বহুজনের মধ্যে তাঁকে দূর থেকে চেনা যায় যে এ মানুষ সাধারণ মানুষ নয়। হাসির ঝলকে আসর জমিয়ে রাখেন একাই, আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করেন। কেউ তাঁকে কখনো হতাশ, বিপদগ্রস্ত দেখেছেন বলেন না। একমাত্র তাঁরা বলেছেন যাঁরা স্ত্রীর অসুখের সময় চিকিৎসার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে দেখেছেন, পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে দেখেছেন। তা না হলে কাজী নজরুলকে মনে করলে হাসিখুশি, দরদী, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একজন মানুষের চেহারা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে।’
তাঁকে নিয়ে আলোচনার শেষ ছিল না, অনেক রটনাও ছিল। বন্ধুর যেমন শেষ ছিল না, ঈর্ষাকাতর লোকও কম ছিল না। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে ঈর্ষাকাতর মন্তব্য করেছেন, ‘শনিবারের চিঠি’ তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনায় লিখেছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। নজরুলের জীবনবোধ এবং চিন্তাধারার সহজ গতি, আবেগের আগুনভরা কবিতা, মানুষের হৃদয়ভরা গান বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কারও মাঝে দেখা যায় না। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনেক বড়, মানবতার জয়গান গেয়েছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে সেই আদর্শ বজায় রেখেছিলেন। তাই বাংলা সাহিত্যে নজরুল স্বতন্ত্র ও অনন্য।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে নজরুল অন্যতম। সাধারণত জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের বেলায় দেখা যায় কালের সীমা অতিক্রম করলে তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় আর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নজরুলের জীবন ও সাহিত্য কালের সীমা অতিক্রম করে আজও পাঠকপ্রিয় হয়ে আছে। এর মূলে রয়েছে তাঁর সচেতন জীবনবোধ। তিনি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চিন্তাকে যুগ-মানসে ধারণ করেছিলেন। সমকালে মানুষের অন্তরের আকৃতিকে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ছিলেন গতিময়তার প্রতীক এবং জীবন-যাপনে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর কালে যৌবনদীপ্ত তারুণ্যের এমন নজির আর নেই। স্বদেশের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছিলেন নির্ভীক। সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন আপসহীন। অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবী শাসনদণ্ডের কাছে যেমন সর্বকালে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, নজরুল ছিলেন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে ঘোষণা করেছিলেন ‘উন্নত মম শির’। তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন, সংগ্রামী, গণবাদী ও সাম্যবাদী কবি। তাঁর পূর্বে সাহিত্য-সংস্কৃতি, শাস্ত্র ও সমাজ-সংস্কারমূলক রচনা আর কারও মাধ্যমে ফুটে ওঠেনি। সাহিত্যকে তিনি সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সারা দেশে বিশ ও ত্রিশের দশকে রাজনৈতিক যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে সে আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সরাসরি রাজনৈতিক ফ্রন্টে না থেকে সাহিত্য রচনার মাধ্যমেও যে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করা যায়, তিনি তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগে অনেক সাহিত্যিকের গ্রন্থ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কিন্তু তাদের কাউকে জেল খাটতে হয়নি। নজরুলের অনেক গ্রন্থ ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। গ্রন্থ নিষিদ্ধ হওয়া ছাড়াও একটি কবিতার (আনন্দময়ীর আগমনে) জন্য তিনি পুরো এক বছর জেল খাটেন।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ বিশ শতকের অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ বাঙালি মানসের প্রোজ্জ্বল প্রতীক। নতুন আবেগের রূপায়ণে পুরোনো আঙ্গিক ও ভাষার অকিঞ্চিৎকরতা শিল্পীকে দুঃসাহসী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে। বিদ্রোহীর ‘আমি’ কেবল কৰি নিজে নন বরং কোনো উদ্দিষ্ট শ্রোতার আত্মশক্তিই বিদ্রোহীর কেন্দ্রীয় বিষয়। এই উদ্দিষ্ট তাঁর সমকালীন সমাজ। ব্যাপক বিদ্রোহের ভেতরে যার জাগরণ সে জাগরণ তিনি কামনা করেছিলেন। উৎপীড়কের উৎখাত এবং উৎপীড়িতের মুক্তি হলেই সংগ্রাম শেষ হবে, অন্যথায় নয়। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি বিদ্রোহীতে দিয়েছেন।
তিনি ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’ পত্রিকা পরিচালনা করেন। সাংবাদিক হিসেবেও কবিকে দেখা যায় কাব্যিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সাংবাদিক হিসেবে। সংবাদ শিরোনাম, বিজ্ঞাপনের ভাষা, সংবাদ সংক্ষিপ্তকরণ এবং জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় লেখার কৌশল তাঁকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোর মাঝেও তাঁর দেশমাতৃকার নানা সমস্যাবলি উদ্ঘাটিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর আবেদন কালোত্তীর্ণ হয়ে আজও সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। নতুন করে জেগে উঠতে চেতনার সঞ্চার করে। বাঙালি পল্টনে থাকার সময় নজরুল রুশ বিপ্লব সম্পর্কে জেনেছিলেন। করাচির সেনা ব্যারাকে তিনি রুশ বিপ্লবের ঘটনাবলিসংবলিত বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা জোগাড় করে গোপনে পড়তেন। সেই প্রভাবও সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবনে পড়ে। তিনি শ্রমিকশ্রেণির শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘দি লেবার স্বরাজ পার্টি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি দল গঠন করেন এবং সেটির মুখপাত্র হিসেবে ‘লাঙল’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। এই পার্টির স্বার্থে তিনি নিদারুণ আর্থিক দুর্দশাও সহ্য করেন। এই পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের অনুবাদ, কার্ল মার্ক্সের জীবনী এবং অনুবাদ করেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। শুধু দল গঠন, পত্রিকা প্রকাশ করেই তিনি থেমে থাকেননি, ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনও করেন। সমস্ত ঢাকা বিভাগ অর্থাৎ ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার জন্য দুটি মুসলিম আসন সংরক্ষিত ছিল। এই আসনে মুসলমান ভোটাররাই কেবল ভোট দিতে পারতেন। তখন সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার দেওয়া হতো। ‘ভোটার ছিলেন মোট ১৮,১১৬ জন।’ ভোটার ছিলেন সম্পদশালী মুসলমানেরা। এরা নজরুলের লেখায় খুশি ছিলেন না বরং তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়েছিলেন। ফলে ঘটনা যা হওয়ার তাই হয়। শেষ পর্যন্ত নজরুলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
মুসলমান সমাজের গোঁড়ামিকে আঘাত করার জন্য গোঁড়া মুসলমানেরা তাঁকে পছন্দ করতেন না। বিত্তশালী ভোটারদের ভোটে তাঁদেরই প্রার্থী বরিশালের জমিদার ইসমাইল চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে নাইট উপাধি পাওয়া আবদুল হালিম গজনবি জয়লাভ করেন। এরপর নজরুল কৃষ্ণনগরে ফিরে গিয়ে দেখেন আর্থিক অনটনে স্ত্রী-পুত্রের জীবন ওষ্ঠাগত। সেই পরিস্থিতিকে সর্বংসহা শাশুড়ি প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে সামাল দেন। নজরুল এই দুর্দিনে লেখেন ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি। নিষ্ঠুর বাস্তবের নির্মম কশাঘাত তাঁকে সাহায্য করেছিল মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরতে। সর্বকালেই নিঃসঙ্গ, একলা মানুষ অসহায়। নজরুল লেখনী ধারণ করেছিলেন শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির এবং জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে। এ জন্য তিনি বসে বসে শুধু লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক দল গঠন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এসব কাজের মাধ্যমে জনমানুষের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসেন। চেষ্টা তিনি কোনো দিক থেকে কম করেননি। কিন্তু প্রতিভাবান এবং জনস্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ জনগণের কাছে প্রিয় হন খুব কম। এসবের পরেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় কবি।
অভাব-অনটন ছিল তাঁর চিরসাথি। কিন্তু মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল প্রগাঢ়। অভাব ছিল সংসারে অথচ হৃদয় ছিল পূর্ণ, মনে ছিলেন ঐশ্বর্যশালী। অর্থকে তিনি গ্রাহ্য করেননি এবং অর্থের প্রতি তাঁর মোহ ছিল না। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি স্নেহ এবং শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধায় তিনি ছিলেন আদর্শ পুরুষ। সাহিত্যিক মহলে তিনি বিদ্রোহী কবি আর সংগীতজগতে ছিলেন সবার কাজীদা বলে পরিচিত। বিশ্বাসে এবং আচরণে তিনি ছিলেন আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ।
চিন্তায় নজরুল যেমন ছিলেন মুক্ত মানুষ, তেমনি বাস্তবজীবনেও ছিলেন উদার।
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠজনদের একজন। তিনি নজরুল সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তাও চমৎকার, ‘চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো সে পেয়ালা খালি নেই প্রাণের অরুণরসে সদাই ভরপুর। গলাটি সারসের মত পাতলা নয়, পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সবল, বীর্য-ব্যঞ্জক। গলার স্বরটি ছিল ভারী, গলায় যে সুর খেলত বেশি তা বলতে পারিনে, কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে ছিল জাদু।...স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর দেহ, ছন্দোময় পদক্ষেপ, বহুজনের মধ্যে তাঁকে দূর থেকে চেনা যায় যে এ মানুষ সাধারণ মানুষ নয়। হাসির ঝলকে আসর জমিয়ে রাখেন একাই, আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করেন। কেউ তাঁকে কখনো হতাশ, বিপদগ্রস্ত দেখেছেন বলেন না। একমাত্র তাঁরা বলেছেন যাঁরা স্ত্রীর অসুখের সময় চিকিৎসার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে দেখেছেন, পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে দেখেছেন। তা না হলে কাজী নজরুলকে মনে করলে হাসিখুশি, দরদী, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একজন মানুষের চেহারা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে।’
তাঁকে নিয়ে আলোচনার শেষ ছিল না, অনেক রটনাও ছিল। বন্ধুর যেমন শেষ ছিল না, ঈর্ষাকাতর লোকও কম ছিল না। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে ঈর্ষাকাতর মন্তব্য করেছেন, ‘শনিবারের চিঠি’ তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনায় লিখেছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। নজরুলের জীবনবোধ এবং চিন্তাধারার সহজ গতি, আবেগের আগুনভরা কবিতা, মানুষের হৃদয়ভরা গান বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কারও মাঝে দেখা যায় না। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনেক বড়, মানবতার জয়গান গেয়েছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে সেই আদর্শ বজায় রেখেছিলেন। তাই বাংলা সাহিত্যে নজরুল স্বতন্ত্র ও অনন্য।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকর্মকে ‘বুর্জোয়া’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করা হয় চীনে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শেকসপিয়ারের সব সাহিত্যকর্ম—যেমন হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, ওথেলো ইত্যাদি—চীনে নিষিদ্ধ হয়, কারণ সেগুলোতে চীনা কমিউনিস্ট আদর্শের ‘সঠিক রাজনৈতিক
৮ দিন আগেকবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
৮ দিন আগেনজরুলকে ভুল ভাবে পড়ার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো তাঁকে প্রায়শই রবীন্দ্রনাথের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে দাঁড় করানোর রাজনৈতিক প্রবণতা। এই আইডেনটিটি পলিটিকস শুধু বিভাজন তৈরি করে না, নজরুলের মৌলিক অবস্থানকেও বিকৃত করে।
৯ দিন আগেভারতের কর্ণাটক রাজ্যের লেখিকা, আইনজীবী ও সমাজকর্মী বানু মুশতাক তাঁর ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’—এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতে ইতিহাস তৈরি করেছেন। কন্নড় ভাষায় লেখা প্রথম বই হিসেবে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেল ‘হার্ট ল্যাম্প।’ বইটির গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসথি...
১২ দিন আগে