Ajker Patrika

ফেসবুকের নীতি একই থাকছে

আনিকা জীনাত
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২১, ১১: ৩৪
Thumbnail image

কয়েক বছর পরেই মানুষ ভিআর হেডসেট পরে অফিস করবেন। বাসে ঝুলে ও হেঁটে আর অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। ভার্চুয়াল জগৎকে বাস্তবতার আরও কাছাকাছি আনবে মেটাভার্স দুনিয়া। ফলে মিটিং, প্রেজেন্টেশন ও অফিসের কাজ করতে জুম, মাইক্রোসফট টিমস ও টিম ভিউয়ার অ্যাপের প্রয়োজন হবে না। এগুলো হয়ে যাবে পুরোনো।
প্রযুক্তি বিশ্বের পরিবর্তন যে খুব দ্রুত ঘটে, এ কথা ফেসবুকের চেয়ে ভালো আর কে জানে?

জাকারবার্গ দূরদর্শী বলেই ঘরে বসেও ভার্চুয়াল মিটিং করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তি যত উন্নত হবে আমাদের চলাফেরাও তত কমে যাবে। আপাতদৃষ্টিতে এর খারাপ দিক নেই। কিন্তু ফেসবুক যে কথা জানিয়েছে, তা ভ্রু জোড়াকে কুঁচকে দিচ্ছে। নিজেদের গায়ে লেগে থাকা কালি মুছতে তারা সাবান ব্যবহার করছে না; বরং তার ওপরে নতুন করে সাদা শার্ট চাপাচ্ছে। এতে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। তারা এবারও ঘোষণা করেছে, নাম পরিবর্তন হলেও তাদের ব্যবসায়িক কৌশল বদলাচ্ছে না।

সাধারণ এ কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই দশকের ভয়ংকরতম সত্য। গত বছরের জানুয়ারিতে ফেসবুকের ভেতরের অনেক গোপন কথা বেরিয়ে আসে ‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’ নামের এক নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টরিতে।

এই ডকুমেন্টরি এখন ইউটিউবেও আছে। দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করে দেখার পর সাময়িকভাবে ফেসবুককে এক দানব বলে মনে হবে। সিলিকন ভ্যালির নামীদামি প্রযুক্তিবিদেরা সেখানে জানিয়েছেন, বিবেকের দংশনে তাঁরা ফেসবুকের চাকরি ছেড়েছেন। কেন? ফেসবুকে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা সবাই কি অপেশাদার বা ব্যক্তি হিসেবে খারাপ? উত্তরে তাঁরা জানিয়েছেন, সেখানে একজনও খারাপ মানুষ নেই। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যাটা কী তা ফেসবুকের নিউজফিডে আসা খবরের লিঙ্কের কমেন্ট বক্সে চোখ বোলালেই বুঝতে পারবেন। কত ঘৃণা! কত বিদ্বেষ! নিজের মতামত অন্যের ওপর চাপানোর তীব্র এক লড়াই সেখানে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না।

এই ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং নিজের মতামতকেই সঠিক বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা তৈরির জন্য ফেসবুক দায়ী। হ্যাঁ, সরাসরি দায়টা তাদের ওপরেই যায়। ফেসবুকের প্রতিটি ব্যবহারকারীর একটি অবতার আছে। যে তথ্য ফেসবুক আমাদের সম্পর্কে নেয়, সেগুলোই ব্যবহার করে এই ভার্চুয়াল অবতার তৈরি করে। এই অবতারকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করে এনগেজমেন্ট, গ্রোথ ও অ্যাডভার্টাইজিং বিভাগের জন্য তৈরিকৃত তিন অ্যালগরিদম। ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ সময় ধরে রাখার জন্যই এগুলো বানিয়েছে ফেসবুক।

আপনার, আমার সম্পর্কে ফেসবুকের হাতে কী পরিমাণ তথ্য আছে, সে ধারণা কারও নেই। কোন পোস্টগুলো কতক্ষণ দেখছেন, সে তথ্যও ফেসবুকের এআইয়ের কাছে আছে। ফলে যে বিষয়গুলোতে আপনার অনেক আগ্রহ, সেসব বিষয় সম্পর্কিত পোস্টই ঘুরেফিরে নিউজফিডে আসবে। উসকানিমূলক ভিডিও দেখতে থাকলে বারবার সেগুলোই আসবে। এতে আবার ভেবে বসবেন না যে সবার নিউজফিড একই রকমের। আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নিউজফিডেও যা আসে তা আপনারটা থেকে অনেকটাই আলাদা। যে তরুণ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে মরিয়া, সে কিন্তু উসকানিমূলক ভিডিওর পোস্ট সচরাচর দেখবে না। প্রত্যেকের রুচি ও পছন্দ অনুমান করতে পারে ফেসবুকের এআই। এআই শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে একেকজনকে একেক রকম পোস্ট দেখায়। ভালো কিংবা মন্দ বিচারের ক্ষমতা এর নেই। ফলে মার্ক জাকারবার্গের এআই দিয়ে গুজব ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি যে ভুয়া, তা জোরেশোরেই বলেছেন প্রযুক্তিবিদেরা।

কে কোনটা দেখবে, তা অনুমানের ওপর নির্ভর করেই চলে বিজ্ঞাপন-বাণিজ্য। ফেসবুক আপনাকে যত বেশি ধরে রাখবে, তত বেশি বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ তৈরি হবে। তেতো সত্যি হলো, বিজ্ঞাপনদাতারাই ফেসবুকের আসল গ্রাহক। তাদের খুশি করার জন্য ব্যবহারকারীদের পরীক্ষাগারের ইঁদুর তো বানানোই যায়। আয়ের এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি!
আপনার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে তারা নজর রাখে। আপনি চুপচাপ নাকি বাচাল, হতাশ নাকি উচ্ছল, গভীর রাতে কী করেন, সাবেক প্রেমিক বা প্রেমিকার ছবিতে ঢুঁ মারেন কি না, সে তথ্যও জানে এআই। তবে এই তথ্য বিক্রি করা ফেসবুকের উদ্দেশ্য নয়।

এগুলো ব্যবহারে করে এআইকে আরও শক্তিশালী করে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য। এআই যত বেশি তথ্য পাবে অনুমান তত বেশি নির্ভুল হবে। ফেসবুক স্ক্রলের সময় প্রতি ৫টি বা ৬টি পোস্ট পর পর যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখেন সেগুলো হঠাৎ করে আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। আপনার পছন্দ, আগ্রহ ও রুচি জেনেই সেগুলোকে সামনে আনা হয়। ফলে এসব পোস্ট দেখতে দেখতে দিনের কত ঘণ্টা চলে যায় তা কেউ বুঝতেও পারে না। যেন কোনো ম্যাজিক আমাদের বুঁদ করে রেখেছে। ফেসবুকেরই এক কর্মী বাসায় এসে ফেসবুকে বেশি সময় দিতেন। ছোট ছোট দুই বাচ্চার সঙ্গে খেলার কথা মনে হলেও সেটা করা হয়ে উঠত না। অথচ ফেসবুকের এই ‘ম্যাজিক স্পেল’ সম্পর্কে তাঁর খুব ভালো ধারণা ছিল।

ফেসবুকের সাবেক কিছু কর্মীর আশঙ্কা, মানুষ যেভাবে উগ্র হয়ে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। এই আশঙ্কার খানিকটা যে সত্যি, তার প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। ভিআর সেট পরে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ, বিনোদনের সুযোগ, কেনাকাটা, অফিসের কাজ সবই অনেক সহজে হবে। অন্যদিকে, কোন বিষয়গুলো আরও কঠিন হবে, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত