Ajker Patrika

এ দেশ কার জন্য অভয়ারণ্য হবে

মামুনুর রশীদ
২০২২ সালেও ধনবাড়ীর অভয়ারণ্য পাঠাগারটি আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। ছবি: সংগৃহীত
২০২২ সালেও ধনবাড়ীর অভয়ারণ্য পাঠাগারটি আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারে আক্রমণ চালিয়ে কিছু ব্যক্তি সব বইপুস্তক নিয়ে যায়। তাদের ইচ্ছে ছিল আগুন দিয়ে লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসারের হস্তক্ষেপে লাইব্রেরিটি ভস্মীভূত হওয়া থেকে মুক্তি পায়। অতঃপর বইপুস্তকগুলো উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে সমাজের চাপে সেগুলো আবার ফেরত দেয়। কিন্তু যারা এই কাজটি করেছিল, তারা বলেছে রবীন্দ্রনাথ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং প্রথম আলো নাস্তিক তৈরির কারখানা; তাঁদের বিরুদ্ধে গুরুতর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই প্রতিরোধ কীভাবে গড়ে উঠবে, কারা প্রতিরোধ করবে, তা আমাদের সবারই জানা। কয়েক মাস ধরে এই পরিস্থিতি চলছে এবং মবের মাধ্যমে বিষয়গুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে।

আমরা জানি, সভ্যতার ক্রমবিকাশে লাইব্রেরির একটি ভূমিকা আছে। লাইব্রেরির ধারণা না এলে পৃথিবীর কালজয়ী সব দর্শনশাস্ত্র গ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ, পবিত্র কোরআন—কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকত না। যদিও সব সময়ই যুদ্ধবাজ আক্রমণকারীরা যেকোনো শহর ধ্বংস করার আগেই লাইব্রেরি ধ্বংস করাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে মনে করে। সাম্প্রতিককালে ইরাকের বাগদাদের লাইব্রেরিটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ধ্বংস করেছে এবং সেখানে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সব দলিল, হাতে লেখা কোরআন শরিফ—এসব মহামূল্যবান জ্ঞানভান্ডার ছিল, সেগুলো ভস্মীভূত হয়ে গেছে। জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে অমানবিকতার শক্তি সব সময়ই সক্রিয় ছিল। এবারেও সেই ঘটনার ব্যত্যয় ঘটেনি। অনেক লাইব্রেরি এবং মূল্যবান দলিল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, শিল্প-সাহিত্যের ওপরও আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। কোথাও মিলনায়তন কর্তৃপক্ষকে তৌহিদি জনতার নামে চিঠি দিয়ে নাট্যানুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। মবের প্রতি মানুষের একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বহু কায়ক্লেশে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলেছে। কিছু জ্ঞানচর্চার কর্মী এই লাইব্রেরিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করে শিশু, কিশোর, তরুণ ও বয়স্ক মানুষের একটি জ্ঞানভান্ডার তৈরির চেষ্টা করছে। বহু বছর ধরেই এই চেষ্টাকে নানাভাবে প্রতিহত করার জন্য এলাকার প্রভাবশালী মানুষেরা অপচেষ্টা করে চলেছে। এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে গত সরকারও তেমনভাবে কোনো বাধা প্রদান করেনি। রাজনৈতিক শক্তি এটা বুঝতে শিখেছে যে জ্ঞানের চোখটা খুলে গেলে আদর্শহীন রাজনীতির জন্য একটা সমস্যা হবে। মানুষের কাছে সমাজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য গেলে মানুষ আলোচনামুখর হয়ে পড়বে এবং কালক্রমে এইসব জ্ঞানচর্চা তাদের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বাংলাদেশে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই ধনবাড়ীর জমিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় অবদান রেখেছিলেন। আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হল বা বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সক্রিয় সমর্থন পাওয়া যায়। রাজনীতি, জ্ঞানচর্চা, বয়নশিল্পের প্রসারের বিষয়ে টাঙ্গাইলের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। অনেক রাজনীতিক, কবি, বুদ্ধিজীবী অধ্যুষিত এই জেলা একদা জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এখন জ্ঞানচর্চার অভাবে স্কুল, কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও একধরনের নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকা পালন করেন। টাঙ্গাইল এখন শিক্ষার ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টার, ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতির ক্ষেত্র এবং দুষ্ট রাজনীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

এককভাবে এটি যে টাঙ্গাইলেই ঘটছে তা নয়, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিষয়টি এখন ধ্বংসাত্মক পথে চলে গেছে। কিন্তু তার আগে ছিল জ্ঞানচর্চার শূন্যতা। আসলে এই শূন্যতার সূচনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। স্কুল-কলেজে নকলের দৌরাত্ম্য, কালে কালে পেশিশক্তির আবির্ভাব এবং সরাসরি ক্ষমতাসীন দলগুলোর স্কুল-কলেজে ম্যানেজিং কমিটি দখলের পাঁয়তারা হয়ে আসছে। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট, ইউটিউব, টিকটক এই মাধ্যমগুলো মানুষকে পাঠবিমুখ করে তুলছে। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় গণমাধ্যমের প্রবল উন্নতির মুখেও মানুষের পাঠপ্রবণতা কমেনি বরং বেড়েছে। কারণ, অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের চেয়ে ওই পাঠের মাধ্যমে যে জ্ঞান, সেটি নানা কারণে অনেক বেশি ফলপ্রসূ এবং স্থায়ী হয়।

অনেক দেশেই সারা বছর ধরে নতুন নতুন প্রকাশনা হয় এবং একুশের বইমেলার মতোই বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলো চলতে থাকে। সেই মেলাগুলোতে যে পরিমাণ বই বিক্রি হয় তাতে প্রতিবছরই আগের বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বইমেলাও রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে আমাদের দেশে। ক্ষমতাসীন সরকারের অপছন্দের কোনো প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত হয়ে থাকে, প্রকাশকের ওপর খড়্গ নেমে আসে, এমনকি বইমেলার স্টলেও আক্রমণ চলে। এই প্রবণতা খুব দ্রুত সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে, তাতে পেশিশক্তির জন্য একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এ রকম যে ছাত্রদের একমাত্র পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য কিছু পড়ার বা ভাববার অবকাশ থাকে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কোনো ছাত্র দেখি না, সবাই পরীক্ষার্থী।’ শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি শুধু পরীক্ষা পাস হয়ে দাঁড়ায় তাহলে জ্ঞানচর্চার সুযোগটা কোথায়? এই পরীক্ষার মাধ্যমে বছরে লাখ লাখ অশিক্ষার নায়কের জন্ম হবে। কিন্তু সত্যিকার ছাত্র, জ্ঞানে, গুণে, মনুষ্যত্বে যারা সমাজে অবদান রাখতে পারবে, তাদের সংখ্যা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদের মধ্যে অত্যন্ত দুঃখজনক হারে লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসা কমে গেছে। আসলে তাদের দোষই-বা কোথায়? ক্লাস করার আগে এবং পরে কোচিং সেন্টারে গিয়ে একেবারেই আনন্দহীন শিক্ষাক্রম তাদের জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। যারা এই লাইব্রেরি আন্দোলনের বিরোধিতা করে থাকে, তাদের আসলেই এই আনন্দহীন, অজ্ঞতার মধ্য থেকে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য একেবারেই বোঝানো যায়নি। তাই তাদের কাছে লাইব্রেরির প্রয়োজনটাও জীবনের কোনো পর্যায়ে উপলব্ধির মধ্যে আসেনি।

লাইব্রেরিবিমুখতা কোনো জাতির জন্য একটি বড় ধরনের অশনিসংকেত। কিন্তু দেশের শাসকগোষ্ঠী এই সমস্যাকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। বরং তারা ছাত্রদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির প্রভাব কতটা, সেটা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। এই ব্যস্ততা এবং অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার ফলে ছাত্ররাজনীতি দুর্নীতির মুখে পড়ে যায়। জাতীয় রাজনীতি যেমন অর্থ উপার্জনের একটা মাধ্যম, ঠিক তেমনি ছাত্ররাজনীতিও অর্থ উপার্জনের একটা মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তার একটা ভয়াবহ সংকট আমরা দেখেছি এবং সেই সংকটের অবসান এখনো হয়নি। বরং ভবিষ্যতে আমাদের স্বপ্নের আকাশটি আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখতে পাচ্ছি।

ছাত্রদের লাইব্রেরিমুখী করা এবং পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার প্রেরণা সৃষ্টি করা একটা বড় ব্যাপার। সেই বড় ব্যাপারটি রাজনীতিকেরা বুঝতে চান না। কারণ, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের মধ্যে থেকে গেছে। এটা শুধু রাজনীতিকদের ব্যাপারে নয়, আমাদের শিল্পের জগতেও অশ্রম এবং চর্চাহীন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছেন শিল্পীরা। অধিকাংশ শিল্পী পাঠবিমুখ এবং ফেসবুকমুখী। ফেসবুকের ভয়াবহ স্বাধীনতা এবং সংকীর্ণতা বাংলাদেশে বর্তমানে মুখ্য প্রবণতা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউটিউব, টিকটক অশৈল্পিক এবং উত্তেজনাকর সব উপাদান। আর এ উপাদানই এদের সম্বল। ভিউ বাড়লেই অর্থ আসে। অর্থের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার ফলে এই মাধ্যমটিও পাঠবিমুখতার একটি কারণ।

প্রযুক্তিকে থামিয়ে রাখা যায় না। বিজ্ঞান প্রতিদিনই নতুন নতুন উদ্ভাবনের দ্বারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। যারা এর ইতিবাচক ফলাফল নিতে পারে, তারা উপকৃত হয়, উপকৃত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান। আর যারা নিতে পারে না তারা সংকীর্ণতায় ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হয়। এই নিমজ্জনপ্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউব কিছু মানুষের অর্থ উপার্জনের জন্য খুবই সহায়ক হচ্ছে এবং যে যত বেশি বুদ্ধিহীন, সারবত্তাহীন অশ্লীল উপাদান সমাজে ছড়াতে পারবে, তারই জয়গান বাজছে। অন্যদিকে নীরবে-নিভৃতে যে পাঠচর্চা এবং পাঠচর্চার যে কেন্দ্র, সেই পাঠাগার বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। দেশটা কি পেশিশক্তির বা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে? নাকি ধনবাড়ীর অভয়ারণ্য পাঠাগার শিক্ষিত, নীতিমান, জ্ঞানী মানুষের আশ্রয় হবে?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মে. জে. ফজলুরের সেভেন সিস্টার্স দখলের মন্তব্য সমর্থন করে না সরকার: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নিজের প্রস্রাব পান করে ‘আশিকি’ অভিনেত্রী অনু আগারওয়াল বললেন, ‘আহা অমৃত’

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা-ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

গায়ে কেরোসিন ঢেলে কলেজছাত্রীর আত্মহনন, পলাতক ইমাম গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত