আমরা যাঁরা ঢাকা শহরে বড় হয়েছি, তাঁদের কাছে নববর্ষের যে অর্থ দাঁড়িয়েছে, তার অন্যতম হলো ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান—এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। এখন যাঁরা বাঙালির সব অর্জনকে হেয় করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের কাছ থেকে তরুণেরা শিক্ষা নেবে, নাকি ইতিহাসের কাছ থেকে নেবে, সেটা তরুণেরাই ঠিক করুক।
জাহীদ রেজা নূর
সূর্যোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবার যে নববর্ষের আগমন, তা রাঙিয়ে দিয়ে যাক প্রত্যেক মানুষের জীবন। বাংলা নববর্ষের উজ্জীবনী সুধায় স্নান করুক মানুষ। আশা ও আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নপূরণে সার্থক হোক পৃথিবী। গ্লানি, জ্বরা মুছে গিয়ে অগ্নিস্নানে ধরণিকে শুচি করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই আহ্বান হৃদয়কে পরিপূর্ণ করুক।
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেলা গেল বটে, কিন্তু বাংলাদেশ বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যে অস্থিরতা চলছে, তা থেকে বের হয়ে আসা এই মুহূর্তে খুব সহজ নয়। তাই নতুন বছরে এমন কিছু অঙ্গীকার করা দরকার, যা পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করতে পারে পৃথিবীবাসীকে।
২. বাংলা নববর্ষের জন্মকথা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বিশদে না গিয়েও বলা যায়, একটি মত আছে, যেখানে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মনে করেন, মোগল সম্রাট আকবর চান্দ্র হিজরি সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় সাধন করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। তবে অন্য গবেষকেরা বলছেন, আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন, তার ভিত্তিতেই বাংলায় আকবরের কোনো প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আরও কোনো তত্ত্ব হয়তো আছে, কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলা সন চালু হয়েছে এবং এই সনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু আনন্দ অনুষ্ঠান, সেটাই মুখ্য।
৩. নববর্ষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। জমিদারবাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন প্রজারা। তাদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায়। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর এই অনুষ্ঠান আর নেই। হালখাতা ছিল পয়লা বৈশাখের এক বড় অনুষ্ঠান। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই তা বিকশিত হয়েছিল। কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকের আর্থিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। ফসলের মৌসুমে যখন নগদ টাকা তাঁদের হাতে আসত, তখনই কেবল তাঁরা নগদ টাকার দেখা পেতেন। পয়লা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠানে কৃষকেরা দোকানিদের বাকির টাকা পুরো বা আংশিক মিটিয়ে দিতেন। তারপর নতুন বছরের খাতা খুলতেন। এখানেও মিষ্টিমুখ করানো হতো কৃষকদের।
আর ছিল বৈশাখী মেলা। বৈশাখের প্রথম দিনে এই মেলা বসাটা ছিল রেওয়াজ। একসময় এই মেলার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত মানুষ। কারণ, সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখা হতো এই মেলা থেকে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুলনাচ, নাগরদোলাসহ নানা আনন্দ-আয়োজন। বর্তমানে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে সবকিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যায়, তাই কেনাকাটার জন্য এখন আর এই মেলা খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না।
৪. ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে পাকিস্তানি অকেজো রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নির্যাস বলাই সংগত। এখন নানা দিক থেকেই এই অর্জনকে বিতর্কিত করে তোলার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। ছায়ানটকে অবজ্ঞা করতে পারলে, ছায়ানটের অনুষ্ঠানকে বিদ্রূপ করতে পারলে কাদের লাভ হয়, সেটাও গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।
গত আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের অনেক পরে জানা গিয়েছিল, এটা একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল। অর্থাৎ, বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকার হটানোর জন্য বহুদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদের অনেকেই তখনকার ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। বিভিন্ন মতাদর্শের সংগঠনগুলো এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মূলত কট্টর ডানপন্থীরা এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। বামপন্থী বা উদারপন্থীদের হটিয়ে দিয়ে তারাই এখন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ইনক্লুসিভ শব্দটির ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত তার দেখা মেলা ভার।
আওয়ামী লীগ আমলের শেষ কয়েক বছর অরাজকতা ছিল সীমাহীন। যে শিশুরা আওয়ামী আমলে বড় হয়ে উঠেছে, তারা আওয়ামী শাসন ছাড়া আর কিছু দেখেনি। আর যা দেখেছে, তাতে প্রশংসাযোগ্য বিষয় ছিল কম। ফলে তরুণেরা ধরেই নিয়েছিল, আওয়ামী লীগই হচ্ছে সব স্বৈরশাসনের ভিত্তিমূল। তারা অন্য কোনো আমলের অরাজকতা দেখেনি, তাই শুধু আওয়ামী লীগই তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য।
এটাই স্বাভাবিক। যারা পাকিস্তানি শাসন দেখেছে, জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সেনা হত্যা দেখেছে, এরশাদের স্বৈরশাসন দেখেছে, দেখেছে খালেদা জিয়ার আমলে হাওয়া ভবনের খেলা, শিবিরের রগকাটা রাজনীতির রমরমা, তারা আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনকেও সেই দৃষ্টিতে দেখে বিচার করতে পারে। কিন্তু যারা শুধু আওয়ামী লীগের অপশাসন দেখেছে, তাদের পক্ষে অন্য সময়গুলো ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যেহেতু আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার কথা বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছে, অথচ এই শব্দগুলোর প্রতি অবিচার করেছে, তাই এই শব্দগুলোকেও প্রতিপক্ষ বানানো সহজ হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যে কত বড় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, কত পরিবারের শরীরে সেই অর্জনের পথে উৎসর্গীকৃত রক্ত প্রবহমান, সে কথা তরুণেরা ঠিকভাবে জেনে নেয়নি। ফলে উগ্র ডানপন্থী প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে তারা আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধকে একই বিষয় বলে মনে করেছে এবং অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে দুটিকেই।এই জায়গার কথা মনে রেখে আমরা নববর্ষ ও ছায়ানটের বিষয়ে আলোচনা করব।
৫. তরুণদের বুঝে দেখতে হবে, পাকিস্তান আমলটা কেমন ছিল। কেন একটা গোটা জনগোষ্ঠী স্বাধিকার আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। আজ যারা পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন নিয়ে অপব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাদের কথায় বিভ্রান্ত হলে তরুণেরা আমাদের ইতিহাসের সত্যটা খুঁজে পাবে না। এ জন্য ইতিহাসসংলগ্ন তথ্য-উপাত্ত খুঁজে বের করতে হবে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে বাংলা আবার নতুন এক উপনিবেশের কবলে পড়তে যাচ্ছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খানের যুগ শেষ হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনিক আমলা ও সেনা আমলারা রাজনীতির মাঠ দখল করে নিয়েছিল। রাজনীতিবিদদের অবজ্ঞা করা হয়েছিল। এই ট্র্যাডিশন চলেছিল ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সেনা অভ্যুত্থান করার আগপর্যন্ত। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চালালেন তাঁর লৌহশাসন। এ সময় যে উন্নয়নকাজ চলেছিল, তাতে অনেকেই আইয়ুব খানকে বাহবা দেয়, কিন্তু কেউ ভেবে দেখে না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে কতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে চালানো উন্নয়নকাজের তুলনায় পূর্ব বাংলায় চালানো উন্নয়ন কতটা কম।
এই আইয়ুব খানের শাসনামলেই ১৯৬১ সালে এসেছিল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। ইতিহাস জানে, বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে ভীষণ রকম দোদুল্যমান ছিল দীর্ঘকাল ধরে। তারা বাঙালি না মুসলমান—এই দ্বন্দ্ব থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে বের করা ছিল কঠিন। বাঙালি হয়েও যে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ হওয়া যায়—এই ভাবনা প্রগাঢ় হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের পর। এবং সত্যিই এ সময় থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয় বাঙালি মুসলমান। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রবিরোধিতার একটা পথ সুগম করে দিয়েছিলেন আইয়ুব খান। এই বুদ্ধিজীবীর দল দৈনিক আজাদ পত্রিকাকে সঙ্গী করে রবীন্দ্রনাথের নামে অযথা কুৎসা রটানো শুরু করল। তারই জবাব আসতে লাগল দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদে। এ রকম এক অস্থির পরিবেশে সরকারি শাসানির মুখে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সাফল্যের সঙ্গে পালিত হয়। এই পটভূমি মনে রাখলেই ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মর্মার্থ বোঝা সহজ হবে।
১৯৬১ সালের এই সাফল্যের ভিত্তিতেই ১৯৬৩ সালে গড়ে ওঠে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। এবং ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে শুরু হয় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের অনুষ্ঠান। আমাদের শ্রেষ্ঠ সংগীতকারদের গান এবং সেরা কবিদের কবিতা ও রচনা পাঠের মাধ্যমে পালিত হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ।
আমরা যাঁরা ঢাকা শহরে বড় হয়েছি, তাঁদের কাছে নববর্ষের যে অর্থ দাঁড়িয়েছে, তার অন্যতম হলো ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান—এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। এখন যাঁরা বাঙালির সব অর্জনকে হেয় করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের কাছ থেকে তরুণেরা শিক্ষা নেবে, নাকি ইতিহাসের কাছ থেকে নেবে, সেটা তরুণেরাই ঠিক করুক।
মানুষ এখন কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেটা জানতে হলে প্রাথমিক বিদ্যায়তনগুলোয় খোঁজ নিন। দেখা গেছে, ধর্মীয় বিভাজন সেখানেও পৌঁছে গেছে প্রকটভাবে। আমাদের অভিভাবকেরাও সেটা মেনে নিচ্ছেন কিংবা তারাই ধর্ম পরিচয়ে মেলামেশা করছেন। অথচ সবাই মিলে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেদিকে তো আমরা এগোতে পারলাম না। তাহলে কী নিয়ে আমাদের গর্ব?
৬. তার পরও বৈশাখ আসে। কালবৈশাখীর মতোই তা কখনো কখনো জঞ্জাল হটিয়ে দেয়। কখনো মজা খালের মতো রক্ষণশীল তত্ত্ব এসে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইনক্লুসিভ বলতে যদি সবার কথা বলা হয়ে থাকে, তাহলে নববর্ষের দিনটিতে আমরা বলতেই পারি, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের’। আগস্টের গ্রাফিতি বা দেয়াললিখনগুলোর দিকে তাকান। দেখবেন, সেখানে যে স্বপ্নগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা পুরোই অসাম্প্রদায়িক। মানুষ যদি মানুষের জন্য না হয়, তাহলে হিংসা, হিংস্রতারই চাষবাস হবে। সে রকম দেশ আমাদের চাওয়া নয়।
বিভাজনের রাজনীতি যাঁরা করতে চান, তাঁদের গালে থাপ্পড় মারতে পারে, আল মাহমুদের তেমন একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই সবাইকে:
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সূর্যোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবার যে নববর্ষের আগমন, তা রাঙিয়ে দিয়ে যাক প্রত্যেক মানুষের জীবন। বাংলা নববর্ষের উজ্জীবনী সুধায় স্নান করুক মানুষ। আশা ও আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নপূরণে সার্থক হোক পৃথিবী। গ্লানি, জ্বরা মুছে গিয়ে অগ্নিস্নানে ধরণিকে শুচি করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই আহ্বান হৃদয়কে পরিপূর্ণ করুক।
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেলা গেল বটে, কিন্তু বাংলাদেশ বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যে অস্থিরতা চলছে, তা থেকে বের হয়ে আসা এই মুহূর্তে খুব সহজ নয়। তাই নতুন বছরে এমন কিছু অঙ্গীকার করা দরকার, যা পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করতে পারে পৃথিবীবাসীকে।
২. বাংলা নববর্ষের জন্মকথা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বিশদে না গিয়েও বলা যায়, একটি মত আছে, যেখানে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মনে করেন, মোগল সম্রাট আকবর চান্দ্র হিজরি সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় সাধন করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। তবে অন্য গবেষকেরা বলছেন, আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন, তার ভিত্তিতেই বাংলায় আকবরের কোনো প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আরও কোনো তত্ত্ব হয়তো আছে, কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলা সন চালু হয়েছে এবং এই সনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু আনন্দ অনুষ্ঠান, সেটাই মুখ্য।
৩. নববর্ষের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। জমিদারবাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন প্রজারা। তাদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায়। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর এই অনুষ্ঠান আর নেই। হালখাতা ছিল পয়লা বৈশাখের এক বড় অনুষ্ঠান। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই তা বিকশিত হয়েছিল। কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষকের আর্থিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না। ফসলের মৌসুমে যখন নগদ টাকা তাঁদের হাতে আসত, তখনই কেবল তাঁরা নগদ টাকার দেখা পেতেন। পয়লা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠানে কৃষকেরা দোকানিদের বাকির টাকা পুরো বা আংশিক মিটিয়ে দিতেন। তারপর নতুন বছরের খাতা খুলতেন। এখানেও মিষ্টিমুখ করানো হতো কৃষকদের।
আর ছিল বৈশাখী মেলা। বৈশাখের প্রথম দিনে এই মেলা বসাটা ছিল রেওয়াজ। একসময় এই মেলার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত মানুষ। কারণ, সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখা হতো এই মেলা থেকে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুলনাচ, নাগরদোলাসহ নানা আনন্দ-আয়োজন। বর্তমানে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে সবকিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যায়, তাই কেনাকাটার জন্য এখন আর এই মেলা খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না।
৪. ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে পাকিস্তানি অকেজো রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নির্যাস বলাই সংগত। এখন নানা দিক থেকেই এই অর্জনকে বিতর্কিত করে তোলার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। ছায়ানটকে অবজ্ঞা করতে পারলে, ছায়ানটের অনুষ্ঠানকে বিদ্রূপ করতে পারলে কাদের লাভ হয়, সেটাও গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।
গত আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের অনেক পরে জানা গিয়েছিল, এটা একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল। অর্থাৎ, বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকার হটানোর জন্য বহুদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদের অনেকেই তখনকার ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। বিভিন্ন মতাদর্শের সংগঠনগুলো এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মূলত কট্টর ডানপন্থীরা এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। বামপন্থী বা উদারপন্থীদের হটিয়ে দিয়ে তারাই এখন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ইনক্লুসিভ শব্দটির ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত তার দেখা মেলা ভার।
আওয়ামী লীগ আমলের শেষ কয়েক বছর অরাজকতা ছিল সীমাহীন। যে শিশুরা আওয়ামী আমলে বড় হয়ে উঠেছে, তারা আওয়ামী শাসন ছাড়া আর কিছু দেখেনি। আর যা দেখেছে, তাতে প্রশংসাযোগ্য বিষয় ছিল কম। ফলে তরুণেরা ধরেই নিয়েছিল, আওয়ামী লীগই হচ্ছে সব স্বৈরশাসনের ভিত্তিমূল। তারা অন্য কোনো আমলের অরাজকতা দেখেনি, তাই শুধু আওয়ামী লীগই তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য।
এটাই স্বাভাবিক। যারা পাকিস্তানি শাসন দেখেছে, জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সেনা হত্যা দেখেছে, এরশাদের স্বৈরশাসন দেখেছে, দেখেছে খালেদা জিয়ার আমলে হাওয়া ভবনের খেলা, শিবিরের রগকাটা রাজনীতির রমরমা, তারা আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনকেও সেই দৃষ্টিতে দেখে বিচার করতে পারে। কিন্তু যারা শুধু আওয়ামী লীগের অপশাসন দেখেছে, তাদের পক্ষে অন্য সময়গুলো ধারণ করা সম্ভব নয়। আর যেহেতু আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার কথা বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছে, অথচ এই শব্দগুলোর প্রতি অবিচার করেছে, তাই এই শব্দগুলোকেও প্রতিপক্ষ বানানো সহজ হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যে কত বড় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, কত পরিবারের শরীরে সেই অর্জনের পথে উৎসর্গীকৃত রক্ত প্রবহমান, সে কথা তরুণেরা ঠিকভাবে জেনে নেয়নি। ফলে উগ্র ডানপন্থী প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে তারা আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধকে একই বিষয় বলে মনে করেছে এবং অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে দুটিকেই।এই জায়গার কথা মনে রেখে আমরা নববর্ষ ও ছায়ানটের বিষয়ে আলোচনা করব।
৫. তরুণদের বুঝে দেখতে হবে, পাকিস্তান আমলটা কেমন ছিল। কেন একটা গোটা জনগোষ্ঠী স্বাধিকার আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। আজ যারা পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন নিয়ে অপব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাদের কথায় বিভ্রান্ত হলে তরুণেরা আমাদের ইতিহাসের সত্যটা খুঁজে পাবে না। এ জন্য ইতিহাসসংলগ্ন তথ্য-উপাত্ত খুঁজে বের করতে হবে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে বাংলা আবার নতুন এক উপনিবেশের কবলে পড়তে যাচ্ছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খানের যুগ শেষ হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনিক আমলা ও সেনা আমলারা রাজনীতির মাঠ দখল করে নিয়েছিল। রাজনীতিবিদদের অবজ্ঞা করা হয়েছিল। এই ট্র্যাডিশন চলেছিল ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সেনা অভ্যুত্থান করার আগপর্যন্ত। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চালালেন তাঁর লৌহশাসন। এ সময় যে উন্নয়নকাজ চলেছিল, তাতে অনেকেই আইয়ুব খানকে বাহবা দেয়, কিন্তু কেউ ভেবে দেখে না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে কতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে চালানো উন্নয়নকাজের তুলনায় পূর্ব বাংলায় চালানো উন্নয়ন কতটা কম।
এই আইয়ুব খানের শাসনামলেই ১৯৬১ সালে এসেছিল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। ইতিহাস জানে, বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে ভীষণ রকম দোদুল্যমান ছিল দীর্ঘকাল ধরে। তারা বাঙালি না মুসলমান—এই দ্বন্দ্ব থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে বের করা ছিল কঠিন। বাঙালি হয়েও যে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ হওয়া যায়—এই ভাবনা প্রগাঢ় হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের পর। এবং সত্যিই এ সময় থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয় বাঙালি মুসলমান। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রবিরোধিতার একটা পথ সুগম করে দিয়েছিলেন আইয়ুব খান। এই বুদ্ধিজীবীর দল দৈনিক আজাদ পত্রিকাকে সঙ্গী করে রবীন্দ্রনাথের নামে অযথা কুৎসা রটানো শুরু করল। তারই জবাব আসতে লাগল দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদে। এ রকম এক অস্থির পরিবেশে সরকারি শাসানির মুখে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সাফল্যের সঙ্গে পালিত হয়। এই পটভূমি মনে রাখলেই ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মর্মার্থ বোঝা সহজ হবে।
১৯৬১ সালের এই সাফল্যের ভিত্তিতেই ১৯৬৩ সালে গড়ে ওঠে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। এবং ১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে শুরু হয় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের অনুষ্ঠান। আমাদের শ্রেষ্ঠ সংগীতকারদের গান এবং সেরা কবিদের কবিতা ও রচনা পাঠের মাধ্যমে পালিত হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ।
আমরা যাঁরা ঢাকা শহরে বড় হয়েছি, তাঁদের কাছে নববর্ষের যে অর্থ দাঁড়িয়েছে, তার অন্যতম হলো ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান—এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। এখন যাঁরা বাঙালির সব অর্জনকে হেয় করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের কাছ থেকে তরুণেরা শিক্ষা নেবে, নাকি ইতিহাসের কাছ থেকে নেবে, সেটা তরুণেরাই ঠিক করুক।
মানুষ এখন কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেটা জানতে হলে প্রাথমিক বিদ্যায়তনগুলোয় খোঁজ নিন। দেখা গেছে, ধর্মীয় বিভাজন সেখানেও পৌঁছে গেছে প্রকটভাবে। আমাদের অভিভাবকেরাও সেটা মেনে নিচ্ছেন কিংবা তারাই ধর্ম পরিচয়ে মেলামেশা করছেন। অথচ সবাই মিলে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেদিকে তো আমরা এগোতে পারলাম না। তাহলে কী নিয়ে আমাদের গর্ব?
৬. তার পরও বৈশাখ আসে। কালবৈশাখীর মতোই তা কখনো কখনো জঞ্জাল হটিয়ে দেয়। কখনো মজা খালের মতো রক্ষণশীল তত্ত্ব এসে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইনক্লুসিভ বলতে যদি সবার কথা বলা হয়ে থাকে, তাহলে নববর্ষের দিনটিতে আমরা বলতেই পারি, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের’। আগস্টের গ্রাফিতি বা দেয়াললিখনগুলোর দিকে তাকান। দেখবেন, সেখানে যে স্বপ্নগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা পুরোই অসাম্প্রদায়িক। মানুষ যদি মানুষের জন্য না হয়, তাহলে হিংসা, হিংস্রতারই চাষবাস হবে। সে রকম দেশ আমাদের চাওয়া নয়।
বিভাজনের রাজনীতি যাঁরা করতে চান, তাঁদের গালে থাপ্পড় মারতে পারে, আল মাহমুদের তেমন একটি কবিতার কয়েক পঙ্ক্তি দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই সবাইকে:
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলা নববর্ষ বরণকে কেন্দ্র করে আমাদের নগরকেন্দ্রিক জীবনে উপচানো আবেগ-উচ্ছ্বাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আবেগ-উচ্ছ্বাস জাতিগত পারস্পরিক সৌহার্দ্যের নয়, সমষ্টিগতও নয়, একান্তই আত্মকেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ।
২ দিন আগেনতুন বছরে প্রবেশ করলাম আমরা। পৃথিবীব্যাপী বসবাসরত নানা জনগোষ্ঠী যেমন নতুন বছরকে উৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নেয়, তেমনি বাঙালিও নানা আনন্দ-আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। একটি নতুন আশা, উদ্দীপনা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বছরের প্রথম দিনটিতে।
২ দিন আগেআশেকা ইরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক চেয়ারপারসন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র জেন্ডার, ভূ-কৌশলগত ও আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়ে। ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে আরব বিশ্বের ভূমিকা...
৩ দিন আগেরাজনীতি যদি মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক হয়, তবে তা শুধু ঢাকার পিচঢালা রাস্তায় নয়, প্রতিটি ইউনিয়নের মাটির পথে প্রতিফলিত হতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতি যেন একটি দূরবর্তী বিষয়—শুধু খবরের কাগজে থাকে, জীবনের ভেতরে তা প্রবেশ করে না।
৩ দিন আগে