আহমেদ শমসের, সাংবাদিক
উইকিপিডিয়ায় নির্বাচনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এইভাবে: নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আজকের দিনে নির্বাচন শব্দটি শুধু একটি দিনে ভোট দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়; এটি একটি জাতির গণতান্ত্রিক যাত্রার মৌলিক ভিত্তি। জনগণ তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচনের মাধ্যমে বেছে নেয়, নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের দায়িত্ব তুলে দেয় একদল মানুষের হাতে। তাই নির্বাচন মানেই গণতন্ত্রের প্রাণ। অবশ্য শুধু নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, প্রয়োজন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন—যেখানে প্রতিটি ভোটারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে, প্রতিটি ভোট গণ্য হয় সমান গুরুত্বে এবং জনগণের রায়ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আবেগ, হতাশা, অভিযোগ আর প্রত্যাশা—সবকিছু একসঙ্গে চলে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির বদলে হয়ে উঠেছে বিরোধ, সংঘাত এবং সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে জনমনে প্রশ্ন জাগে, এইবার কি সত্যিই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে?
এই প্রশ্নের উৎপত্তি ইতিহাস থেকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন, যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা গোটা পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র প্রায়-নিরপেক্ষ নির্বাচন, আমাদের আত্মপরিচয়ের বীজ বপন করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ায় দেখা দেয় বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। বিপুল বিজয়ে তারা ক্ষমতায় আসে, তাই বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু ছিল না। একদলীয় শাসনের অভিপ্রায় তখনো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক নাটকীয়তা সে পথই উন্মোচন করে দেয়।
এরপর আসে একটি অস্থির ও রক্তাক্ত সময়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদে জিয়াউর রহমান গণভোটের আয়োজন করেন, যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ছিল সেনাবাহিনীর ছায়া, প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা এবং ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল।
জিয়াউর রহমানের সময়টায় নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের’ ধারা তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীকালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার চেয়েও বিস্তৃতভাবে সেটিকে ব্যবহার করেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে ‘সামরিক শাসকের গণতান্ত্রিক মুখোশ’ হিসেবে অনেকেই আখ্যায়িত করেন। বিরোধী দলগুলোর একটি অংশ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি তা বর্জন করে। ভোটের দিন প্রশাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, বিরোধীদের হয়রানি এবং ফলাফল নিয়ে অনাস্থা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৮৮ সালের নির্বাচন ছিল আরও বিতর্কিত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই তাতে অংশ নেয়নি। ফলে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেশীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভোটার উপস্থিতি ছিল অস্বাভাবিকভাবে কম, অথচ ফলাফল দেখানো হয় বিপুল উৎসাহে। বলা হয়ে থাকে, সেই নির্বাচনই জনগণের মনে ‘ভোটহীন গণতন্ত্রের’ প্রতিচ্ছবি গেঁথে দেয়।
এই পটভূমিতেই ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের পতন ঘটে এবং আসে বহু প্রতীক্ষিত ১৯৯১ সালের নির্বাচন। এটি ছিল একটি নতুন আশার সূচনা। দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, প্রশাসনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্বাচন হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয় এ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিও ধীরে ধীরে তখন আলোচনায় আসে, যদিও বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের পর।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছিল জটিল ও কলঙ্কিত অধ্যায়। বিএনপি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও নিরপেক্ষ সরকার গঠন না করায়, প্রধান বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন করে। সেই নির্বাচনের পর গঠিত সরকার ১২ দিনের মাথায় বিলুপ্ত হয় এবং এরশাদের আমলে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অবিশ্বাসের ধারাটিই যেন ফের ফিরে আসে।
এরপর শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন। ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলো এই ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হয় এবং তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আদালতের রায়ে এই ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর আবার দেখা দেয় আস্থার সংকট।
২০১৪ সালের নির্বাচন সেই সংকটকে পূর্ণমাত্রায় উন্মোচিত করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে, ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, হরতাল, পেট্রলবোমা এবং মানুষের প্রাণহানি—এসব ঘটনা গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি ভোটার উপস্থিতি দেখানো, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভিযোগ ওঠে, ভোট আগের রাতে হয়ে গেছে। বিরোধী দলের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রেই ঢুকতে পারেননি, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, পর্যবেক্ষকদের কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়।
এই রকম নির্বাচনের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এমন ভোটের প্রয়োজন কী? আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভোটব্যবস্থা চালু করেন, যাতে ভোটার উপস্থিত হয়ে ভোট দেওয়াটা জরুরি নয়, জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল একতরফা ফলাফল ঘোষণা। আওয়ামী লীগের একচেটিয়া জয়। নির্বাচনের নামে এই প্রহসন অনেকের কাছেই মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে ওই নির্বাচনই বৈধ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অবস্থার জন্য কে দায়ী, সেটা এক লম্বা আলোচনার বিষয়। তবে এর দায় শুধু নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। নির্বাচন একটি সামষ্টিক রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া, যেখানে রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং সবচেয়ে বড় কথা—রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। যখনই এই সদিচ্ছা হারিয়ে যায়, নির্বাচন শুধু ‘ঘোষণা’ হয়—আসলে ভোট হয় না।
গণতন্ত্র মানে কেবল একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। সেই সুযোগ তৈরি হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। অথচ আমরা নির্বাচনের কথা বললেও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়াই সন্দেহের জগতে।
সুতরাং, আজ যদি আমরা সত্যিই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তবে সবার আগে দরকার আস্থা ফিরিয়ে আনা। এই আস্থা ফিরবে তখনই, যখন সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মত হবে, প্রশাসনকে ব্যবহার করবে না, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে না এবং জনগণের রায় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলবে।
এই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ গড়ার দায়িত্ব এককভাবে কারও নয়, তা আমাদের সবার—যারা এই রাষ্ট্রের অংশ, যারা এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কেমন নির্বাচন চাই?
শুধু নির্বাচন নয়, আমরা চাই এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ ভোট দিতে গেলে ভয় পাবে না, সন্দেহ করবে না, বরং গর্ব নিয়ে বলবে—‘আমার ভোটেই গঠিত হয়েছে সরকার।’ সেই আত্মবিশ্বাসই হবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিজয়। আর এই বিজয়ের পথ তৈরি হয় শুধু তখনই, যখন নির্বাচন হয় সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।
উইকিপিডিয়ায় নির্বাচনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এইভাবে: নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আজকের দিনে নির্বাচন শব্দটি শুধু একটি দিনে ভোট দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়; এটি একটি জাতির গণতান্ত্রিক যাত্রার মৌলিক ভিত্তি। জনগণ তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচনের মাধ্যমে বেছে নেয়, নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের দায়িত্ব তুলে দেয় একদল মানুষের হাতে। তাই নির্বাচন মানেই গণতন্ত্রের প্রাণ। অবশ্য শুধু নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, প্রয়োজন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন—যেখানে প্রতিটি ভোটারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে, প্রতিটি ভোট গণ্য হয় সমান গুরুত্বে এবং জনগণের রায়ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আবেগ, হতাশা, অভিযোগ আর প্রত্যাশা—সবকিছু একসঙ্গে চলে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির বদলে হয়ে উঠেছে বিরোধ, সংঘাত এবং সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে জনমনে প্রশ্ন জাগে, এইবার কি সত্যিই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে?
এই প্রশ্নের উৎপত্তি ইতিহাস থেকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন, যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা গোটা পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র প্রায়-নিরপেক্ষ নির্বাচন, আমাদের আত্মপরিচয়ের বীজ বপন করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়ায় দেখা দেয় বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। বিপুল বিজয়ে তারা ক্ষমতায় আসে, তাই বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু ছিল না। একদলীয় শাসনের অভিপ্রায় তখনো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক নাটকীয়তা সে পথই উন্মোচন করে দেয়।
এরপর আসে একটি অস্থির ও রক্তাক্ত সময়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদে জিয়াউর রহমান গণভোটের আয়োজন করেন, যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ছিল সেনাবাহিনীর ছায়া, প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা এবং ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল।
জিয়াউর রহমানের সময়টায় নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের’ ধারা তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীকালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার চেয়েও বিস্তৃতভাবে সেটিকে ব্যবহার করেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে ‘সামরিক শাসকের গণতান্ত্রিক মুখোশ’ হিসেবে অনেকেই আখ্যায়িত করেন। বিরোধী দলগুলোর একটি অংশ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি তা বর্জন করে। ভোটের দিন প্রশাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, বিরোধীদের হয়রানি এবং ফলাফল নিয়ে অনাস্থা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৮৮ সালের নির্বাচন ছিল আরও বিতর্কিত। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই তাতে অংশ নেয়নি। ফলে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেশীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ভোটার উপস্থিতি ছিল অস্বাভাবিকভাবে কম, অথচ ফলাফল দেখানো হয় বিপুল উৎসাহে। বলা হয়ে থাকে, সেই নির্বাচনই জনগণের মনে ‘ভোটহীন গণতন্ত্রের’ প্রতিচ্ছবি গেঁথে দেয়।
এই পটভূমিতেই ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদের পতন ঘটে এবং আসে বহু প্রতীক্ষিত ১৯৯১ সালের নির্বাচন। এটি ছিল একটি নতুন আশার সূচনা। দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, প্রশাসনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্বাচন হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয় এ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিও ধীরে ধীরে তখন আলোচনায় আসে, যদিও বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের পর।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছিল জটিল ও কলঙ্কিত অধ্যায়। বিএনপি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও নিরপেক্ষ সরকার গঠন না করায়, প্রধান বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন করে। সেই নির্বাচনের পর গঠিত সরকার ১২ দিনের মাথায় বিলুপ্ত হয় এবং এরশাদের আমলে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অবিশ্বাসের ধারাটিই যেন ফের ফিরে আসে।
এরপর শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন। ১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলো এই ব্যবস্থার অধীনেই অনুষ্ঠিত হয় এবং তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আদালতের রায়ে এই ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর আবার দেখা দেয় আস্থার সংকট।
২০১৪ সালের নির্বাচন সেই সংকটকে পূর্ণমাত্রায় উন্মোচিত করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে, ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, হরতাল, পেট্রলবোমা এবং মানুষের প্রাণহানি—এসব ঘটনা গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি ভোটার উপস্থিতি দেখানো, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভিযোগ ওঠে, ভোট আগের রাতে হয়ে গেছে। বিরোধী দলের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রেই ঢুকতে পারেননি, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, পর্যবেক্ষকদের কাজ করতে বাধা দেওয়া হয়।
এই রকম নির্বাচনের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এমন ভোটের প্রয়োজন কী? আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভোটব্যবস্থা চালু করেন, যাতে ভোটার উপস্থিত হয়ে ভোট দেওয়াটা জরুরি নয়, জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল একতরফা ফলাফল ঘোষণা। আওয়ামী লীগের একচেটিয়া জয়। নির্বাচনের নামে এই প্রহসন অনেকের কাছেই মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে ওই নির্বাচনই বৈধ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অবস্থার জন্য কে দায়ী, সেটা এক লম্বা আলোচনার বিষয়। তবে এর দায় শুধু নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। নির্বাচন একটি সামষ্টিক রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া, যেখানে রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং সবচেয়ে বড় কথা—রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। যখনই এই সদিচ্ছা হারিয়ে যায়, নির্বাচন শুধু ‘ঘোষণা’ হয়—আসলে ভোট হয় না।
গণতন্ত্র মানে কেবল একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা। সেই সুযোগ তৈরি হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। অথচ আমরা নির্বাচনের কথা বললেও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়াই সন্দেহের জগতে।
সুতরাং, আজ যদি আমরা সত্যিই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তবে সবার আগে দরকার আস্থা ফিরিয়ে আনা। এই আস্থা ফিরবে তখনই, যখন সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মত হবে, প্রশাসনকে ব্যবহার করবে না, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে না এবং জনগণের রায় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলবে।
এই বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ গড়ার দায়িত্ব এককভাবে কারও নয়, তা আমাদের সবার—যারা এই রাষ্ট্রের অংশ, যারা এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কেমন নির্বাচন চাই?
শুধু নির্বাচন নয়, আমরা চাই এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ ভোট দিতে গেলে ভয় পাবে না, সন্দেহ করবে না, বরং গর্ব নিয়ে বলবে—‘আমার ভোটেই গঠিত হয়েছে সরকার।’ সেই আত্মবিশ্বাসই হবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিজয়। আর এই বিজয়ের পথ তৈরি হয় শুধু তখনই, যখন নির্বাচন হয় সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ।
আমাদের দেশে শিল্প-সাহিত্য-নাটক-সংগীত-চলচ্চিত্র হারাম হিসেবে পরিগণিত হয় বিশেষ একটি গোষ্ঠীর কাছে। এই গোষ্ঠীর কাছে ধর্ম যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি বড় রক্ষণশীলতা, তাই প্রতিটি জায়গায় এরা চরম প্রতিক্রিয়া দেখায়। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যা বোঝা যাচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশ...
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি দেওয়া একাধিক বক্তৃতায় চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে আমরা নিজেরা চাঁদাবাজি করব না এবং কাউকে চাঁদাবাজি করতেও দেব না। ঘুষ কেউ নেবে না...
১১ ঘণ্টা আগেদায়ী আমরা সবাই। তেজগাঁও ও কুর্মিটোলার বিমানবন্দর দুটি ১৯৪৫ সালে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন হলো, তখন তেজগাঁওয়ে বিমানবন্দর করা হলো বেশ বড় আকারে। এরপর ১৯৬৪ সালে নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বাড়ার কারণে তেজগাঁওয়ের বদলে কুর্মিটোলার বিমানবন্দর বড় পরিসরে চালু করার পরিকল্পনা করা হয়।
১ দিন আগেউত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা গোটা জাতিকে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত করেছে। শিশুর কান্না, অভিভাবকের আর্তনাদ কেবল কারও ব্যক্তিগত ক্ষত বা ক্ষতি নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত দুর্বলতার দিকটিকে সামনে এনেছে। প্রশিক্ষণ বিমান কোথায় চালানো উচিত,
১ দিন আগে