মো. হাবিবুর রহমান
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ কৃষি। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনে যাঁরা কৃষিকে কেন্দ্রে রেখে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের সেই স্বপ্ন আজও পূর্ণতা পায়নি। এই দেশের মাটি এখনো সুফলা, মানুষ এখনো পরিশ্রমী। কিন্তু মাঝখানে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী বাধা—সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট শুধু মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভবান করে না, এটি কৃষিকে অনিরাপদ ও কৃষককে দুর্বল করে তোলে।
২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য উপস্থাপিত হয়, তা কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং একটি জাতীয় সংকটের আলামত। মেহেরপুরের পেঁয়াজচাষি সাইফুল শেখ বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন—কারণ তিনি পণ্যের ন্যায্য দাম পাননি। এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই সংবাদমাধ্যমে আসে, কিন্তু পেছনের কাঠামোগত সংকট আলোচনার কেন্দ্রে আসে না।
এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে ‘বাজার সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেট মানে কেবল মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ী নয়, বরং এটি একটি সংগঠিত প্রক্রিয়া—যেখানে উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যবর্তী স্তরগুলো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে। উৎপাদনের মৌসুমে যখন বাজারে সরবরাহ বেশি থাকে, তখন ইচ্ছাকৃতভাবে মূল্য নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়। কৃষক বাধ্য হয়ে উৎপাদন ব্যয় না তুলেই ফসল বিক্রি করেন। পরে ওই পণ্য মজুত রেখে দাম বাড়িয়ে বাজারে ছাড়া হয়, তখন ভোক্তা চড়া দামে তা কিনতে বাধ্য হন।
সাধারণভাবে যাঁদের আমরা ‘ফড়িয়া’ বলি—তাঁরা কৃষকের মাঠেই পণ্য সংগ্রহ করে নেন। এরপর সেটি যায় পাইকারি বাজারে, সেখান থেকে খুচরা বাজারে। প্রতিটি ধাপে অন্তত ১৫-৩০% করে মূল্যবৃদ্ধি হয়। অথচ এই পুরো মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় কৃষকের ভাগ একেবারেই নগণ্য। সবার লাভ হয়, শুধু যার ঘাম ঝরে, তার লাভ হয় না।
সিন্ডিকেটগুলোর আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো—তারা বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। যেমন পেঁয়াজ বা চালের পাইকারি বাজারে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন দাম বাড়বে, তাহলে বাড়েই। যদি দাম কমানো দরকার হয় (যেমন কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনতে হলে), তাহলে তাঁরা সেটিও করেন। এমনকি কিছু সময় সরকার বাজারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলেও এই সিন্ডিকেটের কাছে তারা কার্যকর হতে পারে না।
এই প্রেক্ষাপটে ‘খানি’র প্রস্তাবিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, মূল্য কমিশন এবং সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল ক্রয়ের উদ্যোগ অত্যন্ত যৌক্তিক। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থাকলে কৃষক অন্তত জানবেন—একটি নির্দিষ্ট দামের নিচে তাঁর ফসল বিক্রি করতে হবে না। মূল্য কমিশন থাকলে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকার নিরপেক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
কৃষি জোনভিত্তিক সংরক্ষণাগার বা কোল্ডস্টোরেজের অভাবও একটি বড় সমস্যা। কৃষক যদি ফসল সংরক্ষণ করতে পারতেন, তাহলে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ছাড়তে পারতেন। এখন যা হয়, তা হলো—ফসল ঘরে তুলেই বাজারে বিক্রি করতে হয়, না হলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। এই দুর্বলতা সিন্ডিকেটের কাছে তাঁকে অসহায় করে তোলে।
বলা হয়, ‘যার জমি, তারই জমি থেকে উপার্জন হওয়ার কথা’। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। একজন কৃষক নিজের জমিতে ফসল ফলিয়ে নিজের সংসার চালাতে পারছেন না। এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কী হতে পারে?
সরকার, উন্নয়ন সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ—তিন পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে, আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি একসময় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। কৃষক ফসল ফলানো বন্ধ করে দিলে শুধু আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে।
আমরা এমন একটি অর্থনীতি চাই না, যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীর অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে উঠবে আর কৃষকের সন্তান স্কুলে ফি দিতে পারবে না। এমনকি সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারও পাবে না। এটা ন্যায্য অবস্থা নয়। তাই সময় এসেছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের—যাতে কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হয়, ভোক্তা পায় সাশ্রয়ী দামে পণ্য এবং দেশের অর্থনীতি হয় টেকসই ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
লেখক: মো. হাবিবুর রহমান, উন্নয়ন ও অধিকারকর্মী
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ কৃষি। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনে যাঁরা কৃষিকে কেন্দ্রে রেখে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের সেই স্বপ্ন আজও পূর্ণতা পায়নি। এই দেশের মাটি এখনো সুফলা, মানুষ এখনো পরিশ্রমী। কিন্তু মাঝখানে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী বাধা—সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট শুধু মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভবান করে না, এটি কৃষিকে অনিরাপদ ও কৃষককে দুর্বল করে তোলে।
২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য উপস্থাপিত হয়, তা কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং একটি জাতীয় সংকটের আলামত। মেহেরপুরের পেঁয়াজচাষি সাইফুল শেখ বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন—কারণ তিনি পণ্যের ন্যায্য দাম পাননি। এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই সংবাদমাধ্যমে আসে, কিন্তু পেছনের কাঠামোগত সংকট আলোচনার কেন্দ্রে আসে না।
এই সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে ‘বাজার সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেট মানে কেবল মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ী নয়, বরং এটি একটি সংগঠিত প্রক্রিয়া—যেখানে উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যবর্তী স্তরগুলো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে। উৎপাদনের মৌসুমে যখন বাজারে সরবরাহ বেশি থাকে, তখন ইচ্ছাকৃতভাবে মূল্য নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়। কৃষক বাধ্য হয়ে উৎপাদন ব্যয় না তুলেই ফসল বিক্রি করেন। পরে ওই পণ্য মজুত রেখে দাম বাড়িয়ে বাজারে ছাড়া হয়, তখন ভোক্তা চড়া দামে তা কিনতে বাধ্য হন।
সাধারণভাবে যাঁদের আমরা ‘ফড়িয়া’ বলি—তাঁরা কৃষকের মাঠেই পণ্য সংগ্রহ করে নেন। এরপর সেটি যায় পাইকারি বাজারে, সেখান থেকে খুচরা বাজারে। প্রতিটি ধাপে অন্তত ১৫-৩০% করে মূল্যবৃদ্ধি হয়। অথচ এই পুরো মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় কৃষকের ভাগ একেবারেই নগণ্য। সবার লাভ হয়, শুধু যার ঘাম ঝরে, তার লাভ হয় না।
সিন্ডিকেটগুলোর আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো—তারা বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। যেমন পেঁয়াজ বা চালের পাইকারি বাজারে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা যদি সিদ্ধান্ত নেন দাম বাড়বে, তাহলে বাড়েই। যদি দাম কমানো দরকার হয় (যেমন কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনতে হলে), তাহলে তাঁরা সেটিও করেন। এমনকি কিছু সময় সরকার বাজারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলেও এই সিন্ডিকেটের কাছে তারা কার্যকর হতে পারে না।
এই প্রেক্ষাপটে ‘খানি’র প্রস্তাবিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, মূল্য কমিশন এবং সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল ক্রয়ের উদ্যোগ অত্যন্ত যৌক্তিক। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থাকলে কৃষক অন্তত জানবেন—একটি নির্দিষ্ট দামের নিচে তাঁর ফসল বিক্রি করতে হবে না। মূল্য কমিশন থাকলে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকার নিরপেক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
কৃষি জোনভিত্তিক সংরক্ষণাগার বা কোল্ডস্টোরেজের অভাবও একটি বড় সমস্যা। কৃষক যদি ফসল সংরক্ষণ করতে পারতেন, তাহলে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ছাড়তে পারতেন। এখন যা হয়, তা হলো—ফসল ঘরে তুলেই বাজারে বিক্রি করতে হয়, না হলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। এই দুর্বলতা সিন্ডিকেটের কাছে তাঁকে অসহায় করে তোলে।
বলা হয়, ‘যার জমি, তারই জমি থেকে উপার্জন হওয়ার কথা’। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। একজন কৃষক নিজের জমিতে ফসল ফলিয়ে নিজের সংসার চালাতে পারছেন না। এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কী হতে পারে?
সরকার, উন্নয়ন সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ—তিন পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে, আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি একসময় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। কৃষক ফসল ফলানো বন্ধ করে দিলে শুধু আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে।
আমরা এমন একটি অর্থনীতি চাই না, যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীর অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে উঠবে আর কৃষকের সন্তান স্কুলে ফি দিতে পারবে না। এমনকি সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবারও পাবে না। এটা ন্যায্য অবস্থা নয়। তাই সময় এসেছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের—যাতে কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হয়, ভোক্তা পায় সাশ্রয়ী দামে পণ্য এবং দেশের অর্থনীতি হয় টেকসই ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
লেখক: মো. হাবিবুর রহমান, উন্নয়ন ও অধিকারকর্মী
রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় এখন যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তার অনেকগুলোই রাজনীতিকেন্দ্রিক। তবে সব কথা অকুণ্ঠচিত্তে মানুষ বলে না। বোঝা যায়, একধরনের সেলফ সেন্সরশিপও আছে। ‘দেয়ালেরও কান আছে’—এ রকম যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।
৮ ঘণ্টা আগেআয় নেই অথচ আয়কর দিতে হচ্ছে। কে কবে শুনেছে এমন ঘটনা! শুনতে অবাক লাগলেও বাংলাদেশে এই ঘটনা সত্যি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা অন্যায্য, বৈষম্যমূলক ও বিড়ম্বনাপূর্ণ।
৮ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও স্পষ্টভাবে তাঁদের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন—তাঁরা ডাকসু নির্বাচন চান, অবিলম্বে ও নিরপেক্ষভাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত পরামর্শক কমিটির সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণকারী ১ হাজার ৭৪৩ শিক্ষার্থীর ৯৬ শতাংশই মনে করেন, ডাকসু ও হল সংসদ...
৮ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে কিছু মানুষ শুধু নেতাই নন, তাঁরা হয়ে ওঠেন সময়ের প্রতিবিম্ব। ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান তেমনই একজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসক হিসেবে ডিগ্রি নিয়েও তিনি গোটা জীবন ব্যয় করেছেন শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে।
১ দিন আগে