হুসাইন আহমদ
মানবিক করিডর এখন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ (হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ) দেওয়ার সম্ভাবনার কথা তুললে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মানবিক সহাcয়তা করিডর দিতে ‘সরকার নীতিগতভাবে সম্মত’ বলে জোরালো আলোচনা ও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কীভাবে ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। করিডরে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন হবে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে কি না, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের দিক, এখানে মিয়ানমার ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সংশ্লিষ্টতার দিকও আছে। সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য না হলে করিডরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। করিডরের জন্য মিয়ানমারে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সব পক্ষ থেকে সম্মতির দরকার হবে। বিশেষ করে, ভারত ও চীন কী ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তা ভাবাটা অপরিহার্য। এসব ঠিকঠাক করে করিডর দেওয়া হলেও তা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন করিডর থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধরত পক্ষ চুক্তি বা সমঝোতা লঙ্ঘন করলে করিডরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এমন ব্যর্থতার উদাহরণ বিরল নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানবিক করিডরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ফলে সরতে থাকা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। আর গাজার জন্য খোলা করিডরেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
কাজেই পর্যাপ্ত নজরদারি, পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মানবিক করিডর পরিচালিত না হলে তা সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গাজা হতে চাই না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডরের বিকল্প প্রস্তাবও জনপরিসরে আসছে। ঠিক কোন জায়গা দিয়ে করিডর দেওয়া হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও যে জায়গাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ গুঞ্জন রয়েছে, সেটি ঠিক বঙ্গোপসাগরের ওপরে। অনেকে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের এ রকম বহু উপকূলীয় জায়গা আছে, যেগুলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সিত্তে বন্দর এ রকম একটি এলাকা হতে পারে। তা ছাড়া ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওয়ের সঙ্গেও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। এই দেশগুলোর কাছেও করিডর চাইতে পারে জাতিসংঘ।
মানবিক করিডরের জন্য যে জায়গাটি নিয়ে আলোচনা চলছে, তা টেকনাফ সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলখালী। আশপাশে ঘন জঙ্গল, গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ। এখানে করিডর করার পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চীনবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের পর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
করিডরে শর্তাবলি কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সরকার যেমন মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে, তেমনি সীমান্তের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়বদ্ধতাও কোনো অংশ কম নয়। রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর করিডরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডরে উপকৃত হলে তা বাংলাদেশের ‘নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সুনামকে’ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
তা ছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, যা নতুন করে মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। তখন করিডর অরক্ষিত হতে পারে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। পোশাকশিল্প, চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর, বিদেশি বিনিয়োগ, এমনকি চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে।
রাখাইনে করিডরকে যেভাবে দেখতে পারে ভারত-চীন
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব মানবিক উদ্যোগ হলেও এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক। দুই দেশেরই রাখাইনে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আরাকান আর্মির কারণে সেই বিনিয়োগ কোনোভাবে ঝুঁকিতে পড়লে তা ভারত ও চীনের জন্য বাস্তব উদ্বেগের কারণ।
রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) বাস্তবায়ন করছে ভারত। এটি সড়ক, নদী ও সমুদ্রপথ—তিনটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমুখী পরিবহনব্যবস্থা। ৪৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের এই প্রকল্প সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে সিত্তে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এখন আরাকান আর্মি বিদেশি সহায়তা পেলে এই প্রকল্প আক্রান্ত হতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির পুরোনো সম্পর্কের পুরোনো উদ্বেগ তো আছেই।
মিয়ানমার জান্তার আরেক বন্ধু চীনেরও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন, যা ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসির) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। এই বন্দর ইউনানের সঙ্গে সংযোগকারী তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রান্তবিন্দু। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সেখানে চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও গ্যাস টার্মিনাল রয়েছে, যা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চীনের পাইপলাইন বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতভিত্তিক একগুচ্ছ প্রকল্পে রাখাইনে চীনের সহায়তায় মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প চলমান আছে।
‘মালাক্কা ডিলেমা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কাছে চীনের কৌশলগত দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র পথ রাখাইন। কারণ, মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। এই পথেই চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিকল্প হিসেবে রাখাইনের বন্দর তৈরি করছে চীন। এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব চীনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ খোঁজে, তাহলে এতে চীন ও ভারতের অসন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ— দুটিই বাড়ার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই করিডরকে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখতে পারে ভারত ও চীন। এতে ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
এখন প্রশ্ন হলো— দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকির বিনিময়ে করিডর দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে। দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হলে সেটা ভাবার হয়তো সুযোগ আছে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মানবিক সহায়তা করিডর হয়তো কিছু জীবন রক্ষা করতে পারে, যদিও এর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ভুল কৌশল নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এই সুযোগে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশলগত অবস্থান তৈরি হবে কি না, তা জাতির জন্য বড় ভাবনার ও আশঙ্কার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—স্বার্থপর ও সাময়িক কূটনৈতিক লাভের ফাঁদে না পড়ে নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
লেখক:
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
মানবিক করিডর এখন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ (হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ) দেওয়ার সম্ভাবনার কথা তুললে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মানবিক সহাcয়তা করিডর দিতে ‘সরকার নীতিগতভাবে সম্মত’ বলে জোরালো আলোচনা ও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কীভাবে ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। করিডরে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন হবে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে কি না, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের দিক, এখানে মিয়ানমার ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সংশ্লিষ্টতার দিকও আছে। সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য না হলে করিডরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। করিডরের জন্য মিয়ানমারে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সব পক্ষ থেকে সম্মতির দরকার হবে। বিশেষ করে, ভারত ও চীন কী ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তা ভাবাটা অপরিহার্য। এসব ঠিকঠাক করে করিডর দেওয়া হলেও তা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন করিডর থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধরত পক্ষ চুক্তি বা সমঝোতা লঙ্ঘন করলে করিডরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এমন ব্যর্থতার উদাহরণ বিরল নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানবিক করিডরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ফলে সরতে থাকা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। আর গাজার জন্য খোলা করিডরেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
কাজেই পর্যাপ্ত নজরদারি, পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মানবিক করিডর পরিচালিত না হলে তা সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গাজা হতে চাই না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডরের বিকল্প প্রস্তাবও জনপরিসরে আসছে। ঠিক কোন জায়গা দিয়ে করিডর দেওয়া হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও যে জায়গাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ গুঞ্জন রয়েছে, সেটি ঠিক বঙ্গোপসাগরের ওপরে। অনেকে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের এ রকম বহু উপকূলীয় জায়গা আছে, যেগুলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সিত্তে বন্দর এ রকম একটি এলাকা হতে পারে। তা ছাড়া ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওয়ের সঙ্গেও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। এই দেশগুলোর কাছেও করিডর চাইতে পারে জাতিসংঘ।
মানবিক করিডরের জন্য যে জায়গাটি নিয়ে আলোচনা চলছে, তা টেকনাফ সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলখালী। আশপাশে ঘন জঙ্গল, গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ। এখানে করিডর করার পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চীনবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের পর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
করিডরে শর্তাবলি কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সরকার যেমন মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে, তেমনি সীমান্তের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়বদ্ধতাও কোনো অংশ কম নয়। রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর করিডরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডরে উপকৃত হলে তা বাংলাদেশের ‘নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সুনামকে’ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
তা ছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, যা নতুন করে মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। তখন করিডর অরক্ষিত হতে পারে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। পোশাকশিল্প, চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর, বিদেশি বিনিয়োগ, এমনকি চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে।
রাখাইনে করিডরকে যেভাবে দেখতে পারে ভারত-চীন
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব মানবিক উদ্যোগ হলেও এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক। দুই দেশেরই রাখাইনে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আরাকান আর্মির কারণে সেই বিনিয়োগ কোনোভাবে ঝুঁকিতে পড়লে তা ভারত ও চীনের জন্য বাস্তব উদ্বেগের কারণ।
রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) বাস্তবায়ন করছে ভারত। এটি সড়ক, নদী ও সমুদ্রপথ—তিনটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমুখী পরিবহনব্যবস্থা। ৪৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের এই প্রকল্প সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে সিত্তে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এখন আরাকান আর্মি বিদেশি সহায়তা পেলে এই প্রকল্প আক্রান্ত হতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির পুরোনো সম্পর্কের পুরোনো উদ্বেগ তো আছেই।
মিয়ানমার জান্তার আরেক বন্ধু চীনেরও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন, যা ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসির) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। এই বন্দর ইউনানের সঙ্গে সংযোগকারী তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রান্তবিন্দু। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সেখানে চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও গ্যাস টার্মিনাল রয়েছে, যা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চীনের পাইপলাইন বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতভিত্তিক একগুচ্ছ প্রকল্পে রাখাইনে চীনের সহায়তায় মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প চলমান আছে।
‘মালাক্কা ডিলেমা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কাছে চীনের কৌশলগত দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র পথ রাখাইন। কারণ, মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। এই পথেই চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিকল্প হিসেবে রাখাইনের বন্দর তৈরি করছে চীন। এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব চীনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ খোঁজে, তাহলে এতে চীন ও ভারতের অসন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ— দুটিই বাড়ার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই করিডরকে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখতে পারে ভারত ও চীন। এতে ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
এখন প্রশ্ন হলো— দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকির বিনিময়ে করিডর দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে। দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হলে সেটা ভাবার হয়তো সুযোগ আছে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মানবিক সহায়তা করিডর হয়তো কিছু জীবন রক্ষা করতে পারে, যদিও এর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ভুল কৌশল নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এই সুযোগে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশলগত অবস্থান তৈরি হবে কি না, তা জাতির জন্য বড় ভাবনার ও আশঙ্কার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—স্বার্থপর ও সাময়িক কূটনৈতিক লাভের ফাঁদে না পড়ে নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
লেখক:
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা-সংশয় যা-ই বলি, এত দিন সে বিষয়টির পরিসর সীমিত ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্য এবং সাধারণত নির্বাক থাকা দেশের আমজনতার মনোজগতে। কিন্তু এখন যখন সরকারপ্রধান নিজেই সেই শঙ্কার কথা ব্যক্ত করছেন, তখন বিষয়টি যে মোটেই অমূলক নয়, তা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না
৫ ঘণ্টা আগেআজ থেকে খুব বেশি দিন না, এই ধরেন, বারো-সাড়ে বারো শ বছর আগের কথা। হীরকরাজ্যে তখনো জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিদ্যা-শিক্ষার চর্চা হতো। রীতিমতো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ৩০০ বছর ধরে শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, বরং চীন, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়াসহ
৫ ঘণ্টা আগে৭ সেপ্টেম্বর বদরুদ্দীন উমরের জীবনের প্রস্থান হয়েছে। তাঁর এই প্রস্থানের মধ্য দিয়ে তিন পুরুষের রাজনৈতিক ধারারও সমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর দাদা আবুল কাসেম ছিলেন তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেসের পার্লামেন্টারিয়ান বোর্ডের সদস্য। বাবা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আর তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট ধারার নেতা।
৫ ঘণ্টা আগেশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়, এটি শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেরও জায়গা। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একটি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে এই মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত হয়, তখন তা
৬ ঘণ্টা আগে