বিভুরঞ্জন সরকার
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড মণি সিংহের জন্মদিন দিন ২৮ জুলাই। ১৯০১ সালে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও ১৯১৭ সালের মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তার প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণ বয়সেই তিনি মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে মানবমুক্তির সংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন। প্রথমে তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করলে দ্রুতই তিনি মালিক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। গত শতকের ত্রিশের দশকেই তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়। প্রথমবারেই কয়েক বছর তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। পরে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জেল, হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকা ছিল তাঁর জন্য একটি সাধারণ ব্যাপার। জেল-জুলুম তাঁকে সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি। শাসক-শোষকদের রক্তচোখ উপেক্ষা করে তিনি তাঁর জীবন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ‘জীবনসংগ্রাম’ নামে যে স্মৃতিকথা লিখেছেন, সেটা আমাদের দেশের বাম-প্রগতিমুখী রাজনীতির একটি ঐতিহাসিক দলিল।
কলকাতা থেকে কারামুক্ত হয়ে সুসং দুর্গাপুরে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে এসে স্থানীয় গরিব মুসলমান ও আদিবাসী হাজং কৃষকদের অনুরোধে টঙ্ক প্রথাবিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা খুব সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ, এতে তাঁকে নিজের জমিদার আত্মীয়দের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হয়েছে। ধনী নিকটাত্মীয় নয়, তিনি গরিব কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের সংগঠিত করে একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। কয়েক বছরের ধারাবাহিক তীব্র আন্দোলনের ফলে একপর্যায়ে টঙ্ক প্রথা বিলোপ হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মুসলিম সরকার তীব্র দমন-পীড়ন শুরু করে। শুধু জেল-জুলুম নয়, পার্টির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরাই বেশি সংখ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। মুসলিম লীগ সরকারের চরম সাম্প্রদায়িক এবং কমিউনিস্টবিরোধী মনোভাবের কারণে সামগ্রিক পরিবেশ কমিউনিস্ট এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একেবারেই অনুকূল ছিল না। সরকারের দমন-পীড়ন সহ্য করতে না পেরে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত অনেক কমিউনিস্ট দেশত্যাগে বাধ্য হন। সেই চরম প্রতিকূল বা বৈরী সময়েও যে সামান্য কয়েকজন মানুষ মাটি কামড়ে পড়ে থেকে এই ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকা বহন করার দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্য মণি সিংহ অন্যতম। এখানে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক একটি রাষ্ট্র গঠনের যে সংগ্রাম, তা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মণি সিংহের মতো মানুষদের অবদান অসামান্য। মণি সিংহের সারা জীবনের চেষ্টায় এখানে বিপ্লবের লাল মশাল প্রজ্বলিত হয়ে হয়তো চারদিক আলোকিত হয়নি, কিন্তু প্রদীপের আলোয় ঘন তমশা দূর করার জন্য সলতে পাকানোর কাজটি ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছেন।
মণি সিংহ যে আর সবার মতো ছিলেন না, মানুষ হিসেবে যে তিনি কত বড় মাপের ছিলেন, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সেদিকে না গিয়ে তাঁর সম্পর্কে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সহযোদ্ধা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কাছে শোনা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকের কথা। কমিউনিস্ট পাটি নিষিদ্ধ। পার্টি নেতাদের কেউ কেউ জেলে। অন্যরা আত্মগোপনে। আত্মগোপনে থাকা নেতারা সাধারণত গভীর রাতে ছদ্মবেশে গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে অন্যদের সঙ্গে দেখা করতেন। এক রাতে গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ রাস্তায় মণি সিংহের দেখা পান। তখন রাতের ঢাকা এখনকার মতো আলোকিত ছিল না। প্রায়ান্ধকার পথে দাঁড়িয়ে দুজন কিছু প্রয়োজনীয় কথা সারছিলেন। এমন সময় দূর থেকে আরেকজন মানুষকে আসতে দেখে মোজাফফর আহমেদ আড়ালে যেতে চাইলে মণি সিংহ তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, এত রাতে আইয়ুব খানের পুলিশ কমিউনিস্টদের খোঁজে রাস্তায় বের হবে না। যিনি আসছেন তিনি হয় কমিউনিস্ট, না হলে চোর। তৃতীয় ব্যক্তি ততক্ষণ তাঁদের কাছে চলে এসেছেন। দেখা গেল তিনি মোহাম্মদ তোয়াহা—একজন কমিউনিস্ট। তিনি আসলে আমাদের দেশে বাম আন্দোলনে একজন অভিভাবকের মতো হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সমর্থক শুভানুধ্যায়ী ছোট বড় সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘বড় ভাই’।
আমার জীবনের একটি পরম প্রাপ্তি এটাই যে, আমি মণি সিংহের মতো একজন অসাধারণ বিপ্লবীর ব্যক্তিগত সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্কুলছাত্র থাকতেই মিছিলে স্লোগান দিয়েছি, মণি সিংহের মুক্তি চাই। তবে তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরিচয় ১৯৭৩ সালে।
১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম অংশগ্রহণ করে। সেই নির্বাচনে আমাদের এলাকা (পঞ্চগড়) থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কামরুল হোসেন কামু। তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পঞ্চগড়ে গিয়ে মণি সিংহ আমাদের বোদার বাড়িতে তিন রাত ছিলেন। তখন আমার বাবা-মায়ের সঙ্গেও তাঁর হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল। বাবা রাজনীতির মানুষ না হলেও তিনি ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মণি সিংহ খুব খুশি হয়েছিলেন। ঢাকায় আসার পর সে কথা আমাকে একাধিকবার বলেছেন। আমার মা এখনো তাঁর স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করেন।
১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মণি সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ে এবং আমৃত্যু সেটা অটুট ছিল। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, পছন্দ করতেন। বিশেষ করে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও আমি যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রচলিত পথে হাঁটিনি, তার জন্য তিনি হয়তো আমাকে একটু বেশি আদর করতেন।
মণি সিংহ একজন বড় কমিউনিস্ট নেতা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন বড় মনের মানুষও। তিনি এই ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিই শুধু মজবুত করেননি, এখানে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাতেও পুষ্টি জুগিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি রাজশাহী জেলে বন্দী ছিলেন। জেলখানা ভেঙে সহবন্দীরা তাঁকে মুক্ত করলে ভারতে চলে যান। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা দল গঠনে তিনি ছিলেন উদ্যোগী ভূমিকায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রেও মণি সিংহ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকারের পরামর্শক কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিলেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে সমীহ করতেন, ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁদের মধ্যে ছিল গভীর রাজনৈতিক বোঝাপড়া। ১৯৬২ সালে মণি সিংহের সঙ্গে শেখ মুজিবের গোপন বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতির জন্য একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষের দিক মণি সিংহ মস্কো যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা আমাকে মারতে পারেনি। কোনো বাঙালি আমাকে কেন মারবে। আমি বরং আপনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। মস্কো থেকে ফিরে আসুন, দেখি আপনার মতো প্রবীণ ত্যাগী নেতাদের জন্য কী করা যায়।
মণি সিংহ দেশে ফেরার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল খুনি বিশ্বাসঘাতক বাঙালি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিমুখ বদলে দেয়।
প্রসঙ্গত, আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৭৭ সাল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে অত্যন্ত প্রতাপশালী হয়ে উঠেছেন। এক সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গভবনে মণি সিংহসহ কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে জিয়া দৃশ্যত ৭৭ বছর বয়সী প্রবীণ রাজনীতিবিদ মণি সিংহকে সমীহই করেছেন। আলোচনা শেষে দরজা পর্যন্ত এগিয়েও দিয়েছেন। আবার সেই রাতেই পুলিশ মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যায়। ছয় মাস তাঁকে জেলে থাকতে হয়। মণি সিংহের মতো নেতাকে কি জিয়ার অনুমোদন ছাড়া পুলিশের পক্ষে গ্রেপ্তার করা সম্ভব ছিল?
আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অমীমাংসিত। তবে মণি সিংহের মতো নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতার জন্ম-মৃত্যু দিন জাতীয়ভাবে পালন না করা দুঃখজনক। জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমাকে লেখা তাঁর একটি ছোট চিঠি এখানে প্রকাশ করছি। ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি চিঠিটিতে মণি সিংহ লিখছেন—
প্রিয় বিভু,
দুইটি মৃত্যু সংবাদ পাঠাইলাম
এর মধ্যে যে টুকু বাদ দিয়া আর যে টুকু রাখা যায় রাখিয়া এই সংবাদ একতায় ছাপাইয়া দিও। আগামী সপ্তাহে দিলেই ভালো হয়।
সংবাদ দুইটি আবার লিখিয়া ঠিক করিয়া দিতে হইবে।
অভিনন্দনসহ
মণি সিংহ
আমি কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘একতা’য় প্রায় এক দশক কাজ করেছি। মণি সিংহ যত দিন সুস্থ ছিলেন, তত দিন মাঝেমধ্যেই এ রকম আরও অনেক চিরকুট আমাকে পাঠাতেন, খবর প্রকাশের জন্য কিংবা প্রকাশিত খবরের ওপর তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে।
শোষণ বৈষম্যমুক্ত সাম্যভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমৃত্যু সাহসী যোদ্ধা মণি সিংহকে ভুলে যাওয়া জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যের প্রকাশ।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড মণি সিংহের জন্মদিন দিন ২৮ জুলাই। ১৯০১ সালে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও ১৯১৭ সালের মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তার প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণ বয়সেই তিনি মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে মানবমুক্তির সংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন। প্রথমে তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করলে দ্রুতই তিনি মালিক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। গত শতকের ত্রিশের দশকেই তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়। প্রথমবারেই কয়েক বছর তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। পরে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জেল, হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকা ছিল তাঁর জন্য একটি সাধারণ ব্যাপার। জেল-জুলুম তাঁকে সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি। শাসক-শোষকদের রক্তচোখ উপেক্ষা করে তিনি তাঁর জীবন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ‘জীবনসংগ্রাম’ নামে যে স্মৃতিকথা লিখেছেন, সেটা আমাদের দেশের বাম-প্রগতিমুখী রাজনীতির একটি ঐতিহাসিক দলিল।
কলকাতা থেকে কারামুক্ত হয়ে সুসং দুর্গাপুরে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে এসে স্থানীয় গরিব মুসলমান ও আদিবাসী হাজং কৃষকদের অনুরোধে টঙ্ক প্রথাবিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা খুব সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ, এতে তাঁকে নিজের জমিদার আত্মীয়দের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করতে হয়েছে। ধনী নিকটাত্মীয় নয়, তিনি গরিব কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের সংগঠিত করে একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। কয়েক বছরের ধারাবাহিক তীব্র আন্দোলনের ফলে একপর্যায়ে টঙ্ক প্রথা বিলোপ হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মুসলিম সরকার তীব্র দমন-পীড়ন শুরু করে। শুধু জেল-জুলুম নয়, পার্টির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরাই বেশি সংখ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। মুসলিম লীগ সরকারের চরম সাম্প্রদায়িক এবং কমিউনিস্টবিরোধী মনোভাবের কারণে সামগ্রিক পরিবেশ কমিউনিস্ট এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একেবারেই অনুকূল ছিল না। সরকারের দমন-পীড়ন সহ্য করতে না পেরে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত অনেক কমিউনিস্ট দেশত্যাগে বাধ্য হন। সেই চরম প্রতিকূল বা বৈরী সময়েও যে সামান্য কয়েকজন মানুষ মাটি কামড়ে পড়ে থেকে এই ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকা বহন করার দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্য মণি সিংহ অন্যতম। এখানে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক একটি রাষ্ট্র গঠনের যে সংগ্রাম, তা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মণি সিংহের মতো মানুষদের অবদান অসামান্য। মণি সিংহের সারা জীবনের চেষ্টায় এখানে বিপ্লবের লাল মশাল প্রজ্বলিত হয়ে হয়তো চারদিক আলোকিত হয়নি, কিন্তু প্রদীপের আলোয় ঘন তমশা দূর করার জন্য সলতে পাকানোর কাজটি ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছেন।
মণি সিংহ যে আর সবার মতো ছিলেন না, মানুষ হিসেবে যে তিনি কত বড় মাপের ছিলেন, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সেদিকে না গিয়ে তাঁর সম্পর্কে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সহযোদ্ধা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কাছে শোনা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকের কথা। কমিউনিস্ট পাটি নিষিদ্ধ। পার্টি নেতাদের কেউ কেউ জেলে। অন্যরা আত্মগোপনে। আত্মগোপনে থাকা নেতারা সাধারণত গভীর রাতে ছদ্মবেশে গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে অন্যদের সঙ্গে দেখা করতেন। এক রাতে গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ রাস্তায় মণি সিংহের দেখা পান। তখন রাতের ঢাকা এখনকার মতো আলোকিত ছিল না। প্রায়ান্ধকার পথে দাঁড়িয়ে দুজন কিছু প্রয়োজনীয় কথা সারছিলেন। এমন সময় দূর থেকে আরেকজন মানুষকে আসতে দেখে মোজাফফর আহমেদ আড়ালে যেতে চাইলে মণি সিংহ তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, এত রাতে আইয়ুব খানের পুলিশ কমিউনিস্টদের খোঁজে রাস্তায় বের হবে না। যিনি আসছেন তিনি হয় কমিউনিস্ট, না হলে চোর। তৃতীয় ব্যক্তি ততক্ষণ তাঁদের কাছে চলে এসেছেন। দেখা গেল তিনি মোহাম্মদ তোয়াহা—একজন কমিউনিস্ট। তিনি আসলে আমাদের দেশে বাম আন্দোলনে একজন অভিভাবকের মতো হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সমর্থক শুভানুধ্যায়ী ছোট বড় সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘বড় ভাই’।
আমার জীবনের একটি পরম প্রাপ্তি এটাই যে, আমি মণি সিংহের মতো একজন অসাধারণ বিপ্লবীর ব্যক্তিগত সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্কুলছাত্র থাকতেই মিছিলে স্লোগান দিয়েছি, মণি সিংহের মুক্তি চাই। তবে তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরিচয় ১৯৭৩ সালে।
১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম অংশগ্রহণ করে। সেই নির্বাচনে আমাদের এলাকা (পঞ্চগড়) থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন কামরুল হোসেন কামু। তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পঞ্চগড়ে গিয়ে মণি সিংহ আমাদের বোদার বাড়িতে তিন রাত ছিলেন। তখন আমার বাবা-মায়ের সঙ্গেও তাঁর হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল। বাবা রাজনীতির মানুষ না হলেও তিনি ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মণি সিংহ খুব খুশি হয়েছিলেন। ঢাকায় আসার পর সে কথা আমাকে একাধিকবার বলেছেন। আমার মা এখনো তাঁর স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করেন।
১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মণি সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ে এবং আমৃত্যু সেটা অটুট ছিল। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, পছন্দ করতেন। বিশেষ করে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও আমি যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রচলিত পথে হাঁটিনি, তার জন্য তিনি হয়তো আমাকে একটু বেশি আদর করতেন।
মণি সিংহ একজন বড় কমিউনিস্ট নেতা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন একজন বড় মনের মানুষও। তিনি এই ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিই শুধু মজবুত করেননি, এখানে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাতেও পুষ্টি জুগিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন তিনি রাজশাহী জেলে বন্দী ছিলেন। জেলখানা ভেঙে সহবন্দীরা তাঁকে মুক্ত করলে ভারতে চলে যান। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা দল গঠনে তিনি ছিলেন উদ্যোগী ভূমিকায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রেও মণি সিংহ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকারের পরামর্শক কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিলেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে সমীহ করতেন, ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। তাঁদের মধ্যে ছিল গভীর রাজনৈতিক বোঝাপড়া। ১৯৬২ সালে মণি সিংহের সঙ্গে শেখ মুজিবের গোপন বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতির জন্য একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষের দিক মণি সিংহ মস্কো যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা আমাকে মারতে পারেনি। কোনো বাঙালি আমাকে কেন মারবে। আমি বরং আপনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। মস্কো থেকে ফিরে আসুন, দেখি আপনার মতো প্রবীণ ত্যাগী নেতাদের জন্য কী করা যায়।
মণি সিংহ দেশে ফেরার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল খুনি বিশ্বাসঘাতক বাঙালি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিমুখ বদলে দেয়।
প্রসঙ্গত, আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৭৭ সাল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে অত্যন্ত প্রতাপশালী হয়ে উঠেছেন। এক সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গভবনে মণি সিংহসহ কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে জিয়া দৃশ্যত ৭৭ বছর বয়সী প্রবীণ রাজনীতিবিদ মণি সিংহকে সমীহই করেছেন। আলোচনা শেষে দরজা পর্যন্ত এগিয়েও দিয়েছেন। আবার সেই রাতেই পুলিশ মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যায়। ছয় মাস তাঁকে জেলে থাকতে হয়। মণি সিংহের মতো নেতাকে কি জিয়ার অনুমোদন ছাড়া পুলিশের পক্ষে গ্রেপ্তার করা সম্ভব ছিল?
আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অমীমাংসিত। তবে মণি সিংহের মতো নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতার জন্ম-মৃত্যু দিন জাতীয়ভাবে পালন না করা দুঃখজনক। জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমাকে লেখা তাঁর একটি ছোট চিঠি এখানে প্রকাশ করছি। ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি চিঠিটিতে মণি সিংহ লিখছেন—
প্রিয় বিভু,
দুইটি মৃত্যু সংবাদ পাঠাইলাম
এর মধ্যে যে টুকু বাদ দিয়া আর যে টুকু রাখা যায় রাখিয়া এই সংবাদ একতায় ছাপাইয়া দিও। আগামী সপ্তাহে দিলেই ভালো হয়।
সংবাদ দুইটি আবার লিখিয়া ঠিক করিয়া দিতে হইবে।
অভিনন্দনসহ
মণি সিংহ
আমি কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘একতা’য় প্রায় এক দশক কাজ করেছি। মণি সিংহ যত দিন সুস্থ ছিলেন, তত দিন মাঝেমধ্যেই এ রকম আরও অনেক চিরকুট আমাকে পাঠাতেন, খবর প্রকাশের জন্য কিংবা প্রকাশিত খবরের ওপর তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে।
শোষণ বৈষম্যমুক্ত সাম্যভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমৃত্যু সাহসী যোদ্ধা মণি সিংহকে ভুলে যাওয়া জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যের প্রকাশ।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
গত সংখ্যায় লিখেছিলাম, এখন আর ছাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না, চারদিকে পরীক্ষার্থী। কিন্তু দ্রুতই দেখা যাচ্ছে, ছাত্র এবং পরীক্ষার্থী কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছাত্রদের একটা বৃহদাংশ রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের অঙ্গুলি হেলনে বড় বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম প্রাথমিক শিক্ষা
১৫ ঘণ্টা আগেবিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীজুড়ে বহির্জাগতিক প্রাণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছেন। খুঁজেছেন কার্বনভিত্তিক, সিলিকনভিত্তিক বা অ্যামোনিয়া যৌগনির্ভর প্রাণ। এটা আমাদের জানা জরুরি যে প্রাণের প্রকৃতি, আর অন্য জায়গায় প্রাণ আছে কি না, তা আসলে একই প্রশ্নের দুটো দিক। তা হলো, ‘কেন আমরা এখানে?’ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে,
১৫ ঘণ্টা আগেপরিবার হলো মূলত রক্ত-সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সংগঠন, যেখানে সব সদস্যের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং বিনোদনের আয়োজন হয়ে থাকে। পরিবার কখন কী কারণে গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বেশির ভাগের মত হলো, মানুষ সমতলে বসবাস করার সময় কৃষিকাজ শিখে ফেলে। কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য গোলাঘর
১৫ ঘণ্টা আগেনিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি, এ কথা নতুন নয়। এবং এ ব্যাপারে প্রমাণের অভাব নেই। একটা কিছু নিষিদ্ধ করলেই যে তা ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে যাবে, এমন ভাবাটাই ভুল। ধরুন, একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে সেই দলটি যে ছদ্মবেশে বা তলে তলে রাজনীতি করবে না, সেই গ্যারান্টি কে দিতে পারে? তেমনি কেউ
১৫ ঘণ্টা আগে