Ajker Patrika

ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন দিকে যাবে

আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ০৮: ২০
ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন দিকে যাবে

দেশে কী ঘটছে, রাজনীতির গতিমুখ কোন দিকে—এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহল ও আগ্রহের শেষ নেই। অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন, জবাব নেই প্রায় কোনো প্রশ্নেরই। রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো জ্যোতিষীরও দেখা পাওয়া ভার। তবে গুজব, রটনা, কানকথার কোনো অভাব নেই। আমরা যাঁরা গণমাধ্যমে কাজ করি, আমাদের সঙ্গে পরিচিতজনদের দেখা হলেই তাঁরা খবর জানতে চান। খবর মানে ‘আসল’ খবর। আর আজকাল ‘আসল’ খবর মানেই ঘটনা নয়, রটনা। কারও কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি বলার মতো কোনো খবর বা তথ্য সত্যি আছে কি? আমার কাছে অন্তত হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার মতো তেমন কোনো গোপন খবর নেই। তাই এই লেখা পড়ে পাঠক হতাশ হতে পারেন, আমাকে গালমন্দও করতে পারেন। এখন যেটা সবচেয়ে সহজ ‘ট্যাগ’ লাগানো, সেটাও লাগাতে পারেন। তারপরও লিখতে হচ্ছে। কারণ এটাই আমার কাজ, পেশা, রুটিরুজির উপায়।

গত বছর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসানের পর আশা করা হয়েছিল, এবার দেশটা সত্যি নতুন পথে চলবে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে। ব্যক্তি, দল ও নেতা নয়, গুরুত্ব পাবে জনস্বার্থ, সমষ্টির স্বার্থ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সুযোগ গ্রহণ করবে। যাদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল হলো, তারা জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করবে। তারা ক্ষমতার বাইরে থেকে জনতার হয়ে প্রেসার গ্রুপের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু আজ ৯ মাস পর কী দেখা যাচ্ছে? নতুন মুখ, পুরোনো পথ। পাওয়া ও খাওয়ার ধারা অব্যাহত।

স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বময় সময় চলছে। দৃশ্যমান বাস্তবতা এক রকম আর জনমানসে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরপাক খাওয়া ব্যাখ্যা অন্য রকম। একদিকে একটি রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ—যাদের একসময় ‘অপরিহার্য’ বলেই গণ্য করা হতো, তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে, এ নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে নানা প্রতিক্রিয়া, হিসাব-নিকাশ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাবার্তা উঠে আসছে, যার সিংহভাগই রটনার পরিসরে পড়ে যায়। তবে রটনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বাস্তবতার আভাস। বাংলাদেশে রাজনীতি কখনোই সরলরেখায় চলে না; বরং ছায়া ও প্রতিচ্ছবির মধ্য দিয়ে এগোয়। এ মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক ভাষ্য, প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা—সবকিছুই যেন এক জটিল ধাঁধায় পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা নিয়ে যাঁরা এত দিন বলতেন, ‘সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর’, তাঁরাই এখন প্রকাশ্যে এই নিষেধাজ্ঞায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন। তাঁদের বক্তব্যে নতুন ভাষা—এমনটাই নাকি তাঁদের চাওয়া ছিল। চাওয়া পূরণ হওয়ায় এখন নিশ্চয়ই তাঁরা আনন্দচিত্তে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াবেন।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে কার লাভ হলো আর কার ক্ষতি হলো, সেটি এখনই স্পষ্ট নয়। সময়ই এর উত্তর দেবে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ও দেশ ছাড়ার পরই এটা বোঝা গিয়েছিল যে আওয়ামী লীগ আর সহজে দল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না এবং শেখ হাসিনার ‘টুক’ করে দেশে ফেরার স্বপ্নও পূরণ হবে না।

কল্পনাবিলাসীরা কয়েক মাস ধরে অনেক কল্পগল্প ছড়িয়েছে। তাতে আওয়ামী লীগের বা শেখ হাসিনার কোনো লাভ হয়নি। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এখন বিচারের মুখোমুখি, শাস্তি পাওয়ার অপেক্ষায়।

তবে বিএনপির হিসাব-নিকাশ যে এমন বরবাদ হবে, এটা সম্ভবত এই দলের কেউ ভাবেননি, বোঝেননি। আওয়ামী লীগের পতন মানেই বিএনপির উত্থান—এই সরল হিসাব যাঁরা কষেছিলেন, তাঁরা এখন বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছেন, শুধু যোগ-বিয়োগই অঙ্ক নয়, অঙ্কে গুণ-ভাগও আছে। অঙ্কের ফলাফল সব সময় মেলে না, বিএনপির ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটছে?

বিএনপি যেভাবে হাসিনা-পরবর্তী পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার বা রাজনৈতিকভাবে পুনর্জাগরণের সুযোগ হিসেবে দেখেছে, তা তেমনভাবে কাজ করছে কি? চিকিৎসার জন্য দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া, কিছুটা সুস্থ হয়ে দেশে ফেরা, তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া—এসব ঘটনায় বিএনপির থলেতে কী রত্ন সঞ্চিত হলো? কর্মী-সমর্থকেরা খুশিতে উদ্বাহু নৃত্য করলেও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও বয়স তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। আবার তাঁর পুত্র তারেক রহমান, যিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন, তিনি লন্ডনে দীর্ঘ নির্বাসন জীবন পার করছেন। তাঁর দেশে ফেরার বিষয়ে দলটির অভ্যন্তরেও কোনো স্পষ্টতা নেই। বরং, তারেক রহমানের স্ত্রীর দেশে ফেরা, আদালতের রায়ের পর পুনরায় চিকিৎসক হিসেবে চাকরি ফিরে পাওয়া—এসব ঘটনাও জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিএনপির নেতারা কেউই এখন খোলামেলাভাবে বলতে পারছেন না যে কে হচ্ছেন ভবিষ্যতের কান্ডারি, কে দলীয় রাজনীতির হাল ধরবেন।

শূন্যতা পূরণের জন্য নতুন কিছু দল ও মুখ সামনে আসছে। কিন্তু এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা, জনসমর্থন ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কিছু সামাজিক আন্দোলনভিত্তিক সংগঠন রাজনৈতিক পরিসরে ঢোকার চেষ্টা করছে, আবার কিছু পুরোনো ইসলামপন্থী শক্তি নতুন মোড়কে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। যারা এত দিন জামায়াতকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, এখন তারাই ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ প্রতিষ্ঠার নামে কিছু কিছু জামায়াতসংশ্লিষ্ট বা জামায়াত-বান্ধব চিন্তাকে জায়গা দিচ্ছে। একশ্রেণির রাজনীতিভিত্তিক বুদ্ধিজীবী আজ জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে ঘৃণার সম্পর্ক বাদ দিয়ে ‘সামাজিক বাস্তবতা’র কথা বলছেন। এদিকে রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গেও নতুন করে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেই তৎপরতা আদৌ নৈতিক প্রেরণায়, নাকি রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে।

এই অস্থির প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গা হলো তথ্য ও অপতথ্যের বন্যা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনী নিয়ে গুজব, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ বা বরখাস্তের গুজব, জরুরি অবস্থা জারির বিভ্রান্তিকর তথ্য—এসব যেন একধরনের পরিকল্পিত নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়। দেশের সর্বোচ্চ পেশাদার বাহিনী—সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়ানো মানেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আস্থার কাঠামোতে আঘাত হানা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্টভাবে বলেছেন, এই ধরনের গুজব ছড়ানো পরিকল্পিত। তথ্য অধিদপ্তরও বলছে, কিছু মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপতথ্য ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। সম্প্রতি ‘রিউমর স্ক্যানার’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে, সেনাবাহিনী ও সরকারের উচ্চমহলকে ঘিরে ছড়ানো বেশির ভাগ খবরই ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এই অপতথ্য আর গুজবের মূল ভিত্তি হলো অনিশ্চয়তা। কেউ জানে না আগামী সপ্তাহে বা মাসে রাজনৈতিক অবস্থা কোথায় দাঁড়াবে। নির্বাচন ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না, হলে কারা অংশ নেবে—এসব প্রশ্নের জবাব নেই। এই অনিশ্চয়তার সুযোগেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের পরিকল্পনায় কাজ করছে। কেউ সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে সামনে রেখে একটি নতুন ‘জাতীয় বিকল্প’ তৈরি করতে চাইছে, কেউ পুরোনো শত্রুমিত্র ভুলে নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে, কেউ আবার রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘নতুন ভারসাম্য’ গঠনের দিকেই মনোযোগী।

তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেই একধরনের সতর্ক আশাবাদও কাজ করছে। জনগণের মধ্যে এখন আগের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যাচ্ছে। কেউ আর অন্ধভাবে মেনে নিচ্ছে না কোনো কিছু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব যেমন আছে, তেমনই বিশ্লেষণ, তথ্য ও সচেতন কথাবার্তাও বেড়েছে। তরুণ প্রজন্ম কেবল আবেগে নয়, যুক্তিতে অংশ নিচ্ছে আলোচনায়। এর মানে হলো, যদিও রাজনৈতিক দলগুলো আজ প্রশ্নবিদ্ধ, তবে রাজনীতি নিজে এখনো জীবন্ত, আলোচনাযোগ্য ও পরিবর্তনশীল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি পুরোনো বিতর্ক আবার নতুন করে ফিরে এসেছে—‘পাকিস্তানপন্থা’ বনাম ‘বাংলাদেশপন্থা’। যদিও এই দ্বন্দ্ব ১৯৭১ সালে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। বাস্তবতা বলছে, এর ছায়া আজও আমাদের রাজনীতির শরীরে বিদ্যমান। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক আসিফ মাহমুদ যখন বলেন, ‘দিল্লির গোলামি ছিন্ন করেছি, পিন্ডির দাসত্ব করব না’, তখন সেটি কেবল কূটনৈতিক নিরপেক্ষতার আহ্বান নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রীয় চেতনার ঘোষণাও বটে। তাঁর এই বক্তব্য মওলানা ভাসানীর অতীত উচ্চারণের প্রতিধ্বনি, কিন্তু একুশ শতকের ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।

এই বক্তব্য যে সময়ে এসেছে, সেই সময়টাও তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান ছিল এক প্রজন্মের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধ, যেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যবধান ভুলে ছাত্ররা একত্র হয়েছিল। তারা কেবল বিদ্যমান নিপীড়ন ও দমননীতির বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রিক দর্শনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল—যার ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ন্যায়বিচার।

তথ্য উপদেষ্টা ও জুলাই অভ্যুত্থানের নেতা মাহফুজ আলম যখন বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে’, তখন তা শুধুই প্রতিপক্ষবিরোধী বক্তব্য থাকে না, তা হয়ে দাঁড়ায় এক নৈতিক উচ্চারণ। যারা ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে অস্বীকার করেছে, যারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দোসর হয়ে বাঙালি হত্যার সহযোগী ছিল, যারা

এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা বরং তারা নানা কৌশলে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে উঠেপড়ে লেগেছে এবং সুযোগ পেলেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছে, তাদের প্রতি ঔদার্য দেখানো সঠিক নয়।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন দিকে যাবে, তা এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে কোনো একক দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্যের দিন শেষ। এখন দরকার একটি অন্তর্মুখী মূল্যায়ন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের ইতিহাস ও ভুলের মুখোমুখি হওয়া এবং একটি কার্যকর, অংশগ্রহণমূলক ও দায়বদ্ধ ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে দূরে রাখাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। আর সবচেয়ে জরুরি হলো—গুজব নয়, বাস্তবতা নিয়ে কথা বলা। রাজনীতি যতটা সত্যনিষ্ঠ হবে, ততটাই গণতন্ত্র দৃঢ় হবে।

লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার

জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিষাক্ত গ্যাস

সম্পাদকীয়
বিষাক্ত গ্যাস

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?

চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।

আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?

এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রশ্নবিদ্ধ উপদেষ্টারা ও সরকারের নিরপেক্ষতা

অরুণ কর্মকার
প্রশ্নবিদ্ধ উপদেষ্টারা ও সরকারের নিরপেক্ষতা

না, সব উপদেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ নন। তবে সংখ্যাটা যে নেহাত কম হবে না, তা অনুমান করা যায় যখন প্রধান তিনটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলই আলাদা আলাদাভাবে উপদেষ্টাদের দলঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তোলে। অবশ্য এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একই অভিযোগ তোলা হয়েছে, যখন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম কোনো কোনো উপদেষ্টার সেফ এক্সিটের প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। আর এবার তো জানা গেল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দৃষ্টিতে দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের নামধামের তালিকাই নিয়ে গিয়েছিল। তবে ওই দিন সেই তালিকা তারা প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়নি। প্রয়োজন হলে পরে দেবে। এবার শুধু বিষয়টি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেছে।

শুধু উপদেষ্টা নয়, জামায়াত সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিল প্রায় ৪০ জন আমলারও, যাঁরা তাদের দৃষ্টিতে কোনো না কোনো দলের হয়ে, বিশেষত বিএনপির হয়ে কাজ করছেন। আর বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ ব্রিফিংয়ে জামায়াতের নেতারা উল্লেখ করেছেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকই বিএনপির। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জামায়াত বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। এ জন্য সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে রদবদল আনতে হবে। বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের আরও অভিযোগ, বিএনপি রাজনৈতিক চাপে পড়ে গণভোটে রাজি হলেও এখন জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

ওই দিনই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধিদলও পৃথকভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, তাঁরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন ও পুলিশে নিজেদের মতো ভাগ-বাঁটোয়ারা শুরু করেছে। ডিসি-এসপিদের তালিকা করে সরকারকে দিচ্ছে এবং সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্য থেকেও এ ব্যাপারে তারা সহযোগিতা পাচ্ছে।

এনসিপির আরও বড় অভিযোগ নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে। প্রধান উপদেষ্টাকে তারা বলেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। কোনো কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। শাপলা প্রতীক পাওয়া প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলামের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, যে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন এবং প্রতীকের বিষয়ে এনসিপির সঙ্গে ন্যায়বিচার করে না, তার অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ন্যায়বিচার এবং নিরপেক্ষতা বা সঠিক ফলাফল পাওয়ার ব্যাপারে ভরসা করা যায় না। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি হলো, নির্বাচন কমিশনের কারণে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়, সেই দায়ও সরকারের ওপরই পড়বে।

উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রশ্ন আছে বিএনপিরও। জামায়াত ও এনসিপির এক দিন আগে, গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। সেই বৈঠকে তারাও কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছে। কারও নাম উল্লেখ না করেই বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছে দলটি। এর আগেও বিএনপির পক্ষ থেকে এমন আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল বলেও খবর বেরিয়েছে। তবে তাঁরা তখনই তাতে রাজি হননি। উপদেষ্টাদের ছাড়াও প্রশাসন নিয়েও অন্য দুই দলের মতোই উদ্বেগ আছে বিএনপিরও। মঙ্গলবারের বৈঠকে তারা এই বলে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে প্রশাসন, পুলিশ এবং বিচার বিভাগের প্রায় ৫০ ভাগ ফ্যাসিস্টের দোসর।

তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠকেই প্রধান উপদেষ্টা সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি; সামনে আরও অনেক উদ্যোগ আপনারা দেখতে পাবেন।’

তা প্রধান উপদেষ্টা যতই নিশ্চয়তা দিন না কেন, যেখানে সব দলের কাছেই উপদেষ্টাদের (সবার নয়) এবং প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা স্পষ্ট, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে উল্লেখ করে যখন প্রকাশ্যে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নিশ্চিন্তে নিশ্চিত থাকতে পারে! তা ছাড়া, মাঝেমধ্যেই তো দলগুলোর পরস্পরের প্রতি বৈরী বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যেমন কিছুদিন আগে এনসিপির আহ্বায়ক তাঁর ফেসবুক পোস্টে বললেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) নিয়ে জামায়াতের আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। কিংবা জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের আগে-পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি। তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি। কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বললেন আরও একটু শক্ত কথা—‘জন্মের পরই বাপের সাথে পাল্লা দিতে যেও না।’ সরকার ভাবতে পারে যে এগুলো তো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার বাহাস। এটা নিয়ে তাদের অতটা না ভাবলেও চলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাহাসগুলো তো রাজনৈতিক বাস্তবতা। এগুলো তো রাজনৈতিক অঙ্গনকে অস্থিতিশীল করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশেও প্রভাব ফেলতে পারে।

তারপর উল্লেখ করা যায় মঙ্গলবারের বৈঠকে বিএনপি যে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, সে সম্পর্কে এনসিপির প্রতিক্রিয়ার কথা। এনসিপি বলল হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শটি দুরভিসন্ধিমূলক। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি তাদের ম্যান্ডেট। অথচ বিএনপির বক্তব্যটি ছিল—নিরপেক্ষতার নিরিখে এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিতে হবে।

এইসব রাজনৈতিক টানাপোড়েন ছাড়াও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। যেমন জামায়াতের কাছে অমীমাংসিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, ওই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরে গণভোট। এই দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এনসিপির কাছে অমীমাংসিত বিষয় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং তাদের দাবিকৃত নির্বাচনী প্রতীক শাপলা বরাদ্দ দেওয়া। বিএনপির কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচন। এ ছাড়া এই তিনটি দলের কাছেই (হয়তো আরও অনেক দলের কাছে) সাধারণ ইস্যু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে বেশ কিছু বিষয় প্রতিটি দল চায় না। এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেই ভূমিকা নিরপেক্ষ হিসেবেই প্রতীয়মান হওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জই বটে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাঠকের লেখা /স্বার্থের সমাজে বন্ধুত্ব

হেনা শিকদার
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১১
স্বার্থের সমাজে বন্ধুত্ব

সমাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে, পৃথিবী প্রবেশ করেছে এক নতুন যুগে। এই গতিময় সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা হয়তো অনেক কিছু পাচ্ছি, কিন্তু হারিয়ে ফেলছি আরও বেশি কিছু। আজ আমরা এক অদ্ভুত স্বার্থপর সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রতিটি সম্পর্কের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি। এমন এক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে যে সম্পর্কটি, মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকে—বন্ধুত্ব।

একসময় বন্ধুত্ব ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক দারুণ উদাহরণ। সেখানে লেনদেনের কোনো হিসাব ছিল না, ছিল শুধু একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা এবং নির্ভরতা। শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা মনে করলে আজও অনেকের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। টিফিনের খাবার ভাগ করে খাওয়া, বন্ধুর দুঃখে নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়ানো, কিংবা সামান্য কারণে অহেতুক ঝগড়া করে আবার মুহূর্তেই সব ভুলে গিয়ে একে অপরের হাত ধরার মধ্যে যে পবিত্রতা ছিল, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায় তা যেন এক দুর্লভ বস্তু।

বর্তমান সমাজব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে সবকিছুকে ব্যক্তিগত লাভের নিরিখে বিচার করতে হয়। আমরা এখন বন্ধু বানানোর আগেও অবচেতন মনে বিচার করে নিই—এই সম্পর্কটি আমার জীবনে কতটা মূল্য যোগ করবে? তার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, কিংবা তার মাধ্যমে আমার কোনো উপকার হবে কি না—এইসব প্রশ্নই এখন বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, একধরনের ‘শর্তাধীন’ বন্ধুত্বের জন্ম হচ্ছে, যেখানে স্বার্থের লেনদেন শেষ হলেই সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়। এই ধরনের বন্ধুত্ব অনেকটা ব্যবসায়িক চুক্তির মতো, যেখানে একে অপরকে ব্যবহার করে নিজের আখের গোছানোই মূল উদ্দেশ্য।

এই স্বার্থপরতার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। প্রথমত, আধুনিক জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং প্রতিযোগিতা মানুষকে এতটাই আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে যে, সে নিজের জগৎ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তার এক মায়াবী জগতের সৃষ্টি করেছে। এখানে মানুষের বন্ধুর সংখ্যা হাজার হাজার, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভরসা করার মতো বন্ধুর সংখ্যা প্রায় শূন্য। লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব আসলে একধরনের লোকদেখানো সম্পর্ক, যার গভীরে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই। এখানে সবাই যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে—কার কত বন্ধু, কে কতটা জনপ্রিয়। এই জাঁকজমকপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের সত্যিকারের আবেগ এবং অনুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তবে এই হতাশাজনক চিত্রের মধ্যেও আশার আলো রয়েছে। স্বার্থের এই ঝোড়ো হাওয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়েও কিছু মানুষ এখনো সত্যিকারের বন্ধুত্বের পতাকা উড়িয়ে চলেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, বন্ধুত্ব মানে শুধু দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক নয়, বরং এটি একটি আত্মিক টান, যা কোনো স্বার্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় না। একজন সত্যিকারের বন্ধু আয়নার মতো, যে কেবল আমাদের ভালো দিকগুলোই তুলে ধরে না, বরং আমাদের ভুলগুলোও দেখিয়ে দেয়। সে আমাদের বিপদের দিনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় এবং আনন্দের দিনে মন খুলে হাসে।

এই স্বার্থপর সময়ে সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পাওয়া হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে যদি আমরা লাভ-ক্ষতির হিসাব থেকে মুক্ত করতে পারি, তবেই এর আসল সৌন্দর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। বন্ধুত্ব কোনো পণ্য নয় যে তাকে ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে। এটি একটি চারা গাছের মতো, যাকে যত্ন, বিশ্বাস এবং সময় দিয়ে বড় করে তুলতে হয়। যখন একজন মানুষ সব ধরনের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আরেকজন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তখনই জন্ম নেয় এক নির্মল বন্ধুত্ব।

স্বার্থের এই সমাজে বন্ধুত্বের মানে হলো এক নিঃস্বার্থ আশ্রয়। এমন এক সম্পর্ক, যেখানে আপনি কোনো মুখোশ ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, যেখানে আপনার দুর্বলতাগুলো নিয়ে কেউ উপহাস করবে না, বরং আপনাকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এই বন্ধুত্ব আপনাকে শেখাবে যে পৃথিবীতে এখনো এমন কিছু সম্পর্ক আছে, যা অর্থ বা ক্ষমতার বিনিময়ে কেনা যায় না, যা কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। তাই এই যান্ত্রিক সভ্যতায় হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের উচিত জীবনের সেই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে খুঁজে বের করা এবং পরম মমতায় সেগুলো আগলে রাখা। কারণ, দিন শেষে এই সম্পর্কগুলোই আমাদের বেঁচে থাকার আসল প্রেরণা জোগায়।

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাঠকের লেখা /বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব

রিয়াদ হোসেন
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ৪৩
বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিক্ষয় রোধসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে আসছে। এই সুন্দরবনের এক অনন্য প্রজাতির প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

সাধারণ মানুষের মতো বাঘেরও প্রধান দুটি মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য ও বাসস্থান। বিশেষ করে খাদ্যের জোগান এবং আবাসস্থল নিরাপদ করতে পারলে বাঘ বাঁচিয়ে রাখা কিংবা তাদের প্রজনন বৃদ্ধিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এ জন্য সুন্দরবনকে বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণের জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বাঘসহ অন্য প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন বাঘের অস্তিত্ব আছে। বাঘ বাঁচাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সেসব দেশের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় অন্য প্রজাতির প্রাণী থেকে বাঘ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সুন্দরবনে চোরা শিকারি বাঘের প্রধান হুমকি। কিছু অতিলোভী চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের জন্য দিন দিন বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সবশেষ তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি। কয়েক বছর আগে বড় বড় বনদস্যু দলের আত্মসমর্পণের ফলে বাঘনিধন কিছুটা কমে এসেছে। দুই বছর আগেও খাদ্যসংকটে বাঘ লোকালয়ে এলে হত্যা করা হতো। এখন সেটিও অনেকটা বন্ধ হয়েছে। বন সংরক্ষণে বন মন্ত্রণালয়ের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে সুন্দরবনসংলগ্ন স্থানীয় মানুষ আগের থেকে অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে। এ জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর জীবিকায় সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়ে আরও বেশি কাজ করতে হবে।

সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে বাঘ সংরক্ষণের বিকল্প নেই। আর এ জন্য বন বিভাগ কিংবা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে সুন্দরবন বা বাঘ কোনোটাই রক্ষা করা সম্ভব হবে না; যদি আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন না হই। পাশাপাশি বাঘনিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য ২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যে আইনের ৩৬ ধারায় বাঘশিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ সাত বছর সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ড ও ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ আইনটিও অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে সুন্দরবন বাঁচানোর পাশাপাশি বাঘ, হরিণসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৬২০ টাকায় গরুর মাংস, মাইকিং করেও মিলছে না ক্রেতা

গ্রেপ্তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে পুলিশের সামনেই চড়, সমালোচনার ঝড়

জোটের ভোটেও দলীয় প্রতীক: বিএনপির আপত্তি যে কারণে, এনসিপির উদ্বেগ

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিলে রাইফেল দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গ্রেপ্তার ১

চীনা কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি ‘সুস্পষ্টভাবে’ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে ধরব: ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত