Ajker Patrika

আমাদের স্বপ্নগুলো বাড়ি যাচ্ছে যেভাবে

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২২, ১৬: ৫৯
Thumbnail image

ওপরের ছবিটি দেখুন মনোযোগ দিয়ে। জানালা দিয়ে কয়েকজন ট্রেনে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন ঈদের দিনটা স্বজনদের সঙ্গে কাটানোর আশায়। একই অবস্থা বাসে, লঞ্চে, ফেরিতে। ওই একই আশায় বসতি গড়েই আমরা প্রতি উৎসবে বাড়ি ফিরি। ওই ছোট্ট আশাতেই আমরা স্বপ্ন বুনি। সেই স্বপ্ন বাড়ি যায় তবে এভাবেই! 

উৎসবের দিনটিকে ঘিরে স্বপ্ন আসলে কেমন থাকে? সেই স্বপ্নে মানুষের ছোট ছোট ইচ্ছা পূরণের আকাঙ্ক্ষা থাকে। তাতে হয়তো থাকে মায়ের হাতের সেমাই খাওয়ার ইচ্ছা। হয়তো থাকে বাবার সঙ্গে ঈদের দিনটায় কোলাকুলি করার তৃপ্তি। অথবা ভাই-বোনদের সঙ্গে অযথাই আড্ডায় মেতে ওঠার খুশি। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে কিছুটা সময় কাছে থাকার স্মৃতি তৈরির কামনাও থাকে নিশ্চয়ই। কোনো পরিযায়ী মা-বাবা হয়তো শুধুই গ্রামে থাকা সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতেই ঈদের এক দিন আগে ওপরের ছবিটির মতো অনেক কষ্টে চেপে বসেন বাহনে। এই গরমে ঘামে গোসল করার এবং রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্থির মনে ঠায় বসে থাকার বাস্তবতা মেনেই এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ঈদের মতো উৎসবে পরিজনদের কাছে ফেরার স্বপ্ন বোনেন। 

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড অনেক বছর আগে মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। মানুষের স্বপ্ন দেখার বিষয়ে ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘যুগান্তকারী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। কারণ, এই ক্ষেত্রে শুরুটা আসলে তিনিই করেছিলেন। তো ফ্রয়েডের মতে, স্বপ্ন আসলে মানুষের মনের ‘চেতনাহীন’ প্রক্রিয়া। মানুষের স্বপ্নে উপাদান থাকে তার জীবনের অভিজ্ঞতা, থাকে মানসিক প্রক্রিয়া। তবে আমাদের দেশে ঈদ বা যেকোনো উৎসবের আগে আপামর আমজনতারা কি চেতনাহীন প্রক্রিয়ায় স্বপ্নটা দেখেন? নাহ, এই স্বপ্নটা আমরা মনে হয় দুই চোখ খুলেই দেখি, কল্পনাতে। সেই স্বপ্ন রঙিন থাকে, বাসি সাধারণত হয় না।

ট্রাকে বাড়ি ফিরছে মানুষ। এ দেশের মানুষ এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে বেশ সংকটে আছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি সহ্যের সীমা বাড়িয়ে চলেছে অনিঃশেষ প্রক্রিয়ায়। কখনো শসার দাম নাগালের বাইরে যায়, তো কখনো বেগুন বলে—‘আমি কী কম নাকি!’ আবার তেল-নুনও ছেড়ে কথা কয় না। এমন পরিস্থিতিতেই আমাদের জীবনে উৎসব আসে, নিজেদের সাধ্য মেনেই তাতে যতটা সম্ভব আনন্দ কুড়ানোর স্বপ্ন দেখে মন। তা জেগে হোক বা ঘুমিয়ে। আনন্দ কুড়োনোতেই তো মানবজীবনের মোক্ষ। ওটি না থাকলে হয়তো বৃথা মনে হতো সবই! 

সমস্যা হলো, হাজারো প্রতিবন্ধকতা ঠেলে এ দেশের সাধারণ মানুষের কিছুটা আনন্দ পাওয়াটাও দিন দিন ‘অসম্ভব’ হয়ে উঠছে। ধরুন, এই বাড়ি ফেরার বিষয়টাই। এ বঙ্গে উৎসবে দল বেঁধে মানুষের বাড়ি ফেরার চল অনেক দিনের। কিন্তু প্রতিবারই সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম শেষ পর্যন্ত হয় এমন—‘দুর্ভোগ মেনেই বাড়ি ফিরছে মানুষ’, ‘ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে ৩৫ কিলোমিটার যানজট’, ‘ঢাকা-বগুড়া ৬ ঘণ্টার পথ যেতে ২৬ ঘণ্টা’ বা ‘শেষ সময়ে পথে পথে কষ্ট’। সংবাদমাধ্যমের বাইরে এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও মানুষের ভোগান্তির খবর মেলে। এক নিকটজন সেখানেই লিখেছেন, গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সাড়ে ৯ ঘণ্টায় তিনি পৌঁছেছেন জামালপুরে। আর দুই সহকর্মী তো গতকাল রাত থেকে রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে এখনো অব্দি বাড়ির টিকির দেখা পাননি। ‘ওই যে বাড়ি, এসে গেছি প্রায়’ ভেবে তাঁরা পরমানন্দ লাভের ফুরসতটুকুও পাচ্ছেন না। কারণ মাথায় অঙ্কের হিসাব বলছে দিল্লি বহুৎ দূর! 

নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১২ ঘণ্টা বিলম্বে শনিবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস।একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একসময় এই অভাগাও গেছে। এখন ভোগান্তি বিবেচনায় নিয়েই আর জটজর্জর রাস্তায় নামা হয় না। ওই সময়টায় মনে হতো, আচ্ছা উৎসব এলে কি দূরত্ব বেড়ে যায়? বাস্তবিক যুক্তিবোধ জানান দেয়—না, সম্ভবই না, পথের দূরত্ব ইলাস্টিক নয় যে টেনে লম্বা করা যাবে। তার মানে, এই যে এত ভোগান্তি, তার মূলে আছে শুধুই অব্যবস্থাপনা। সড়ক-মহাসড়কে, গণপরিবহনে, তথা বাসে–ট্রেনে–লঞ্চে—সবখানেই আমাদের সম্বল এই ‘অব্যবস্থাপনা’ শব্দটি। অথচ এর বিপরীতার্থক শব্দটি খুঁজে বের করে তার যোগ্য সম্মান প্রতিষ্ঠা করা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ? এতটাই কি কষ্টসাধ্য যে এতগুলো বছরেও সেটি করাই গেল না? 

ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ৩৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গতকাল সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা এলাকার চিত্র। করতে পারলে অন্তত একটা দুধের শিশু হয়তো তার বাবার বুকে কয়েকটা ঘণ্টা আগে মাথা রাখত। গার্মেন্টসে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা মায়ের গা ঘেঁষে কয়েকটা ঘণ্টা বেশি সময় থাকতে পারত গ্রামে থাকা কোনো এক ছেলে। কোনো মা-বাবা হয়তো তাদের সন্তানদের আরও একটু বেশি সময় চোখের সামনে পেতেন। কোনো প্রিয়জন হয়তো তার প্রিয় মানুষটাকে আরও কিছুটা অতিরিক্ত সময় কাছে পেত। কারণ কে না জানে, যেতে যত কষ্ট বা দেরিই হোক না কেন, এ ঢাকায় ফেরার দিনটা সব পরিযায়ীর নির্দিষ্টই থাকে। ওতে যে থাকে আয়-রোজগারের গভীর সম্বন্ধ, তাই ব্যত্যয় মানা যায় না মোটেও! 

কর্তৃপক্ষের কাছে তাই এসব খেটে খাওয়া মানুষেরও ছোটখাটো কিছু চাওয়া থাকে। বড় কিছু চাইলে থাকে হৃদয় ভাঙা বা প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা। এর চেয়ে বরং ‘অব্যবস্থাপনা’ শব্দটি ইরেজার দিয়ে মুছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। সতেজ স্বপ্নগুলো সুবাস ছড়াতে ছড়াতেই বাড়ি যাক, ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়ে নয়। দেশ চালানোর ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির মেশিনগুলোতে এতটুকু তেল-গ্রিজ তো ঢালাই যায়, নাকি? 

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত