Ajker Patrika

সাগরের সম্পদ মোড় ঘোরাবে অর্থনীতির

আলম শাইন
Thumbnail image

সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা আয়তনে বেড়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার দাঁড়িয়েছে। যে সীমানা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজে দিচ্ছে। যা ‘ব্লু ওশান ইকোনমি’ (নীল সমুদ্র অর্থনীতি) জোন নামে খ্যাত। ‘ব্লু ওশান ইকোনমি’ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি সম্ভাবনাময় জোন। বিশেষ করে খনিজ সম্পদের বিশাল ভান্ডার, বৈদেশিক বাণিজ্য, জাহাজশিল্প, আমদানি-রপ্তানি কিংবা পর্যটন এসব ‘নীল সমুদ্র অর্থনীতি’র আওতায় পড়ে। এই বিষয়টি সম্পর্কে সর্বসাধারণের ধারণা নেই বললেই চলে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সমুদ্রসম্পদ অতি প্রয়োজনীয় হলেও আহরণে একধরনের অনীহা লক্ষ করা যায় আমাদের মধ্যে। অথচ সমুদ্রতীরবর্তী বিশ্বের প্রতিটি দেশই ইচ্ছে করলে সমুদ্রসম্পদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে অনায়াসেই। কিছু কিছু দেশ নির্ভরশীল হচ্ছেও ক্রমেই। তবে ইচ্ছে করলে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল হতে পারে বাংলাদেশ। এটি অনেকভাবেই সম্ভব। বিশেষ করে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের মাধ্যমে অতি সহজেই আমরা সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারি।

দুর্গম অঞ্চলের খনিজ সম্পদের তুলনায় সমুদ্রসম্পদ আহরণ কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও যথেষ্ট লাভজনক। যেমন, একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে, মৎস্য আহরণ ও লবণ উৎপাদন। এ দুটি ক্ষেত্রে খুব বেশি অর্থ লগ্নির প্রয়োজন পড়ে না। অথচ কোটি কোটি টাকা লাভবান হতে পারেন লগ্নিকারীরা। এ দুটি সেক্টরে বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি অর্থ লগ্নি না থাকলেও অনেক সময় প্রণোদনা দিয়ে থাকে সরকার।

বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ স্থলভূমি, বাদবাকি তিন ভাগ জলরাশিতে ভরপুর। মাত্র এক ভাগ স্থলভূমির মধ্যে শত শত ধরনের খনিজ পদার্থ বিদ্যমান থাকলে বাকি তিন ভাগে কী পরিমাণ সম্পদ থাকতে পারে, তা অনুমেয়। এই হিসাব-নিকাশের জন্য কাগজ-কলম নিয়ে অঙ্ক কষার প্রয়োজন নেই, সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট। অনেকের উপলব্ধি জলতলে আবার কিসের সম্পদ!

পানির তলে অঢেল সম্পদ। ছবি: এজাজ– উল– ইসলামসমীক্ষায় জানা গেছে, সমুদ্রে ৫০টির বেশি অতি প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এর মধ্যে আছে বালু, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিংক, আয়োডিন, অ্যালুমিনিয়াম, ফসফরাস, লিথুনিয়ার, সালফার, সিলিকন, কপার, নাইট্রোজেন, ম্যাংগানিজ, সোডিয়াম, বোরন, স্বর্ণ, জ্বালানি তেল, গ্যাস, ক্লে (সিমেন্টের কাঁচামাল), দ্রবীভূত লবণসহ হরেক খনিজ পদার্থ। অপরদিকে জলজ প্রাণীদের মধ্যে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, অক্টোপাস, হাঙরসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণিজ সম্পদ রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এ ছাড়াও আমাদের সমুদ্র সীমানায় প্রচুর টুনা মাছ পাওয়া যায়, যা খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ মাছের আন্তর্জাতিক চাহিদা ব্যাপক। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও টুনা মাছের প্রচুর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে সৈকত এলাকায় পর্যটক বেড়াতে এলে টুনা মাছের বারবিকিউ তাঁদের পছন্দের তালিকায় থাকে।

অন্য খনিজ পদার্থের তুলনায় সমুদ্রে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তার পরেই হচ্ছে সালফার। মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে কিংবা খাদ্যের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে হলে লবণের বিকল্প নেই, যা জোগান দিচ্ছে সমুদ্রের জলরাশি। অপরদিকে সালফারের প্রয়োজনীয়তা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করার নয়। ইউরেনিয়ামও একটি দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থ।

বিশ্ববাজারে ইউরেনিয়ামের দাম যেমন চড়া, তেমনি রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বিশেষ করে জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউরেনিয়ামের চাহিদা বলে শেষ করার মতো নয়।

কোনো স্থানে ইউরেনিয়ামের মাত্রা ৭ শতাংশ হলে বাণিজ্যিকভাবে সেটি উত্তোলনের উপযুক্ত হয়। সেই মতে, আমাদের সমুদ্রসীমানায়, বিশেষ করে উপকূলীয় কিছু অংশে বাণিজ্যিকভাবে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের মতো মজুত রয়েছে। ইউরেনিয়াম শুধু বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায়ই নয়, বিশ্বের সমগ্র সমুদ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় চার বিলিয়ন টন, যা উত্তোলন করলে পরিবেশের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটবে না। খনি থেকে ইউরেনিয়াম আহরণ করা খুব বিপজ্জনক হলেও সমুদ্রের তলদেশ থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন তুলনামূলক নিরাপদ। অন্যদিকে প্রতি ঘনমাইল সমুদ্রজলে প্রায় ২৫ টন স্বর্ণ মজুতের তথ্যও জানা যায়। সমুদ্রের তলদেশে অফুরন্ত গ্যাস এবং জ্বালানি তেলের মজুত আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার পাশেই মিয়ানমার ইতিমধ্যে বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আমাদের সমুদ্রসীমানায় তার চেয়েও বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, সেটি উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, আর মাত্র ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩১ সাল পর্যন্ত আমাদের গ্যাস মজুত থাকবে। ভূপৃষ্ঠের গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সমুদ্রে রক্ষিত গ্যাসের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে উত্তোলন সম্ভব না হলেও ভারত ও মিয়ানমার থেকে অর্জিত সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক ইজারা দিয়ে সেখান থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সমুদ্রের খনিজ সম্পদ উত্তোলনে ভারত, মিয়ানমারের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলন করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে ইতিমধ্যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। গ্যাসের মতো ইউরেনিয়ামের ক্ষেত্রেও ইজারার মাধ্যমে আহরণ সম্ভব। কারণ, ইউরেনিয়ামের ব্যবহার দেশে খুব দ্রুততর হতে যাচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে ইউরেনিয়ামের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে।

শুধু নীল সমুদ্রই নয়, সমুদ্র উপকূলেও রয়েছে অগাধ সম্পদ। সমুদ্র উপকূলে এ পর্যন্ত ১৭ প্রকার খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রোটাইল, গ্যানেট, ম্যাগনেটাইট উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হচ্ছে, সমুদ্র উপকূলেও প্রায় ১.২৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালু রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১২ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলেও সমুদ্র উপকূলের বালু আহরণে সেই ধরনের ঝুঁকি নেই।

সুনীল অর্থনীতি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। যার জন্য সমুদ্রে রক্ষিত প্রাণিজ সম্পদ, অপ্রাণিজ বা খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত। তাতে করে দেশ যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, তেমনি বেকারদেরও কর্মস্থানের ব্যবস্থা হবে। আরেকটি কথা হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠের সম্পদ যতটা নিরাপদে আগলে রাখা সম্ভব, ততটা নিরাপদ নয় সমুদ্রসম্পদ। বিশেষ করে প্রাণিজ সম্পদের কথাই ধরা যাক। এ সম্পদের মধ্যে স্থিরতা নেই। যেকোনো সময় সীমানা অতিক্রম করতে পারে অথবা সীমানা ডিঙিয়ে কেউ কেউ আহরণ করে নিয়ে যেতে পারে।

লেখক: পরিবেশ ও বন্য প্রাণিবিষয়ক কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত