Ajker Patrika

এগিয়ে যাওয়া সবার জন্য সমান হচ্ছে কি?

সুলতানা কামাল
আপডেট : ৩০ জুন ২০২১, ১৩: ২০
এগিয়ে যাওয়া সবার জন্য সমান হচ্ছে কি?

‘আজকের পত্রিকা’ নামে একটি নতুন দৈনিক প্রকাশিত হলো। পত্রিকাটির প্রকাশনা উপলক্ষে এর প্রকাশক, সম্পাদক, কলাকুশলী এবং পত্রিকাটি যেসব পাঠক হাতে তুলে নেবেন–সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে আমরা যখন কেউ কারও কাছে যেতে পারছি না, কারও স্নেহ বা ভালোবাসার হাত আমাদের স্পর্শ করতে পারছে না; বরং জীবনটাকে বাঁচানোর জন্য সবার থেকে নিরাপদ দূরত্বে রীতিমতো অবরুদ্ধ অবস্থায় বসবাস করার নিয়ম মানতে বাধ্য হচ্ছি, তখন সেই বিচ্ছিন্নতা কাটাতে গণমাধ্যম আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনযাপন তো শুধু নিজের শরীরটাকে সুস্থ রাখায় সীমাবদ্ধ রাখা যায় না, জীবনের অনুষঙ্গ অনেক ব্যাপক, অনেক বিস্তৃত। সেখানে নিজের পরিবার, সমাজ, পরিবেশ, প্রতিবেশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মর্যাদা পায়, তেমনি মূল্যবান স্থান দাবি করে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান। এর কোনোটা থেকেই নিজেকে সংযোগহীন রেখে জীবনধারণ করা সম্ভব নয়। আর এই সংযুক্তির দায় অনেকটাই বহন করে থাকে গণমাধ্যম, যার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো কিন্তু, অন্তত আমার কাছে, প্রিয় হচ্ছে সংবাদপত্র, সহজ কথায় ‘পত্রিকা’ বা ‘খবরের কাগজ’।

প্রতিদিন সকালবেলা সেদিনকার পত্রিকাটা হাতে না পেলে মনে হয় দিন-ই শুরু করতে পারলাম না। এই পত্রিকাই জানান দেয় কেমন আছি আমরা। দেশের অথবা বিশ্বের ভালোমন্দের একেবারে শেষ খবরটি পৌঁছে দেয় সেদিনকার খবরের কাগজটি। কত রকম সে খবর। অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি—সবকিছু নিয়ে মানুষ কেমন আছে। স্বভাবতই মূল আগ্রহটা থাকে জানতে—দেশ কতটা এগোলো, কোথায় থমকে দাঁড়াল, কোথায় মুখোমুখি হতে হলো বিপর্যয়ের বা অবক্ষয়ের, কোথায় দেশ হাঁটতে শুরু করল একেবারে উল্টো পথে। আশা করি, ‘আজকের পত্রিকা’ সৎ ও স্বচ্ছভাবে সেই বার্তাবাহকের দায়িত্বটি পালনে সক্ষম হবে।

 ‘আজকের পত্রিকা’ প্রকাশনাকালীন সংখ্যার রচনাগুলোর মূলভাব নির্দিষ্ট করেছে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছরে এ রকম একটা বিষয় বেছে নেওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। নানা গণমাধ্যমেই দেশের এগিয়ে যাওয়ার খবর পাই যে, কোভিড অতিমারি সত্ত্বেও বাংলাদেশে গড় আয় বেড়েছে, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, দ্রুততম সময়ে কোটিপতি হওয়ার সংখ্যা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে, বড় ব্যবসায়ীদের সাফল্য যথেষ্ট দৃশ্যমান, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ নানান অবকাঠামো নির্মাণের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক, ফসলের মাঠ মানুষের চোখ জুড়ায়, খাদ্য উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এখন বাস্তবতা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিকভাবেও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানা সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি মিলছে। নারীদের অগ্রসরমাণতা ও ক্ষমতায়ন এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তারপরও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের উদ্বেগ কিছুতেই প্রশমিত হতে পারছে না। দুর্নীতির প্রকোপ, মানবাধিকারের প্রশ্নে দুঃখজনক উদাসীনতা, রাজনীতিতে স্বচ্ছতার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা, সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার প্রসার, মৌলবাদের দাপট—এই সবকিছু সাধারণ নাগরিকের জীবনে যে অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তাবোধের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে উন্নয়নের সূচকগুলোর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মধ্যে নারীরা আসলেই কেমন আছে? এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সর্বক্ষেত্রে নারীর অবদান বেশি না হলেও কম নয়। যে গড় আয় বৃদ্ধি নিয়ে আমরা উচ্চকিত, তার অনেকটাই আসে রপ্তানিযোগ্য শিল্প, বিশেষত পোশাক খাত থেকে। সবাই জানি, সেখানে ৮০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যে আত্মসন্তুষ্টি আমাদের, সেখানেও নারীদের শুধু যে রক্ত জল করা খাটুনির টাকা তা নয়, কখনো কখনো দুঃসহ জীবনের বিনিময়ে তা উপার্জন করতে হয় তাঁদের। গণমাধ্যম সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৯১ সাল থেকে ৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৩৯ জন নারী কাজের জন্য দেশের বাইরে গেছেন (প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০২১)। বিপরীতে, নারীর নির্যাতনমুক্ত জীবন নিশ্চিত করতে বা তাকে সুরক্ষা দিতে কতটুকু করা হয়েছে এ পর্যন্ত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের সমাজে যে অনভিপ্রেত অসংগতিগুলো গেড়ে বসেছে, তার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরি অভিঘাত অনেক বেশি করে আমরা দেখতে পাই নারীর জীবনে, যা সবারই কম-বেশি জানা আছে। কয়েক বছর ধরেই নারী নির্যাতন ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার খবর প্রাধান্য পেয়ে আসছে। জাতিসংঘের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের এক জরিপ অনুযায়ী ৮৭ শতাংশ নারী তাঁদের পারিবারিক জীবনে সহিংসতার শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ব্র্যাক এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, নারী নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় যে মামলা হয়, তার সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি নয়। সেই দায়ের করা মামলার বিচারের হার মাত্র ৩ শতাংশ। আরও করুণ চিত্র পাওয়া যায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের বিচারে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের ওপরে উঠতে পারেনি।

গত ১০ বছরে এই চিত্রের খুব একটা হেরফের ঘটেনি। এরই মধ্যে সারা পৃথিবী এখন কোভিডের ঝাপটায় বিপর্যস্ত। গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি। নানা তথ্য জানান দিচ্ছে, নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। এরা অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, কারও আয় কমে গেছে, কেউ কেউ পরিবারের ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এ কথা স্পষ্ট যে, এই অবস্থায় সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন নারীরা। প্রতিটা গণমাধ্যম—কি ছাপা, কি ইলেকট্রনিক—নারী নির্যাতনের প্রকটতার খবর দিয়ে যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে গেছে উদ্বেগজনকভাবে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এসব ঘটনার বিচার হওয়ার গতি আরও শ্লথ হয়ে গেছে। তার ফলে চক্রাকারে নির্যাতনের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যথেষ্ট শক্ত ‘নারী নির্যাতন দমন’ এবং ‘পারিবারিক সুরক্ষা আইন’ থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় আইনগুলো কার্যকারিতা হারাতে বসেছে।

সংবিধানে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বলে অঙ্গীকার করলেও পারিবারিক আইন বলবৎ থাকায় শুধু একই ধর্মের নারী-পুরুষের অধিকারে যে বৈষম্য বিরাজ করে তা নয়, বিভিন্ন ধর্মের নারীদের অধিকারেও বৈষম্য বজায় রেখে দিয়েছে। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব বৈষম্য বিলোপের সনদে (সিডও) বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারা ২ এবং ১৬ (গ) সংরক্ষিত রেখেছে। সমতার নীতিটাই মেনে নিতে চাইছে না রাষ্ট্র। পারিবারিক আইনের সংস্কার এবং সিডওর দুটি ধারার সংরক্ষণ তুলে না নিয়ে নারীদের আইনগত সমতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়-ই তো রাষ্ট্র অস্বীকার করছে। ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’—জাতিসংঘের এই ঘোষণারও যেন কোনো মূল্য দেওয়ার তাগিদ অনুভব করি না আমরা। সর্বশেষ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। পৃথিবী হবে নারী-পুরুষের সমান সমান। খুব জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না।

আবারও বলছি, নারীদের অধিকারসংক্রান্ত বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন না করে, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও অঙ্গীকার অনুযায়ী আইন প্রণয়ন না করে, আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি না করে সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। একই কথা তোলা যায় সমাজের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নেও। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে; কিন্তু সেই এগিয়ে যাওয়া সবার জন্য সমান হচ্ছে কি? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে সবার সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। 

 প্রতিদিন সকালবেলা সেদিনকার পত্রিকাটা হাতে না পেলে মনে হয় দিন-ই শুরু করতে পারলাম না। এই পত্রিকাই জানান দেয় কেমন আছি আমরা। দেশের অথবা বিশ্বের ভালোমন্দের একেবারে শেষ খবরটি পৌঁছে দেয় সেদিনকার খবরের কাগজটি। কত রকম সে খবর। অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি—সবকিছু নিয়ে মানুষ কেমন আছে। স্বভাবতই মূল আগ্রহটা থাকে জানতে—দেশ কতটা এগোলো, কোথায় থমকে দাঁড়াল, কোথায় মুখোমুখি হতে হলো বিপর্যয়ের বা অবক্ষয়ের, কোথায় দেশ হাঁটতে শুরু করল একেবারে উল্টো পথে। আশা করি, ‘আজকের পত্রিকা’ সৎ ও স্বচ্ছভাবে সেই বার্তাবাহকের দায়িত্বটি পালনে সক্ষম হবে।

‘আজকের পত্রিকা’ প্রকাশনাকালীন সংখ্যার রচনাগুলোর মূলভাব নির্দিষ্ট করেছে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছরে এ রকম একটা বিষয় বেছে নেওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। নানা গণমাধ্যমেই দেশের এগিয়ে যাওয়ার খবর পাই যে, কোভিড অতিমারি সত্ত্বেও বাংলাদেশে গড় আয় বেড়েছে, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, দ্রুততম সময়ে কোটিপতি হওয়ার সংখ্যা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে, বড় ব্যবসায়ীদের সাফল্য যথেষ্ট দৃশ্যমান, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ নানান অবকাঠামো নির্মাণের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক, ফসলের মাঠ মানুষের চোখ জুড়ায়, খাদ্য উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এখন বাস্তবতা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিকভাবেও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানা সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি মিলছে। নারীদের অগ্রসরমাণতা ও ক্ষমতায়ন এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তারপরও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের উদ্বেগ কিছুতেই প্রশমিত হতে পারছে না। দুর্নীতির প্রকোপ, মানবাধিকারের প্রশ্নে দুঃখজনক উদাসীনতা, রাজনীতিতে স্বচ্ছতার অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা, সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার প্রসার, মৌলবাদের দাপট—এই সবকিছু সাধারণ নাগরিকের জীবনে যে অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তাবোধের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে উন্নয়নের সূচকগুলোর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মধ্যে নারীরা আসলেই কেমন আছে? এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সর্বক্ষেত্রে নারীর অবদান বেশি না হলেও কম নয়। যে গড় আয় বৃদ্ধি নিয়ে আমরা উচ্চকিত, তার অনেকটাই আসে রপ্তানিযোগ্য শিল্প, বিশেষত পোশাক খাত থেকে। সবাই জানি, সেখানে ৮০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যে আত্মসন্তুষ্টি আমাদের, সেখানেও নারীদের শুধু যে রক্ত জল করা খাটুনির টাকা তা নয়, কখনো কখনো দুঃসহ জীবনের বিনিময়ে তা উপার্জন করতে হয় তাঁদের। গণমাধ্যম সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৯১ সাল থেকে ৯ লাখ ৫৩ হাজার ২৩৯ জন নারী কাজের জন্য দেশের বাইরে গেছেন (প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০২১)। বিপরীতে, নারীর নির্যাতনমুক্ত জীবন নিশ্চিত করতে বা তাকে সুরক্ষা দিতে কতটুকু করা হয়েছে এ পর্যন্ত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের সমাজে যে অনভিপ্রেত অসংগতিগুলো গেড়ে বসেছে, তার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরি অভিঘাত অনেক বেশি করে আমরা দেখতে পাই নারীর জীবনে, যা সবারই কম-বেশি জানা আছে। কয়েক বছর ধরেই নারী নির্যাতন ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার খবর প্রাধান্য পেয়ে আসছে। জাতিসংঘের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের এক জরিপ অনুযায়ী ৮৭ শতাংশ নারী তাঁদের পারিবারিক জীবনে সহিংসতার শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ব্র্যাক এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, নারী নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় যে মামলা হয়, তার সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি নয়। সেই দায়ের করা মামলার বিচারের হার মাত্র ৩ শতাংশ। আরও করুণ চিত্র পাওয়া যায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের বিচারে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যা শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের ওপরে উঠতে পারেনি।

গত ১০ বছরে এই চিত্রের খুব একটা হেরফের ঘটেনি। এরই মধ্যে সারা পৃথিবী এখন কোভিডের ঝাপটায় বিপর্যস্ত। গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি। নানা তথ্য জানান দিচ্ছে, নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। এরা অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, কারও আয় কমে গেছে, কেউ কেউ পরিবারের ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এ কথা স্পষ্ট যে, এই অবস্থায় সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন নারীরা। প্রতিটা গণমাধ্যম—কি ছাপা, কি ইলেকট্রনিক—নারী নির্যাতনের প্রকটতার খবর দিয়ে যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে গেছে উদ্বেগজনকভাবে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এসব ঘটনার বিচার হওয়ার গতি আরও শ্লথ হয়ে গেছে। তার ফলে চক্রাকারে নির্যাতনের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যথেষ্ট শক্ত ‘নারী নির্যাতন দমন’ এবং ‘পারিবারিক সুরক্ষা আইন’ থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় আইনগুলো কার্যকারিতা হারাতে বসেছে।

সংবিধানে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বলে অঙ্গীকার করলেও পারিবারিক আইন বলবৎ থাকায় শুধু একই ধর্মের নারী-পুরুষের অধিকারে যে বৈষম্য বিরাজ করে তা নয়, বিভিন্ন ধর্মের নারীদের অধিকারেও বৈষম্য বজায় রেখে দিয়েছে। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব বৈষম্য বিলোপের সনদে (সিডও) বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারা ২ এবং ১৬ (গ) সংরক্ষিত রেখেছে। সমতার নীতিটাই মেনে নিতে চাইছে না রাষ্ট্র। পারিবারিক আইনের সংস্কার এবং সিডওর দুটি ধারার সংরক্ষণ তুলে না নিয়ে নারীদের আইনগত সমতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়-ই তো রাষ্ট্র অস্বীকার করছে। ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’—জাতিসংঘের এই ঘোষণারও যেন কোনো মূল্য দেওয়ার তাগিদ অনুভব করি না আমরা। সর্বশেষ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। পৃথিবী হবে নারী-পুরুষের সমান সমান। খুব জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না।

আবারও বলছি, নারীদের অধিকারসংক্রান্ত বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তন না করে, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও অঙ্গীকার অনুযায়ী আইন প্রণয়ন না করে, আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি না করে সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। একই কথা তোলা যায় সমাজের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নেও। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে; কিন্তু সেই এগিয়ে যাওয়া সবার জন্য সমান হচ্ছে কি? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে সবার সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। 

লেখক: মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘালয়ে হানিমুনের সময় ভাড়াটে খুনি দিয়ে স্বামীকে হত্যা, উত্তর প্রদেশে নববধূর আত্মসমর্পণ

ভিকারুননিসার ছাত্রী মেয়েকে সাঁতার শেখাচ্ছিলেন বাবা, ডুবে প্রাণ গেল দুজনেরই

মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় খুন—কীভাবে এক নববধূ হয়ে উঠলেন হত্যাকারী

হাসিনার মতো মাফিয়াকে বিতাড়িত করেছি, এখন আমরাই বড় মাফিয়া: এনসিপি নেতা জুবাইরুল

লন্ডনে সাক্ষাতে ইউনূসকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব দিতে পারেন তারেক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত