সাহিদা পারভীন শিখা
২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে তালেবান দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী আফগান মাটি থেকে বিদায় নেওয়ার পর দেশজুড়ে দ্রুতগতিতে বিস্তার ঘটে তালেবান আন্দোলনের এবং অবশেষে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই তালেবান কাবুল দখল করে নেয়। এর পরের সময়টা পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য ছিল একরকম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভরা। অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো তালেবান ১৯৯৬ সালের মতোই এক কট্টর, পশ্চাৎমুখী শাসন চালাবে। কেউ কেউ আশাবাদী ছিলেন, নতুন প্রজন্মের তালেবান শাসকেরা হয়তো আরও নমনীয়, বাস্তববাদী এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার মতো কিছু সংস্কার আনবে। কিন্তু এই আশা আর বাস্তবতা মেলেনি।
এই সময়কালের মধ্যে আফগানিস্তান নিয়ে একধরনের ‘সফল রাষ্ট্র’-এর ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই প্রচারণার মূল বক্তব্য হলো—তালেবান শাসনে এখন আফগানিস্তান দুর্নীতিমুক্ত, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নেই, বেকারত্ব নেই, মাদকমুক্ত, অপরাধ প্রায় শূন্য, ভিক্ষুক নেই, এমনকি ব্যক্তিগত খুনোখুনিও নেই। বলা হচ্ছে, আফগানিস্তান এখন এক আত্মনির্ভর, সুশাসিত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাষ্ট্র। এমনকি পশ্চিমা বা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তুলনাও টেনে দেখানো হচ্ছে যে, ‘তালেবান মডেল’ অনেক বেশি কার্যকর।
এই প্রচারণা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং তা বাস্তবতা আড়াল করে একটি মানবিক সংকটকে গৌরবময় অর্জন হিসেবে সাজিয়ে তোলে। আর এর মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এমন এক ধারণা, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা—সবকিছুকে যেন বিলাসিতা বা অকার্যকর ভাবা হচ্ছে, আর কেবল ‘শাস্তি ও ভয়ের শাসন’কেই উন্নয়নের পথ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
তালেবান শাসনে দুর্নীতি কমেছে—এ দাবির পেছনে আংশিক সত্যতা রয়েছে। ২০২১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানে প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিশেষত পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের অভিযোগ কমেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। তালেবান সরকার অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কাজকর্ম সরল করেছে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে দুর্নীতির সুযোগগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে প্রশ্ন হলো—কোনো সিস্টেম যখন জবাবদিহিহীন, অগণতান্ত্রিক এবং সংবাদমাধ্যম, আদালত, বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের কোনো নজরদারি থাকে না, তখন সেই শাসনব্যবস্থাকে ‘স্বচ্ছ’ বলা যায় কি?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা অন্যান্য দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা তালেবান শাসনের আফগানিস্তানকে এখনো নিচের দিকের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকাতেই রাখছে। কারণ, প্রকৃত দুর্নীতি মানে শুধু ঘুষ নয়—বরং ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দমনপন্থা ও বিচারহীনতা। এসবই এখনকার আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত, শুধু অন্য নামে।
তালেবানপন্থীরা দাবি করছে, গত চার বছরে আফগানিস্তানে ধর্ষণের ঘটনা মাত্র তিনটি এবং সব ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তুলনায় তারা বলছে, আমেরিকায় বছরে ৫০ হাজার, ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন, বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়াবহ। প্রথমত, এসব তুলনা নির্লজ্জভাবে বিভ্রান্তিকর। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের সংখ্যা কমে গেছে বলে যেসব দাবি করা হচ্ছে, তার কোনো স্বাধীন উৎস বা তথ্যভিত্তিক প্রমাণ নেই। তালেবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তানে সাংবাদিকতা প্রায় নিষিদ্ধ, নারীরা আদালতে যেতে পারেন না, এনজিও বা মানবাধিকার সংস্থা কাজ করতে পারে না। তাহলে ধর্ষণের শিকার নারীরা কোথায় গিয়ে অভিযোগ করবেন?
তালেবান শাসনের চার বছরজুড়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন বলেছে—আফগান নারীরা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের শিক্ষা, চাকরি, ভ্রমণ, এমনকি চিকিৎসাসেবাও নিয়ন্ত্রিত। তাঁরা বাইরে বের হতে পারছেন না, তথ্যপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন—ফলে ধর্ষণের মতো ঘটনা লুকানো যাচ্ছে, রোধ করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শাস্তির ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয়েছে—এই দাবি একধরনের নির্মম রসিকতা ছাড়া কিছু নয়।
আরেকটি জনপ্রিয় প্রচারণা, কাবুল শহরে একটিও ভিক্ষুক নেই। বলা হয়, তালেবান সরকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ভিক্ষুকদের নিবন্ধন করেছে, প্রত্যেককে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা ও খাবার দেওয়া হয়। বাস্তবে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও ইউএস ইনস্টিটিউট ফর পিস-এর মতো সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানে বর্তমানে ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। শিশু অপুষ্টি, কাজের অভাব, খাদ্যাভাব—সব মিলিয়ে দেশটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ‘ভিক্ষুক নেই’ বলার অর্থ হলো—হয় তারা ভয় পেয়ে পথে নামছে না, না হয় তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে।
তালেবান সরকার আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে—এটা সত্য। ইউএনওডিসি-এর মতে, ২০২৩ সালে আফিম উৎপাদন ৯৫ শতাংশ কমে যায়। আগে আফগানিস্তান ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম রপ্তানিকারক। তবে নিষেধাজ্ঞার ফলে লাখো কৃষক আয় হারিয়েছেন, বিকল্প কর্মসংস্থান নেই, ফলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। দাবি করা হচ্ছে—৩০ লাখ মাদকাসক্তকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাস্তবে এ ধরনের কোনো জাতীয় পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রমাণ নেই। বেশির ভাগ মাদকাসক্ত এখনো সমাজের প্রান্তে পড়ে রয়েছে। কিছু কেন্দ্র খুললেও তা প্রতীকী মাত্র।
তালেবান দাবি করছে, নারীদের জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে কেবল নারী শিক্ষক, ডাক্তার থাকবে। বাস্তবে তালেবান সরকার নারীদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। বহু নারী পেশাজীবী দেশ ছেড়েছেন বা গৃহবন্দী হয়েছেন। যে দেশে নারীই নেই শিক্ষিত, সেখানে নারী শিক্ষককে নিয়োগ করা হবে কীভাবে? নারী চিকিৎসকের ঘাটতি এত ভয়াবহ যে হাজারো মা ও নবজাতক চিকিৎসাহীনতায় মারা যাচ্ছে। এই প্রচারণাগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন নারীর নিরাপত্তার জন্য তারা এসব করছে, অথচ এটি আসলে নারীকে জনজীবন থেকে সরিয়ে ফেলার নীতির শৈথিল্যপূর্ণ রূপ।
তালেবান শাসনের আরেকটি বড় দাবি, দেশে চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, খুন সব প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাস্তবে দেশটির জনগণ এখন ভয়াবহ এক ভয়ের সংস্কৃতিতে বাস করছে। প্রশাসন, বিচার ও শাস্তি—সবকিছু তালেবানের হাতে কেন্দ্রীভূত, যা বিচারবহির্ভূতভাবে কাজ করে। বহু সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এমনকি তালেবানবিরোধী সাবেক সেনাসদস্যরা নিখোঁজ, বন্দী বা হত্যার শিকার হয়েছেন। কোনো স্বাধীন তথ্যপ্রবাহ নেই। ফলে বলা সহজ—‘অপরাধ নেই’।
কিন্তু সত্য হলো, অপরাধ নেই মানে তা ঘটে না—এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ এখন দমন ও শাস্তির মধ্য দিয়ে চাপা পড়ে রয়েছে, যার অর্থ উন্নয়ন নয় বরং ভয়ভীতিনির্ভর নিয়ন্ত্রণ।
তালেবান শাসনের আরেকটি বড় প্রচারণা—তারা ‘বিদেশি সাহায্যনির্ভর নয়, আত্মনির্ভরশীল।’ বাস্তবে তালেবান সরকার নিজে বৈধভাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পায় না ঠিক, কিন্তু দেশটি জাতিসংঘ, রেডক্রস ও বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বিপুল মানবিক সাহায্য পাচ্ছে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ ৩ বিলিয়নের বেশি সাহায্য পাঠায় কেবল খাদ্য ও চিকিৎসার জন্য। অর্থাৎ, তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক ঋণ নেয়নি ঠিক, তবে সেটি সাহায্য ছাড়াই দেশ চালাচ্ছে—এই ধারণা ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশ, ভারত কিংবা আমেরিকার সঙ্গে আফগানিস্তানের তুলনা করে কেউ কেউ প্রচারণা চালান, যেন তালেবান মডেল এসব রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি কার্যকর। এটা বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য একধরনের সাদামাটা সাদৃশ্যায়ন। গণতান্ত্রিক দেশে যে অপরাধ বা দুর্নীতি ঘটে, তার তথ্য জানাজানি হয় গণমাধ্যমের কারণে। আইন ও আদালতের মাধ্যমে বিচার হয়, নাগরিকেরা কথা বলতে পারেন, বিক্ষোভ করতে পারেন। আর আফগানিস্তানে কোনো ভোট নেই, সংসদ নেই, সংবাদমাধ্যম নেই, নাগরিক অধিকার নেই। তাই কোনো ঘটনাই জানাজানি হয় না। ফলে একরকম ‘শূন্য’ দেখালেও বাস্তবে সেখানে কোনো স্বাধীনতা বা মানবাধিকার নেই। এভাবে উন্নয়ন মাপা যায় না।
তালেবান শাসনে আফগানিস্তান একটি উন্নয়নশীল, আত্মনির্ভর ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে—এ দাবি একটি রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ। এ দাবি যতটা না তথ্যনির্ভর, তার চেয়েও বেশি ভয়ের সংস্কৃতিকে গৌরব হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। নারী স্বাধীনতা হরণ, তথ্যের অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্রবিহীন একনায়কতন্ত্র—এসব কিছুকে যদি শৃঙ্খলা বলে মানা হয়, তবে মানবতার ইতিহাসেই তা এক বিপজ্জনক রূপ নেয়।
আফগানিস্তান উন্নত হোক—সেটা বিশ্ব চায়। কিন্তু উন্নয়নের মানে শুধুই অপরাধ কমানো নয়, বরং মানুষের অধিকার, মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সম্মিলিত পথে এগিয়ে যাওয়া। তালেবান যদি সত্যিকার অর্থেই উন্নয়ন করতে চায়, তবে একমাত্র পথ হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ, মানবাধিকারের পথে ফেরা, নারীদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা এবং সত্যের মুখোমুখি হওয়া।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে তালেবান দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী আফগান মাটি থেকে বিদায় নেওয়ার পর দেশজুড়ে দ্রুতগতিতে বিস্তার ঘটে তালেবান আন্দোলনের এবং অবশেষে কোনো যুদ্ধ ছাড়াই তালেবান কাবুল দখল করে নেয়। এর পরের সময়টা পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য ছিল একরকম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভরা। অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো তালেবান ১৯৯৬ সালের মতোই এক কট্টর, পশ্চাৎমুখী শাসন চালাবে। কেউ কেউ আশাবাদী ছিলেন, নতুন প্রজন্মের তালেবান শাসকেরা হয়তো আরও নমনীয়, বাস্তববাদী এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার মতো কিছু সংস্কার আনবে। কিন্তু এই আশা আর বাস্তবতা মেলেনি।
এই সময়কালের মধ্যে আফগানিস্তান নিয়ে একধরনের ‘সফল রাষ্ট্র’-এর ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই প্রচারণার মূল বক্তব্য হলো—তালেবান শাসনে এখন আফগানিস্তান দুর্নীতিমুক্ত, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নেই, বেকারত্ব নেই, মাদকমুক্ত, অপরাধ প্রায় শূন্য, ভিক্ষুক নেই, এমনকি ব্যক্তিগত খুনোখুনিও নেই। বলা হচ্ছে, আফগানিস্তান এখন এক আত্মনির্ভর, সুশাসিত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাষ্ট্র। এমনকি পশ্চিমা বা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তুলনাও টেনে দেখানো হচ্ছে যে, ‘তালেবান মডেল’ অনেক বেশি কার্যকর।
এই প্রচারণা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং তা বাস্তবতা আড়াল করে একটি মানবিক সংকটকে গৌরবময় অর্জন হিসেবে সাজিয়ে তোলে। আর এর মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এমন এক ধারণা, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা—সবকিছুকে যেন বিলাসিতা বা অকার্যকর ভাবা হচ্ছে, আর কেবল ‘শাস্তি ও ভয়ের শাসন’কেই উন্নয়নের পথ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
তালেবান শাসনে দুর্নীতি কমেছে—এ দাবির পেছনে আংশিক সত্যতা রয়েছে। ২০২১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানে প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিশেষত পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের অভিযোগ কমেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। তালেবান সরকার অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কাজকর্ম সরল করেছে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে দুর্নীতির সুযোগগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে প্রশ্ন হলো—কোনো সিস্টেম যখন জবাবদিহিহীন, অগণতান্ত্রিক এবং সংবাদমাধ্যম, আদালত, বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের কোনো নজরদারি থাকে না, তখন সেই শাসনব্যবস্থাকে ‘স্বচ্ছ’ বলা যায় কি?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা অন্যান্য দুর্নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা তালেবান শাসনের আফগানিস্তানকে এখনো নিচের দিকের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকাতেই রাখছে। কারণ, প্রকৃত দুর্নীতি মানে শুধু ঘুষ নয়—বরং ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দমনপন্থা ও বিচারহীনতা। এসবই এখনকার আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত, শুধু অন্য নামে।
তালেবানপন্থীরা দাবি করছে, গত চার বছরে আফগানিস্তানে ধর্ষণের ঘটনা মাত্র তিনটি এবং সব ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তুলনায় তারা বলছে, আমেরিকায় বছরে ৫০ হাজার, ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একজন, বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়াবহ। প্রথমত, এসব তুলনা নির্লজ্জভাবে বিভ্রান্তিকর। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের সংখ্যা কমে গেছে বলে যেসব দাবি করা হচ্ছে, তার কোনো স্বাধীন উৎস বা তথ্যভিত্তিক প্রমাণ নেই। তালেবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তানে সাংবাদিকতা প্রায় নিষিদ্ধ, নারীরা আদালতে যেতে পারেন না, এনজিও বা মানবাধিকার সংস্থা কাজ করতে পারে না। তাহলে ধর্ষণের শিকার নারীরা কোথায় গিয়ে অভিযোগ করবেন?
তালেবান শাসনের চার বছরজুড়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন বলেছে—আফগান নারীরা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের শিক্ষা, চাকরি, ভ্রমণ, এমনকি চিকিৎসাসেবাও নিয়ন্ত্রিত। তাঁরা বাইরে বের হতে পারছেন না, তথ্যপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন—ফলে ধর্ষণের মতো ঘটনা লুকানো যাচ্ছে, রোধ করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শাস্তির ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয়েছে—এই দাবি একধরনের নির্মম রসিকতা ছাড়া কিছু নয়।
আরেকটি জনপ্রিয় প্রচারণা, কাবুল শহরে একটিও ভিক্ষুক নেই। বলা হয়, তালেবান সরকার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ভিক্ষুকদের নিবন্ধন করেছে, প্রত্যেককে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা ও খাবার দেওয়া হয়। বাস্তবে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও ইউএস ইনস্টিটিউট ফর পিস-এর মতো সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানে বর্তমানে ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। শিশু অপুষ্টি, কাজের অভাব, খাদ্যাভাব—সব মিলিয়ে দেশটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ‘ভিক্ষুক নেই’ বলার অর্থ হলো—হয় তারা ভয় পেয়ে পথে নামছে না, না হয় তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে।
তালেবান সরকার আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে—এটা সত্য। ইউএনওডিসি-এর মতে, ২০২৩ সালে আফিম উৎপাদন ৯৫ শতাংশ কমে যায়। আগে আফগানিস্তান ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম রপ্তানিকারক। তবে নিষেধাজ্ঞার ফলে লাখো কৃষক আয় হারিয়েছেন, বিকল্প কর্মসংস্থান নেই, ফলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। দাবি করা হচ্ছে—৩০ লাখ মাদকাসক্তকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাস্তবে এ ধরনের কোনো জাতীয় পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রমাণ নেই। বেশির ভাগ মাদকাসক্ত এখনো সমাজের প্রান্তে পড়ে রয়েছে। কিছু কেন্দ্র খুললেও তা প্রতীকী মাত্র।
তালেবান দাবি করছে, নারীদের জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে কেবল নারী শিক্ষক, ডাক্তার থাকবে। বাস্তবে তালেবান সরকার নারীদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। বহু নারী পেশাজীবী দেশ ছেড়েছেন বা গৃহবন্দী হয়েছেন। যে দেশে নারীই নেই শিক্ষিত, সেখানে নারী শিক্ষককে নিয়োগ করা হবে কীভাবে? নারী চিকিৎসকের ঘাটতি এত ভয়াবহ যে হাজারো মা ও নবজাতক চিকিৎসাহীনতায় মারা যাচ্ছে। এই প্রচারণাগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন নারীর নিরাপত্তার জন্য তারা এসব করছে, অথচ এটি আসলে নারীকে জনজীবন থেকে সরিয়ে ফেলার নীতির শৈথিল্যপূর্ণ রূপ।
তালেবান শাসনের আরেকটি বড় দাবি, দেশে চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, খুন সব প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাস্তবে দেশটির জনগণ এখন ভয়াবহ এক ভয়ের সংস্কৃতিতে বাস করছে। প্রশাসন, বিচার ও শাস্তি—সবকিছু তালেবানের হাতে কেন্দ্রীভূত, যা বিচারবহির্ভূতভাবে কাজ করে। বহু সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এমনকি তালেবানবিরোধী সাবেক সেনাসদস্যরা নিখোঁজ, বন্দী বা হত্যার শিকার হয়েছেন। কোনো স্বাধীন তথ্যপ্রবাহ নেই। ফলে বলা সহজ—‘অপরাধ নেই’।
কিন্তু সত্য হলো, অপরাধ নেই মানে তা ঘটে না—এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ এখন দমন ও শাস্তির মধ্য দিয়ে চাপা পড়ে রয়েছে, যার অর্থ উন্নয়ন নয় বরং ভয়ভীতিনির্ভর নিয়ন্ত্রণ।
তালেবান শাসনের আরেকটি বড় প্রচারণা—তারা ‘বিদেশি সাহায্যনির্ভর নয়, আত্মনির্ভরশীল।’ বাস্তবে তালেবান সরকার নিজে বৈধভাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পায় না ঠিক, কিন্তু দেশটি জাতিসংঘ, রেডক্রস ও বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বিপুল মানবিক সাহায্য পাচ্ছে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ ৩ বিলিয়নের বেশি সাহায্য পাঠায় কেবল খাদ্য ও চিকিৎসার জন্য। অর্থাৎ, তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক ঋণ নেয়নি ঠিক, তবে সেটি সাহায্য ছাড়াই দেশ চালাচ্ছে—এই ধারণা ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশ, ভারত কিংবা আমেরিকার সঙ্গে আফগানিস্তানের তুলনা করে কেউ কেউ প্রচারণা চালান, যেন তালেবান মডেল এসব রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি কার্যকর। এটা বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য একধরনের সাদামাটা সাদৃশ্যায়ন। গণতান্ত্রিক দেশে যে অপরাধ বা দুর্নীতি ঘটে, তার তথ্য জানাজানি হয় গণমাধ্যমের কারণে। আইন ও আদালতের মাধ্যমে বিচার হয়, নাগরিকেরা কথা বলতে পারেন, বিক্ষোভ করতে পারেন। আর আফগানিস্তানে কোনো ভোট নেই, সংসদ নেই, সংবাদমাধ্যম নেই, নাগরিক অধিকার নেই। তাই কোনো ঘটনাই জানাজানি হয় না। ফলে একরকম ‘শূন্য’ দেখালেও বাস্তবে সেখানে কোনো স্বাধীনতা বা মানবাধিকার নেই। এভাবে উন্নয়ন মাপা যায় না।
তালেবান শাসনে আফগানিস্তান একটি উন্নয়নশীল, আত্মনির্ভর ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে—এ দাবি একটি রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ। এ দাবি যতটা না তথ্যনির্ভর, তার চেয়েও বেশি ভয়ের সংস্কৃতিকে গৌরব হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। নারী স্বাধীনতা হরণ, তথ্যের অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্রবিহীন একনায়কতন্ত্র—এসব কিছুকে যদি শৃঙ্খলা বলে মানা হয়, তবে মানবতার ইতিহাসেই তা এক বিপজ্জনক রূপ নেয়।
আফগানিস্তান উন্নত হোক—সেটা বিশ্ব চায়। কিন্তু উন্নয়নের মানে শুধুই অপরাধ কমানো নয়, বরং মানুষের অধিকার, মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সম্মিলিত পথে এগিয়ে যাওয়া। তালেবান যদি সত্যিকার অর্থেই উন্নয়ন করতে চায়, তবে একমাত্র পথ হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ, মানবাধিকারের পথে ফেরা, নারীদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা এবং সত্যের মুখোমুখি হওয়া।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
একটি জাতীয় দৈনিকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আরও অনেক প্রশ্নের সঙ্গে বিএনপির মহাসচিবের কাছে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হতে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বিষয়টি...
৩ ঘণ্টা আগেরাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামে সাঁওতালপাড়ায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বাবলু নামে স্থানীয় বিএনপির এক কর্মীর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। ৫ আগস্ট আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, রাজশাহীর পবা উপজেলার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বারনই নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের
৩ ঘণ্টা আগেআজকাল সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের ছোট ছোট ভিডিও থাকে। কিছু থাকে নিছক হাসির, কিছু থাকে সামাজিক বক্তব্যনির্ভর। ছেলে-বুড়ো অনেককেই দেখি সেইসব রিলস বা শর্টসে বুঁদ হয়ে থাকতে।
১ দিন আগেজিম্বাবুয়ের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে রবার্ট গাব্রিয়েল মুগাবে ছিলেন একসময়ের মহানায়ক। তবে স্বাধীনতার পর ক্ষমতার মোহ ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে তিনি নিজ জাতির মানুষের কাছে ঘৃণিত এক শাসকে পরিণত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
১ দিন আগে