Ajker Patrika

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংঘাত

ছাইচাপা আগুন থেকে বিস্ফোরণ

সুমন কায়সার
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের সীমান্তচৌকি দখল ও ধ্বংস করার দাবি করেছে। 	ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের সীমান্তচৌকি দখল ও ধ্বংস করার দাবি করেছে। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার রাজধানীতে আফগানিস্তান-বিষয়ক ‘মস্কো ফরম্যাট সংলাপ’ হয়েছে মাত্র কদিন আগে, ৭ অক্টোবর। হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের দুই বিশেষ প্রতিনিধি। কথা বলেছেন অর্থনীতি, বাণিজ্য, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে। তার ৪৮ ঘণ্টা না যেতেই এই দুই দেশের সেনারা সীমান্তে পরস্পরের ওপর হামলে পড়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের সীমান্তচৌকি দখল ও ধ্বংস করার দাবি করেছে। বলা হচ্ছে, দুই পক্ষ মিলিয়ে আড়াই শ জনের মতো নিহত হয়েছে। ৯ অক্টোবর রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের একাধিক লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ হামলার খবরের প্রায় পরপরই ঘটে সীমান্তের এই বড় সংঘাত।

কয়েকটি সূত্রে বলা হয়েছে, আফগান মাটিতে পাকিস্তানের ৯ অক্টোবরের হামলায় নিহত হয়েছেন পাকিস্তানের নিষিদ্ধ কট্টরপন্থী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি) প্রধান মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদ। ২০১৮ সাল থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন মেহসুদ। অবশ্য কোনো পক্ষই মেহসুদের নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা বা পাকিস্তানের হামলার বিষয়ে বিশদ জানায়নি। পাকিস্তান শুধু বলেছে, আফগানিস্তানকে টিটিপির সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

আফগানিস্তানে টিটিপির নেতা ও কথিত ঘাঁটির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার দুদিন পরই সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘাতে জড়িয়েছে দুই প্রতিবেশী। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের বাহিনী প্রতিশোধ নিতে সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাকিস্তানি সেনা অবস্থানে হামলা করে। আবার তার জবাব দিতে পাকিস্তানও আফগান অবস্থানে হামলা চালায়। পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান বলেছে, তারা যে শত্রুকে পাল্টা আঘাত হানার সক্ষমতা রাখে, তা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আফগানপক্ষও জানিয়ে দিয়েছে, হামলা হলে তারা ছেড়ে কথা বলবে না। কাবুল সরকার শনিবারের সংঘাতের পর বলেছিল, ‘বন্ধু সৌদি আরব ও কাতারের পরামর্শে’ সংঘাতে বিরতি দিয়েছে তারা। জানা গেছে, এতে যুক্ত হয়েছিল ইরানও। কিন্তু সোমবারের ওই সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গতকাল বুধবার পর্যন্ত একাধিকবার দ্বৈরথে জড়িয়েছে দুই পক্ষ।

কাবুল ও নয়াদিল্লির মধ্যে সাম্প্রতিক সম্পর্ক উন্নয়নের তৎপরতা দৃশ্যত পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংঘাতে আরেকটি মাত্রা যুক্ত করেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে সমস্যা কয়েক বছর ধরেই চললেও পাকিস্তানের জন্য বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে তার চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারতের দিক থেকে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহ। ভারত এখনো আফগানিস্তানের কট্টর ইসলামপন্থী তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। সারা দুনিয়ায় একমাত্র পুতিনের রাশিয়াই তা করেছে। এ সপ্তাহেই আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে নয়াদিল্লি। কাবুলে পুরো মাত্রায় দূতাবাস খুলতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। কেউ কেউ মনে করছেন, ভারতে মুত্তাকিকে যেভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে, তা-ও সম্ভবত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সীমান্তে সংঘাতের মাত্রা এরকম পর্যায়ে নিতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু খোদ পাকিস্তানি পর্যবেক্ষকেরাই বলেছেন, সার্বিক বিবেচনায় আফগানিস্তানের সঙ্গে খিটিমিটিকে আর বাড়তে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে চলতি সীমান্ত সংঘাতকে বিনা মেঘে বজ্রপাত গোছের কিছু বলা যাবে না। মাত্রাটাই যা চড়া। তা বাদ দিলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিক্ষিপ্ত পাল্টাপাল্টি হামলা কিছুদিন ধরেই চলছিল। মূল কারণ টিটিপির তৎপরতা নিয়ে বিরোধ। বছরখানেক আগে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছিল। আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের ভেতরে একাধিক স্থানে হামলার ঘোষণা দেয় ২৮ ডিসেম্বর। তারা দাবি করে, এটি ছিল পাকিস্তানের আগের বিমান হামলারই জবাব। পাকিস্তানের ভেতরে সম্প্রতি টিটিপির হামলার সংখ্যা ও মাত্রা বেড়ে চলছিল। উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছিল সেনা হতাহতের সংখ্যাও। এ রকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তান বড় ‘কিছু একটা করার’ তাগিদ বোধ করছিল। গত শনিবারের বিস্ফোরণ এই পরিস্থিতিরই অনিবার্য ধারাবাহিকতা।

ইতিহাসের বিচিত্র খেলা হচ্ছে, এই আফগান তালেবানকেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইতে জোরদার সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তান। মনে করা হয়, পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-ই অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তালেবানকে গড়ে তুলেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব ধরে রাখা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া সারা বিশ্বের তিনটি দেশের মধ্যে একটি ছিল পাকিস্তান। মার্কিন বাহিনীর আলোচিত বিদায়ের পর ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আবার কাবুল দখল করলে পাকিস্তান উচ্ছ্বাস গোপন করেনি। কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই তালেবানই তাদের জন্য বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালেবান নতুন করে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে পাকিস্তানের ভেতরে জঙ্গি হামলা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। সীমান্ত ও শরণার্থী নিয়ে বিরোধ অস্বস্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

পাকিস্তানি তালেবান বা টিটিপি পাকিস্তানের বর্তমান গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার বদলে প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মতো ইসলামি শাসন চালু করতে চায়। আদর্শিক মিলসহ নানা কারণে টিটিপিকে দমনে আফগান সরকার তেমন উৎসাহ দেখায় না। পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, কাবুলের তালেবান সরকারের আশঙ্কা, টিটিপির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলে তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে।

২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ আছে। সন্ত্রাস ও চোরাচালান ঠেকানোর লক্ষ্যে পাকিস্তান বছর কয়েক আগে এ সীমান্তে বেড়া তৈরির কাজ হাতে নেয়, যা এখনো শেষ হয়নি। আফগান সরকার এখনো ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত এ সীমান্তকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের কিছু অংশকে নিজেদের ভূখণ্ড বলেও দাবি করে। ফলে এই বেড়া নির্মাণ নিয়ে আফগানিস্তানের আপত্তি আছে।

কিছুদিন আগে পাকিস্তান বেশ কয়েক লাখ আফগান শরণার্থীকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা বেড়ে যায়। পাকিস্তান নিজের বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে আর শরণার্থীর বোঝা টানতে রাজি নয়। মাতৃভূমির ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ হারানো আফগানরা হঠাৎ দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ার মুখোমুখি হয়ে বিচলিত। তালেবান কর্তৃপক্ষও বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি।

তবে আপাতত পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কে তিক্ততার কেন্দ্রে রয়েছে টিটিপির তৎপরতা। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আফগান সরকার তাদের ভূখণ্ডে টিটিপির অস্তিত্ব স্বীকার করে কিছু ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত এ দ্বন্দ্ব মিটবে না। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সামরিক সংঘাত এর কোনো সমাধান নয়। কূটনীতি তথা আলোচনাই হতে হবে মূল উপায়।

দুই সেনাবাহিনীর প্রথাগত যুদ্ধ এক, আর পর্বতসংকুল দুর্গম ভূখণ্ডে জঙ্গিগোষ্ঠীর গেরিলা কায়দার লড়াই সম্পূর্ণ আরেক বিষয়। এর মধ্যে তৃতীয় পক্ষের মদদ বা হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে করতে পারে আরও জটিল। কাহিল অর্থনীতি ও রাজনৈতিক কোন্দলে জেরবার পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক কোনো পক্ষই আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর সঙ্গেও দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের পক্ষে নয়। আবার বিশ্ব থেকে এখনো অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, নানাবিধ অবরোধের চাপে ক্লিষ্ট তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের জন্যও যুদ্ধ সর্বনাশ ডেকে আনবে।

দুই পক্ষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো উত্তেজনা হ্রাস ও বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। আফগানিস্তানের ওপর ইদানীং চীনের প্রভাব যথেষ্ট, যারা কিনা আবার পাকিস্তানের পুরোনো, পরীক্ষিত মিত্র। আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ ও আগ্রহ থাকা ভারতও যে এ তালিকায় থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত