Ajker Patrika

মডেল বানানোর আশা দেখিয়ে দেহব্যবসায় বাধ্য করত হৃদয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেট : ৩০ মে ২০২১, ০৮: ৫৯
Thumbnail image

ঢাকা: বিয়ের বয়স এক বছরের কিছু বেশি। টিকটক ভিডিও বানানো নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হতো না তাঁর। সংসার জীবনের ছয় মাসই মগবাজারের নয়াটোলায় বাবার বাড়িতে কাটে। গত ১৮ মার্চ হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর ভারত থেকে ফোন করে ওই তরুণী পরিবারকে ফোনে জানান, টিকটক ভিডিও থেকে মডেল নেবে মুম্বাইয়ের সিনেমায়। সেখানেই কাজের ব্যবস্থা করে দেবে তাদের এলাকার ছেলে টিকটক হৃদয় বাবু।

সংসার করতে ভালো লাগছে না তাই এ পথেই নিজের ক্যারিয়ার গোছানোর কথা বাসায় জানায় সেই তরুণী। তারপর থেকে আর যোগাযোগ হয়নি বাবা–মায়ের সঙ্গে। ঠিক ১৩ দিনের মাথায় ২ এপ্রিল রাতে বাসায় ফিরে আসার পর জানায়, ভারতের একটি পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেখান থেকে কোনোমতে পালিয়ে এসেছে সে।

আজ শনিবার দুপুরে হাতিরঝিল থানার সামনে অপেক্ষারত সেই তরুণীর মা আজকের পত্রিকাকে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এই টিকটকই আমার মাইয়াডার সর্বনাশ করলো। জামাইর লগে ঝগড়া হইতো। তাই আমগো বাসায় আইনা রাখছিলাম। এইডা (টিকটক) দিয়াই ওই হৃদয় বাবুর লগে পরিচয়। আমার মাইয়াডারে ইন্ডিয়া নিয়া বেইচ্চা দিছিলো। ডেইলি খালি কান্দে।’ তিনি দাবি করেন, ভারতে ধর্ষণের ভিডিও ভাইরালের পর গত পরশু দিন ডিবি পুলিশ, তারপরের দিন র‍্যাব বাসা থেকে নিয়ে যায় তাঁর মেয়েকে। শুক্রবার রাত ১২টার দিকে হাতিরঝিল থানা-পুলিশ তাঁকে হেফাজতে নিয়েছে।

মৌচাক মার্কেটে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজের পাশাপাশি টিকটকেও মজেছিলেন সদ্য কৈশোর পেরোনো আরেক তরুণী। হাতিরঝিলের গুলবাগ এলাকা থেকে তাঁকেও হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, মডেল হতে তিনি পাড়ি জমান ভারতে। গত ১৪ এপ্রিল রোজার প্রথম দিন টিকটক হৃদয়ের এক সহযোগীর মাধ্যমে সাতক্ষীরা হয়ে অবৈধ পথে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে পরিবারকে ফোন করে বলেন। আর কষ্ট থাকবে না। অনেক টাকা উপার্জন করব।
ভুক্তভোগী তরুণীর মা জায়েদা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ আটকে রেখে অমানবিক অত্যাচার করত। চার দিন চেষ্টার পর ঈদের দিন রাতে পালিয়ে ফেরত আসে আমার মেয়ে। তাঁর আসার জন্যও আমাদের ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বৃহস্পতিবার ডিবি পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার সকালে দিয়ে গেছে। রাতেই আবার থানা-পুলিশ নিয়ে এসেছে।’

এভাবেই একে একে বেরিয়ে আসছে হৃদয় বাবুর নারী পাচারের নানা তথ্য। টিকটকের সাহায্যে পরিচয় হওয়ার পর তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলত হৃদয়। আজ পর্যন্ত তিনজন তরুণীর খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। যাদের ভারতে পাচারের পর জোর করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করত হৃদয় ও তাঁর গ্যাংয়ের ভারতীয় সদস্যরা। সবার কাছ থেকে ঘটনার তথ্য নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঢাকার মগবাজারের টিকটক হৃদয় বাবু এক নারী এবং আরও তিন সহযোগীসহ বেঙ্গালুরু পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।পালাতে গিয়ে গুলিতে আহতও হয়েছে দুজন। গতকাল হৃদয়ের সঙ্গে টিকটক ভিডিও বানাতো এমন চার তরুণকে আটক করেছে হাতিরঝিল থানা-পুলিশ। ধর্ষণে ও মানবপাচারের ইস্যুতে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের হেফাজতে তিন জন মেয়ে আছে। যারা ভারত থেকে পালিয়ে এসেছেন। ভারতের বেঙ্গালুরুর আনন্দপুরের একটি হোটেল রাখা হয়েছিল তাদের। সেখানে দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য করা হতো বলে জানিয়েছেন তাঁরা।’

আজ বিকেলে নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের তেজগাঁও বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, স্কুল–কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে বিবাহিত নারীদের টার্গেট করত হৃদয় বাবু। টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় পরিচয় হওয়া তরুণ তরুণীরা মিলে ফেসবুকে একটি গ্রুপ বানিয়েছে। সেটিই মূলত মানবপাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। সেখানে বেতনভুক্ত সদস্যরা নারীদের টার্গেট করে ফুসলিয়ে বিদেশে পাচার করে।

পুলিশ তদন্ত করে যা পেয়েছে

বাংলাদেশের কয়েকটি গ্রুপ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের অপরাধী চক্র মিলে সংঘবদ্ধ এই মানবপাচার চক্রটি তৈরি করেছে। যার আওতা দুবাইসহ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত। টিকটক হৃদয় বাবু এই চক্রের একজন সরবরাহকারী। দেশে বিভিন্ন জেলা ও সীমান্তে তাঁর আরও সহযোগী রয়েছে।
এই চক্রের আস্তানা বেঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। তাঁদের সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় কিছু হোটেলে চুক্তি থাকে। ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পারলারে লোভনীয় বেতনে চাকরির কথা বলে পাচার করা হতো। তারপর পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করত। কিছুদিন পর পছন্দ মতো তাঁদের আবার দুবাইয়ে বিক্রি করা হতো।

কেউ দেহ ব্যবসায় রাজি না হলে জোর করে মাদক খাইয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও করত তাঁরা। পালাতে চাইলে সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে এবং পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই বিদেশের মাটিতে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিত তরুণীরা।
পুলিশ জানায়, ভাইরাল ভিডিওটির ঘটনায় জড়িত সবাই অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছে। যারা আগেও পাচার হয়েছে তাদেরও অবৈধ পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত