Ajker Patrika

কফির জগতে স্বাগত

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৫, ২১: ২৫
কফি বিশ্বের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক পণ্য। ছবি: পেক্সেলস
কফি বিশ্বের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক পণ্য। ছবি: পেক্সেলস

সাপের বিষ মিশিয়ে কফি পান!

আপনার মতো আমরাও যখন তথ্যটি প্রথম শুনি, খানিক হোঁচট তো খেয়েছিলাম; কিন্তু সামলে নিয়েছি। কারণ, আমরা জানি, পৃথিবীতে কফি হলো এক উন্মাদনার নাম। বুঝতেই পারছেন, কতটা উন্মাদনা থাকলে কফির সঙ্গে বিশেষ কৌশলে সাপের বিষ মিশিয়ে পান করা যায়! আবার সেটাকে মানুষ মনে করে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ। নাহ্‌, ভাবা যায় না।

একটি কফি শপ। ছবি: পেক্সেলস
একটি কফি শপ। ছবি: পেক্সেলস

কফি আবিষ্কারের গল্পটাই তো এক দুর্দান্ত অনুসন্ধিৎসু মানুষের গল্প। মনে আছে নিশ্চয়। গল্পটা যাঁদের জানা নেই, তাঁদের জন্য বলি, ইথিওপিয়ান লোককথা অনুযায়ী, নবম শতাব্দীতে কালদি নামের এক ছাগলপালক দেখলেন, তাঁর ছাগলগুলো এক বিশেষ গাছের ফল খাওয়ার পর বেশি চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্থানীয় এক সুফি সাধক সেই ফল দিয়ে একটি পানীয় তৈরি করলেন। সেই পানীয়ই পরে কফি হিসেবে পরিচিতি পায়।

অদ্ভুতভাবে ইউরোপে প্রথম দিকে কফিকে ‘শয়তানের পানীয়’ নামে ডাকা হতো। ঘটনাটি ছিল ষোলো শতকের দিকের। সেই সময় কফি প্রথম ইউরোপে পাড়ি জমায়। কয়েকজন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক সেই পানীয় পান করে তাকে শয়তানের পানীয় নামে ডাকতে শুরু করেন। পরে পোপ ক্লেমেন্ট অষ্টম কফির স্বাদ নিয়ে বলেন, ‘এই পানীয় এত সুস্বাদু যে শুধু অবিশ্বাসীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়!’ তারপরেই কফি ইউরোপে জনপ্রিয় হয়।

ইউরোপে এক সময় কফিকে 'শয়তানের পানীয়' নামে ডাকা হতো। ছবি: পেক্সেলস
ইউরোপে এক সময় কফিকে 'শয়তানের পানীয়' নামে ডাকা হতো। ছবি: পেক্সেলস

কাঁঠালের আঠা আর কফির সম্পর্ক কী? পিরিতি বা প্রেম। তবে এর সঙ্গে যুক্ত আছে ‘চুরি’ শব্দটিও। মানে প্রেম ও চুরি—দুটি-ই কফির সঙ্গে যুক্ত। সে এক বিশাল গল্প। সংক্ষেপে বলি। আগে প্রেমের গল্প। বর্তমান সময়ে কফি চাষের জন্য খুবই বিখ্যাত দেশের নাম ব্রাজিল। জি, শুধু ফুটবলের জন্যই বিখ্যাত নয় দেশটি। কফির জন্যও খ্যাতিমান। সেই ব্রাজিলে কফি গাছ প্রথম যায় ১৭২৭ সালে। যিনি কফি বীজ ব্রাজিলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম ফ্রান্সিসকো দে মেলো পালহেতা। এই ভদ্রলোক ফ্রেঞ্চ গায়ানার গভর্নরের স্ত্রীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কফি বীজ সংগ্রহ করেছিলেন! তারই ফল এখন পাচ্ছে ব্রাজিল। দেশটি এখন পুরো বিশ্বে উৎপাদিত কফির প্রায় ৪০ শতাংশ একাই সরবরাহ করে। আরও মজার তথ্য হলো, ব্রাজিলিয়ানরা প্রতিবছর প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যাগ কফি পান করে! আর ব্রাজিলের সান্তোস বন্দর দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কফি রপ্তানি হয়। কী বুঝলেন? প্রেমের ফল এমনই হয়।

কফি বীজ চুরির সঙ্গে জড়িত এক ভারতীয় সন্ত। তাঁর নাম বাবা বুদান। ১৬ শতক পর্যন্ত কফি শুধু ইয়েমেনে চাষ হতো। আরবরা কফি বীজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। ইয়েমেনের আইন অনুসারে সে সময় কফি বীজ রপ্তানি করা ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তারপরেও সেটি চুরি হয়েছিল।

বুদান গিরিতে বাবা বুদানের দরগা। ছবি: উইকিপিডিয়া
বুদান গিরিতে বাবা বুদানের দরগা। ছবি: উইকিপিডিয়া

কিংবদন্তি বলে, বাবা বুদান গিয়েছিলেন হজ করতে। মক্কা থেকে ফেরার সময় তিনি ইয়েমেনে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে কফি বীজ থেকে তৈরি হওয়া সুগন্ধি পানীয় দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বীজ সংগ্রহের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু স্থানীয়রা তাঁকে বীজ দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি গোপনে ৭টি বীজ সংগ্রহ করেন। বাবা বুদান সেই বীজগুলো কর্ণাটকের চন্দ্রগিরি পাহাড়ে রোপণ করেন। সেখান থেকে চারা তৈরি হলে তা ছড়িয়ে পড়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও। বাবা বুদানের প্রতি সম্মান জানাতে চন্দ্রগিরি পাহাড়ের নাম রাখা হয় বাবা বুদান গিরি। এই সন্তর প্রতি সম্মান জানাতেই হতো। কারণ, তিনি স্থানীয় কৃষকদের জন্য দারুণ এক অর্থকরী ফসলের সন্ধান দিয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ডের মুখে দাঁড়িয়ে।

এসব পুরোনো গল্প থাক। আমরা বরং একটু নতুন দিনে আসি।

১৯০১ সালে ইতালির নাগরিক লুইগি বেজ্জেরা উদ্ভাবন করেন এসপ্রেসো মেশিন। তিনি দ্রুত কফি বানানোর জন্য বাষ্পচাপ ব্যবহার করেছিলেন। এসপ্রেসো অর্থ দ্রুত বা এক্সপ্রেস। সে জন্য এই মেশিনের নাম হয় এসপ্রেসো।

এসপ্রেসো মেশিন। ছবি: পেক্সেলস
এসপ্রেসো মেশিন। ছবি: পেক্সেলস

বিশ্বের দামি কফির নাম কী? অনেকে জানেন, তার নাম কোপি লুয়াক। ইন্দোনেশিয়ায় লুয়াক বা পাম সিভেট নামের এক প্রকার বেজি কফি ফল খেয়ে পরিপাক করে মলত্যাগ করে। সেই মল থেকে সংগ্রহ করা বীজ থেকে তৈরি হয় কোপি লুয়াক। এটি কিলোগ্রাম প্রতি ১০০ থেকে ৬০০ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়!

কফির বীজ আসলে আসলে কফি চেরির (একধরনের বেরি) বীজ। প্রতিটি ফলে সাধারণত দুটি বীজ থাকে। তবে কখনো কখনো একটিমাত্র গোল বীজও থাকে, যাকে বলে পিবেরি।

ফিনল্যান্ড বিশ্বের সর্বোচ্চ কফি পানকারী দেশ। হ্যাঁ, সুখী দেশের মানুষেরাই বেশি কফি পান করে। এটা প্রমাণিত। ফিনিশরা একেকজন প্রতিবছর প্রায় ১২ কেজি কফি পান করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এমনকি সেখানে গর্ভকালীন ছুটির সময় কর্মজীবী নারীদের জন্য কফি ব্রেক বাধ্যতামূলক!

আমরা ভাবি, দূর্বা ঘাস প্রায় অমর। শুকনো সে ঘাস মাটি ও পানির সংস্পর্শে এলে আবার সবুজ হয়ে ওঠে। কিন্তু কফি বীজ তাকে টেক্কা দিয়েছে। জানা যাচ্ছে, কফি বীজ থেকে ১০০ বছর পরও অঙ্কুরিত হতে পারে! ২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা ১৮৪০ সালের সংরক্ষিত কফি বীজ থেকে একটি চারা জন্মাতে সক্ষম হন। আর কোনো প্রমাণ জরুরি কি?

কফি বনাম চা বিষয়ে ব্রিটিশ রাজনীতির কথায় আসি। ১৭-১৮ শতকে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা কফিকে ‘প্রগতিশীল পানীয়’ এবং চাকে ‘রক্ষণশীল পানীয়’ হিসেবে বিবেচনা করতেন!

কফি নিয়ে আরও কিছু তথ্য

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক বাণিজ্যিক পণ্য

তেলের পরেই কফি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হওয়া পণ্য। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে ২ বিলিয়নের বেশি কাপ কফি পান করা হয়!

ব্ল্যাক কফি হজমক্ষমতা বাড়ায় এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করে। ছবি: পেক্সেলস
ব্ল্যাক কফি হজমক্ষমতা বাড়ায় এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করে। ছবি: পেক্সেলস

ব্ল্যাক কফি সত্যিই ওজন কমাতে সাহায্য করে

ব্ল্যাক কফি হজমক্ষমতা বাড়ায় এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করে। ক্যাফেইন শরীরের শক্তি খরচ ৩ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে, যা ওজন কমানোর জন্য সহায়ক।

বাহাইয়ের বিশ্বাসে কফি নিষিদ্ধ ছিল

বাহাই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বাহাউল্লাহ প্রথমে কফি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি নিজেই এটি পান করা শুরু করেন এবং তাঁর অনুসারীদেরও পানের অনুমতি দেন।

কফি গাছের রক্ষণাবেক্ষণের কারণে যুদ্ধ হয়েছিল!

ফ্রান্স ব্রাজিল থেকে কফি চারা চুরি করে নিজেদের কলোনিতে চাষ করতে চেয়েছিল বলে ১৮০০ সালের দিকে দুই দেশের মধ্যে ‘কফি যুদ্ধ’ হয়েছিল।

কফি অমরত্ব দিতে না পারলেও দীর্ঘ জীবন দিতে পারে!

বেশ কিছু গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, নিয়মিত কফি পানকারীদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস, পার্কিনসন্স ও লিভারের রোগ হওয়ার আশঙ্কা কম। এমনকি কিছু গবেষণা বলছে, কফি পানকারীরা সাধারণত বেশি দিন বাঁচেন!

নীলফামারী জেলার একটি পরীক্ষামূলক কফি বাগানে রোবাস্টা কফি। ছবি: রজত কান্তি রায়
নীলফামারী জেলার একটি পরীক্ষামূলক কফি বাগানে রোবাস্টা কফি। ছবি: রজত কান্তি রায়

ক্যাফেইন ছাড়া কফিও আছে!

ডিক্যাফ কফি থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাফেইন সরানো হয়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ক্যাফেইনমুক্ত নয়। একটি ডিক্যাফ কফিতেও ক্যাফেইন থাকে।

কফি স্নানও আছে!

জাপানের ইউনোমাতে ইউনোমারু ওনসেন নামের একটি হট স্প্রিং আছে। সেখানে কফি দিয়ে স্নান করা যায়! বিশ্বাস করা হয় যে এটি ত্বক মসৃণ করে এবং শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়।

কফি গাছ ২০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে!

একটি কফি গাছ সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন দেয়। কিন্তু সঠিক যত্নে এটি ২০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে!

একবার কফি চাষ নিষিদ্ধ হয়েছিল

১৬৭৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস কফি হাউসগুলো বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, হিস্ট্রি ডটকম, বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত