Ajker Patrika

কেমন ছিল আগের সেই দিনগুলো

হেঁটে হজে যাওয়া

কাউসার লাবীব
আপডেট : ১৬ মে ২০২৫, ০৮: ২৪
হেঁটে হজে যাওয়া

কাউসার লাবীব

পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। হাওয়াই জাহাজে চড়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া যায় অল্প সময়ের ব্যবধানে। হজের উদ্দেশে মক্কায় যাওয়া যায় কয়েক ঘণ্টায়। বাংলাদেশে ফজরের নামাজ আদায় করে বিমানে উঠলে পবিত্র কাবায় গিয়ে জোহরের নামাজ আদায় করা সম্ভব। কিন্তু একসময় হজযাত্রা এত সহজ ছিল না। শারীরিকভাবে শক্তিশালী ও প্রবল মনোবলের অধিকারী মুসলমানরা এ সফরের সাহস করতে পারতেন।

হেঁটে হজযাত্রার পথ ছিল আশঙ্কায় ভরা

আগেকার যুগে হজ মানে ছিল দীর্ঘ, কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ এক সফর। জাহাজে চড়ে কিংবা হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো প্রাণের শহর মক্কায়। তখনকার মুসলমানদের জন্য হজ শুধু ফরজ আদায়ের মাধ্যম ছিল না, ছিল এক কঠিন আত্মোৎসর্গ ও আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশের সফর। যে সফরে ছিল অচেনা পথের নানা আশঙ্কা—কখন যেন ডাকাত আক্রমণ করে, লুটেরাদের হামলায় সব হারাতে হয়! তবে এ সফরে মুসলমানদের হৃদয়ে থাকত বায়তুল্লাহর প্রতি ভিন্ন এক ব্যাকুলতা। কাবা প্রাঙ্গণে গিয়ে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনি তোলার প্রবল উদ্দীপনায় তাঁরা কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতেন সব বাধা ডিঙিয়ে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন মদিনায় গিয়ে নবী করিম (সা.)-এর রওজার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’, তখন সফরের কষ্ট মুছে যেত হৃদয় থেকে। মক্কায় এসে আবে জমজম পানের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে বয়ে যেত অন্য রকম এক আবেগ। হাজিরা ভুলে যেতেন পথের সব ক্লান্তি। কাবার দিকে তাকিয়ে ঢেলে দিতেন হৃদয়ের সঞ্চিত সব আবেগ। হাজরে আসওয়াদে চুমু এঁকে ধুয়েমুছে সাফ করে নিতেন জীবনের সব পঙ্কিলতা।

এই দীর্ঘ যাত্রায় শুধু শারীরিক কষ্ট ছিল না, ছিল এক আধ্যাত্মিক সফর। পথের কষ্ট, ইবাদতের প্রস্তুতি, কাফেলার সঙ্গে সংহতি—সব মিলিয়ে তা এক জীবন্ত ইবাদত হয়ে উঠত। অনেকে সফর শেষ করতে পারতেন না, পথে মৃত্যুবরণ করতেন। অচেনা ভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হতেন বায়তুল্লাহর মুসাফির। সফরসঙ্গীর বিয়োগে কাফেলার অন্যদের হৃদয়ে শোক পরিণত হতো শক্তিতে। তাঁদের নিয়ত থাকত অটুট—আল্লাহর ঘরে পৌঁছাবেন কিংবা পথেই শেষ হবে জীবনের সফর।

হেঁটে হজযাত্রা যেভাবে শুরু হতো

তখনকার সময়ে হজযাত্রার প্রস্তুতি নিতে হতো এক-দেড় বছর আগে থেকে। সফরের প্রয়োজনীয় সামানা, বাহন ও অর্থ সংগ্রহ শেষে কাফেলা তৈরি হতো; নির্ধারিত হতো যাত্রার সময়। এ সফর থেকে না-ও ফেরা হতে পারে; তাই যাওয়ার আগে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতেন, পাওনা পরিশোধ করে দায়মুক্ত হতেন হজযাত্রীরা। এরপর কাফেলা ছুটত কাবার পথে। হেঁটে কিংবা উট, ঘোড়া, গাধা, খচ্চরের পিঠে চড়ে—দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলত বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলমানদের হজের কাফেলা। কেউ ভারতীয় উপমহাদেশ, কেউ আফ্রিকা, কেউবা মধ্য এশিয়া থেকে যাত্রা করতেন—পথে থাকত মরুভূমির উত্তাপ, খাবার ও পানির সংকট, ডাকাতের ভয় ও অসুস্থতার ঝুঁকি। বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনিতে পাওয়া যায়, তিনি মরক্কো থেকে ১৬ মাস সফর করে হজ আদায় করতে মক্কায় গিয়েছিলেন।

হজযাত্রীরা হেঁটে হজে যেতেন যেসব পথে

হেঁটে বা উট, ঘোড়া ও গাধার পিঠে চড়ে যেসব পথে মুসলমানরা হজে যেতেন; এর মধ্যে অন্যতম ছিল জুবাইদাহ, ইরাকি, শামি, মিসরীয়, ইয়েমেনি ও ওমানি পথ। প্রাচীন এসব পথ শুধু ধর্মীয় নয়, ছিল বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান বিনিময়ের এক বিরল প্ল্যাটফর্ম। এই পথে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা, সংস্কৃতির আদান-প্রদান ও নগরগুলোর পারস্পরিক সংযোগ। ঐতিহাসিক ইসলামি শহরগুলো এসব পথের মাধ্যমে জেগে উঠেছিল গতিময়তায়। হাজিদের সুবিধার জন্য মুসলিম শাসকেরা এ পথগুলোতে যাত্রাচৌকি নির্মাণ করেছিলেন। হজযাত্রী এবং তাঁদের পশুর জন্য যাত্রাচৌকির পাশে থাকত কূপ, হাউস ও জলাধার। কোথাও কোথাও খাবারের সুব্যবস্থাও থাকত।

মিনায় হাজিরা রান্নাবান্না করছেন, ১৯৫৩। ছবি: সংগৃহীত
মিনায় হাজিরা রান্নাবান্না করছেন, ১৯৫৩। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা অঞ্চল থেকে হেঁটে হজযাত্রা

বাংলা থেকে হেঁটে হজে গিয়েছেন বহু পীর-বুজুর্গ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তখন কেউ হজে গেলে পুরো এলাকায় রব উঠত। দলে দলে মানুষ কাবার পথের যাত্রীকে দেখতে আসত, দোয়া নিতে আসত। অনেকে বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসত। সবার দোয়া ও শুভকামনা নিয়ে কাফেলাবন্দী হয়ে রওনা হতেন হজযাত্রীরা। কোনো কোনো যুগে ভারতের অভ্যন্তরে হজযাত্রীদের নিরাপত্তার কিছুটা অভাব ছিল। কখনো যাত্রাপথে তাঁরা প্রতারক ও চোরদের কবলে পড়তেন। ভারতবর্ষের হজযাত্রীরা সাধারণত বোম্বে গিয়ে একত্র হতেন। ছোট ছোট কাফেলা মিলে বড় কাফেলায় পরিণত হতো। এরপর আফগান, ইরান ও ইরাক হয়ে মক্কায় পৌঁছাতেন তাঁরা।

বাঙালি সমাজে হাজিদের নিয়ে উচ্ছ্বাস

পথে ডাকাতের তাড়া, ভিন্নমতাবলম্বীদের আক্রমণ, মহামারির ছোবল, ঝড়ঝঞ্ঝাসহ শতবাধা অতিক্রম করে যাঁরা হজ আদায় করে দেশে ফিরতে পারতেন, আমৃত্যু তাঁদের মর্যাদার চোখে দেখা হতো। হাজিদের অভ্যর্থনায় ভেঙে পড়ত পুরো গ্রাম। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত হাজি সাহেবকে দেখার জন্য। হাজি সাহেবের আনা আবে জমজম, সুরমা, আতর আর জয়তুন যারা ভাগে পেত; নিজেকে ধন্য মনে করত। কোনো কোনো এলাকায় হাজি সাহেবের সম্মানে বদলে যেত গ্রাম, পাড়া-মহল্লা আর বাড়ির নাম। নতুন নাম হতো—হাজিপুর, হাজিগাঁও, হাজিপাড়া কিংবা হাজিবাড়ি। হাজিবাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারা গর্বের বলে মনে করা হতো। এসব সম্মানের ফলে স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেরা হাজিদের শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি থাকলেও মন ভরে উঠত তৃপ্তিতে। হৃদয়ে ভাসত বায়তুল্লাহর কালো গিলাফ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত