Ajker Patrika

শেখের বেটি হারলে বাংলাদেশ হেরে যায়

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
শেখের বেটি হারলে বাংলাদেশ হেরে যায়

আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ ও ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রত্যাশার প্রহর গোনার কাল গণনা করলে দেখা যাবে, পাকিস্তানের রাজনীতি যত অগ্রসর হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টাও তত বেগবান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শাসকের কাঁটা বিছানো পথে দুইয়ের যুগ্ম অভিযাত্রায় কত বাঁকবদল, কত রক্ত, কত অশ্রু, কত নির্যাতন, কত গুলি, কারফিউ, ১৪৪ ধারা, সামরিক কুদেতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে, তার কোনো লেখাজোখা নেই। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ শাসন আমার বহুদিনের চর্চা, অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের বিষয়। বহু বছর ধরে পড়াশোনা করতে করতে আওয়ামী লীগের ওপর একটি লেখা তৈরির আইডিয়া আমার মাথায় আসে। লেখাটি বড় হয়ে যাওয়ায় তিন পর্বে ছাপার ব্যবস্থা করতে হয়। আজ এর তৃতীয় বা শেষ পর্ব।

আওয়ামী লীগের সমর্থক বা দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কী আওয়ামী লীগ সম্মান জানাতে পারে না? বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও এই দলটির বিকাশে এবং দুঃসময়ে তাঁদের লেখনী দিয়ে, সৃজনকলা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেওয়ার পর, যত দিন ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছয় দফা সমর্থন করেননি, ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে লেখা রাজনৈতিক কলামে তাঁর ক্ষুরধার কলম দিয়ে ছয় দফার সমর্থনে যুক্তিতর্ক দিয়ে লেখনী আরম্ভ করেননি এবং সারা দেশে ছয় দফার সমর্থনে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতি ও বক্তৃতা-বিবৃতির সংবাদ ইত্তেফাকের পাতায় ফলাও করে ছাপা শুরু করেননি, তত দিন পর্যন্ত ছয় দফার পালে বাতাস লাগেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে আক্রমণ শুরু করেছিল, তাতে বাড়িঘরেও টেকা দায় হয়ে পড়েছিল। সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনি ভয়ার্ত পরিবেশ শুধু চারজন বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠই সরব হয়ে উঠেছিল। তাঁরা হচ্ছেন—আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, ড. মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির ও আবেদ খান। শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেপ্তার করে তাঁর ওপর নির্যাতনও চালানো হয়েছিল। সেদিন বুদ্ধিজীবীদের নির্ভীক কণ্ঠ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারতেন কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংকটে বুদ্ধিজীবীদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা অবগত আছেন বলেই তিনি বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে দলের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে নিয়মিত তাঁদের মতামত জানার ও শোনার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সে জন্যই তো চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. অনুপম সেন এবং অধ্যক্ষ ড. প্রণব বড়ুয়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হতে পেরেছেন। কিন্তু চট্টগ্রামে মহানগর আওয়ামী লীগের যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে তাতে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের কোনো স্থান হয়নি; শুধু দলটির প্রবীণ নেতাদের ঠাঁই হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন না, কিন্তু তাঁদের কলমের লেখনী দ্বারা অথবা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে একই কাজ তো তাঁরাও করেন।

বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে সমাজ থেকে অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ফতোয়াবাজি নির্মূল করে সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সে জন্য আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া তাঁদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। বিএনপি, জামায়াত বা অন্য কোনো পশ্চাৎপদ শক্তি ক্ষমতায় এলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধিচর্চা, মানবাধিকার তথা সমাজ প্রগতির প্রবহমান ধারা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ কারণে সর্বাবস্থায় আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পেয়ে যায়।

সংখ্যালঘুদের যে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারও উৎস এটাই। এ এক নিদারুণ পরিস্থিতি। এটা লক্ষ করেই কবি শামসুর রাহমান এবং সাহিত্যিক আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘শেখের বেটি হারলে বাংলাদেশ হেরে যায়। আর শেখের বেটি জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জেতে।’ এ কথার অর্থ হচ্ছে শেখের বেটি, অর্থাৎ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চেতনার প্রতীক, আদর্শের প্রতীক, মূল্যবোধের প্রতীক। বাংলাদেশের চেতনা, অর্থাৎ স্বাধীনতার চেতনা। বাংলাদেশের আদর্শ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশের মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা, উদার মানবিকতা ও নারী স্বাধীনতা। বাংলাদেশের আদর্শ ও চেতনায় সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা, অসাম্য, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও সংগ্রামের সংকল্প নিহিত রয়েছে। শেখ হাসিনা নির্বাচনে পরাজিত হলে অন্ধকারের অপশক্তি মানবিকতা, শুভ্রতা, শুভবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ওপর চড়াও হয়ে অট্টহাসি হাসে।

‘শেখের বেটি জিতলে শুধু আওয়ামী লীগ জেতে’—এই বক্তব্যের নির্গলিতার্থ হচ্ছে, শেখ হাসিনা নির্বাচনে জয় লাভ করলে আওয়ামী লিগাররাই ক্ষমতার স্বাদ পায়। দেশ বা গোটা জাতি পায় না। কিন্তু এ কথাটা এখন সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ ২০০৮ সাল থেকে তিন দফায় টানা ১৪ বা ১৫ বছর শেখ হাসিনার বর্তমান ক্ষমতার মেয়াদে বাংলাদেশ, অর্থাৎ জনগণেরই জিত হয়েছে। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য, দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সোপানে উন্নীত করার জন্য কত পদক্ষেপ, কত কর্ম পরিকল্পনা যে তিনি নিয়েছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। অনুন্নত দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করেছেন। এখন উন্নত দেশে উন্নীত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

তিন টার্ম মনে হচ্ছে লম্বা সময়, কিন্তু এক দিনের জন্যও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় স্বস্তি পাননি। দেশ-বিদেশে বহুমাত্রিক সংকটে তাঁর শাসনকাল তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। তিন টার্মের মধ্যে দুই টার্ম রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিএনপির অগ্নি-সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যার নৃশংস ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক সংকট এবং বিদেশে অর্থনৈতিক মন্দা, করোনা অতিমারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার-সংকটে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর মূল্যবৃদ্ধির আঘাত সয়ে শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির চাকা সচল রেখেছেন। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অস্বীকৃত হওয়ায় নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেতু নির্মাণ করে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে দেশপ্রেম ও আত্মনির্ভরশীলতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার নির্মাণ, ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, রাজপথ চার লেন, ছয় লেনে সম্প্রসারিত করে উন্নয়নের মহোৎসব সৃষ্টি করেছেন।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

আরও পড়ৃন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জাতিসংঘের ফলকার তুর্কের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল আইএসপিআর

প্রধান উপদেষ্টার নতুন বিশেষ সহকারী কে এই আনিসুজ্জামান চৌধুরী

সিএমএইচে মাগুরার শিশুটির অবস্থা অপরিবর্তিত: আইএসপিআর

ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গ ও স্তন কেটে হত্যা, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল আসামি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত