Ajker Patrika

যশোরে ছুরি-চাকু মারার আতঙ্ক

রাশেদ নিজাম, যশোর থেকে
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১০: ৪০
Thumbnail image

গুলি-বোমার বদলে যশোরে হত্যা ও সংঘর্ষে ছুরি-চাকুর ব্যবহার বেড়েছে। কাউকে গুলি করে বা বিস্ফোরক দিয়ে মারলে হত্যা মামলার পাশাপাশি অস্ত্র কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাও মোকাবিলা করতে হয়। বাড়তি মামলার ঝক্কি এড়াতেই ছুরি-চাকুর ব্যবহার হয়ে আসছে বেশ আগে থেকে। তবে বছর দুয়েক ধরে যশোর শহরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক ঘটনায় ছুরি-চাকুর ব্যবহার বেড়েছে। গত সাত-আট মাসে শুধু ছুরি-চাকু দিয়ে যশোরে অন্তত ছয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে চাকুর ব্যবহার যশোরে একধরনের ঐতিহ্য হয়ে গেছে। যদিও তাঁর দাবি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করায় চাকুর ব্যবহার কমে গেছে। কোনো অপরাধ ঘটার পরপরই পুলিশ দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ায় সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে গেছে।

যেদিন (বৃহস্পতিবার) বেলাল হোসাইন এমন দাবি করেন, সেদিনই যশোরে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন মুদিদোকানি এরফান ফরাজী।

এর আগে ৮ নভেম্বর যশোরের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আসাদুজ্জামান ওরফে বুনো আসাদকে শহরের বেজপাড়ায় ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। ২১ নভেম্বর তিনি মারা যান। বিভিন্ন মামলার আসামি আসাদ একসময় শাহীন চাকলাদারের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। খুন হওয়ার পাঁচ-ছয় মাস আগে তিনি সদর আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের দলে ভিড়েছিলেন।

র‍্যাব-৬ যশোর ক্যাম্পের সিপিসি-৩-এর কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার নাজিউর রহমান গত বুধবার নিজ কার্যালয়ে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে খুন কিংবা সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরি-চাকুর ব্যবহার লক্ষ করছেন তাঁরা। বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি ঘটনায় আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, গুলি করার ঘটনায় অস্ত্র মামলা হয় এবং সাজা থেকে মওকুফ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই ছুরি কিংবা চাকুকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা।

চার কাউন্সিলর অবাঞ্ছিত স্থানীয় পুলিশ ও র‍্যাব সূত্রে জানা যায়, পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরো শহরের অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চার কাউন্সিলর। তাঁরা হলেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের মো. সাহিদুর রহমান ওরফে ডিম রিপন, ৪ নম্বরের জাহিদ হোসেন ওরফে টাক মিলন, ৬ নম্বরের মো. আলমগীর কবির সুমন ওরফে হাজি সুমন এবং ৭ নম্বরের শাহেদ হোসেন নয়ন ওরফে হিটার নয়ন।

জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নয়জন কাউন্সিলরের মধ্যে ডিম রিপন, হিটার নয়ন, টাক মিলন ও হাজি সুমনকে নিজ কার্যালয়ে ঢোকার বিষয়ে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন বর্তমান পুলিশ সুপার। জেলা পুলিশের কোনো অনুষ্ঠানেও তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেশির ভাগই কিশোর-তরুণ। এরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা কাউন্সিলরের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে।

জানা যায়, রিপন ও নয়ন একসময় বিএনপি করলেও এখন এমপি কাজী নাবিল আহমেদের ঘনিষ্ঠ। টাক মিলন বহু বছর শাহীন চাকলাদের সঙ্গে থাকলেও সম্প্রতি নাবিলের দলে ভিড়েছেন। হাজি সুমন শুরু থেকেই শাহীনের দলে।

চাকু-সন্ত্রাস, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণহ নানা অভিযোগের বিষয়ে কাউন্সিলর সাহিদুর রহমান বলেন, এসব রাজনৈতিক চক্রান্ত। কাউন্সিলর জাহিদ হোসেনেরও দাবি, সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি বলেন, ‘যদি এত অপরাধ করে থাকি, তাহলে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না কেন?’

কাউন্সিলর আলমগীর কবির সুমন নিজেকে জনগণের সেবক দাবি করে বলেন, ‘শাহীন ভাইর রাজনীতি করার কারণে নানা অভিযোগ করা হয়। মানুষ বলতে পারবে আমার সম্পর্কে।’

কাউন্সিলর শাহেদ হোসেন নয়ন বলেন, ‘স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার ইশারায় আমাদের নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং এখনো চলছে।’ তাঁর দাবি, মানুষের সেবা করতেই রাজনীতি করেন।

যশোরে আইনশৃঙ্খলা ও রাজনীতি আগের চেয়ে অনেক ভালো বলে দাবি করেন সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার যারা রাজনৈতিক কর্মী, তাদের অনেকের সাথে সখ্য রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে, তাদের প্রশাসন বা বিচার বিভাগ দেখবে।’

একের পর এক হত্যা
যশোর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আসাদুজ্জামানকে গত মে মাসে ছুরি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। ছয় মাস চিকিৎসা শেষে তিনি এলাকায় ফিরেছেন। হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি ইয়াসিন আরাফাত ওরফে হুজুরে ইয়াসিনকে গত ফেব্রুয়ারিতে ছুরি মেরে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। অনেকের মতে, ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে জুলাইয়ে একই কায়দায় খুন করা হয় জেলা যুবদলের সহসভাপতি বদিউজ্জামান ধোনীকে। গত ২৬ মার্চ ছুরিকাঘাতে মারা যান রুম্মন হোসেন।

বুনো আসাদের ঘটনার পরপরই বেজপাড়া বনানী রোডের চঞ্চলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৭ নভেম্বর খাবড়ি হাসান গ্রেপ্তার হয়। ১৬ ডিসেম্বর এ হত্যা মামলার আসামি শহরের নাজির শংকরপুর মাঠপাড়ার সুমন ওরফে মাঠ সুমনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। শহরের কিশোর-তরুণেরা আগে অনলাইনে ফরমাশ দিয়ে হোম ডেলিভারি নিত বাহারি নাম ও ডিজাইনের ছুরি-চাকু। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ায় এখন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়।

নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ
এ বিষয়ে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি ও সংস্কৃতিসেবী সুকুমার দাস বলেন, পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাজনীতিক বা জনপ্রতিনিধিরা অল্পবয়সী ছেলেদের ব্যবহার করছেন। জনপ্রতিনিধিরা তাদের হাতে রাখতে মাদক ও টাকা দিয়ে থাকেন। স্থানীয়ভাবে পুলিশের নজরদারি আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত