Ajker Patrika

অবিশ্বাসের বাধা দূর করাই এখন প্রধান কাজ

তাসনিম মহসিন ও গোলাম কবির, পীরগঞ্জ (রংপুর) থেকে
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৫: ৫১
অবিশ্বাসের বাধা দূর করাই এখন প্রধান কাজ

পীরগঞ্জের রামনাথপুরের চেরাগপুর গ্রাম। গত রোববার মণ্ডলবাড়িতে গিয়ে সৈকত মণ্ডলের খোঁজ করলে এগিয়ে আসেন তাঁর মা আঞ্জুয়ারা বেগম। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে সৈকতের বাবার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পরামর্শ দেন তিনি।

এর পরপরই সৈকতের নবতিপর দাদা এবং অন্য আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা জড়ো হতে থাকেন। পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান। সৈকতের ছোট চাচা মো. রেজাউল করিম সেখানকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেও জানান।

সৈকত মণ্ডল সম্পর্কে জানতে চাইলে দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল কান্নায় ভেঙে পড়েন। উত্তর জেলেপল্লিতে যা হয়েছে, তার ব্যর্থতা সরকারের জানিয়ে তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যা হয়েছে তা নিন্দনীয়। তবে তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব সরকারের আর আল্লাহর।

এ সময় সৈকতের বড় চাচা, ছোট চাচা ও বাবা পীরগঞ্জের জেলেপল্লিতে কী হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরেন। বড় চাচা রশিদ মণ্ডল বলেন, আগুন দেওয়ার সময় সৈকত চেয়ারম্যানের সামনে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সৈকতের অপরাধের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না পুরো পরিবারটি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সৈকতের মা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাবা, আমার ছেলেটা শারীরিক প্রতিবন্ধী। ও বাচ্চা ছেলে। আমার ছেলে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে। এখন তাকে জামায়াত-শিবির বানানো হচ্ছে।’ ছেলের কী ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধিতা রয়েছে—জানতে চাইলে তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া রংপুরে নিবন্ধিত ৪৮৫৭ নম্বরের পরিচয়পত্রের কাগজ নিয়ে আসেন। এটি ২০১৫ সালে ২৬ আগস্ট ইস্যু করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ইস্যু করা আইডি কার্ডও নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটার জন্ম থেকে হাতে ও পায়ের আঙুলে সমস্যা।’

সৈকত যদি কোনো অপরাধ না করে থাকে, তাহলে পীরগঞ্জ থেকে কেন পালাল—জানতে চাইলে সৈকতের মা বলেন, এখানকার চেয়ারম্যান তার মামাশ্বশুর। ঘটনার পরদিন রাতে বাসার আশপাশ দিয়ে প্রশাসনের অনেক লোক ঘোরাফেরা করছিলেন। বাসায় কয়েকবার এসে ধাক্কাধাক্কি করে গেছেন। এ সময় চেয়ারম্যানের কাছে ফোনে করণীয় জানতে চাইলে তিনি গা ঢাকা দেওয়ার পরামর্শ দেন।

সৈকতের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দূরসম্পর্কের আত্মীয়তার কথা জানান ১৩ নম্বর রামনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ছাদেকুল ইসলাম সাদেক। তিনি বলেন, সৈকতের বিষয়ে কোনো কথা বলব না। জনপ্রতিনিধি হলে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে। এখন খারাপ মানুষকে সুবিধা দিচ্ছি কি না, সেটা দেখতে হবে। হামলার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

ভয়ের আবহ রামনাথপুর ও আশপাশের এলাকায়

গত রোববার সন্ধ্যার দিকে চেরাগপুরের পাশের বাজারে দেখা যায় লোকজন কম। এলাকাজুড়ে ভয়ের আর গুমোট পরিবেশ। বাজারে শুধু দলীয় পরিচয়ের লোকজন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা, বয়স্ক মানুষ এবং ব্যবসায়ীদের দেখা গেছে। নতুন মানুষ দেখলেই সবাই সন্দেহ, ভয় আর কৌতূহলের চোখে দেখছেন।

বাজারে উপস্থিত রামনাথপুর ১৩ নম্বর ইউনিয়নের কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘সবাই খুব-ই ভয়ে রয়েছে। গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম পীরগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।’

উপস্থিত লোকজন বলেন, ‘এখানকার পুলিশ আমাদের সবাইকে চেনে। কিন্তু আমরা এখানে প্রথমবারের মতো বিজিবি দেখেছি। তারা আমাদের চেনে না। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে ভয় বেড়েছে।’

সেদিন আগুন দিয়েছিল কারা? এ প্রশ্নের উত্তর সেখানে উপস্থিত লোকজন দিতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান ছাদেকুল ইসলাম সাদেক বলেন, ‘মাগরিবের পর থানার ওসি ও এসি ল্যান্ডকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। শত শত মানুষ জড়ো হলেও তাঁদের জেলেপাড়ার দিকে এগোতে দিইনি। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে নিয়ে আসি। কিন্তু আলোচনার মাঝখানে দেখি উত্তর জেলেপাড়ায় আগুন জ্বলছে।’

নিরীহ জেলেপল্লিতে আগুন

ঘটনার সূত্রপাত হয় চেরাগপুর গ্রামের সৈকত মণ্ডল ও দক্ষিণ জেলেপল্লির পরিতোষ রায়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। এলাকাবাসী জানান, শুরুতে পূজাকে কেন্দ্র করে সৈকত মণ্ডল হিন্দু ধর্মের অবমাননা করে একটি ছবি পরিতোষ রায়কে পাঠান। এর জেরে পরিতোষ রায়ও মুসলিম ধর্মের অবমাননা করে সৈকতকে একটি ছবি পাঠান। সেই ছবি এলাকার মাঝে ছড়িয়ে দেন সৈকত।

১৭ অক্টোবর জোহরের নামাজ শেষে ছবির অবমাননা নিয়ে একত্র হওয়া শুরু করেন পীরগঞ্জ ১৩ নম্বর ইউনিয়ন ও এর আশপাশের লোকজন। এ সময় মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ ডাকা হয়। বেলা ৩টার দিকে বিশাল এক জমায়েতের সৃষ্টি হয়। এ সময় তাঁরা জড়ো হয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন এর সমাধান কীভাবে করবেন। বিকেলের দিকে সেখানে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন উপস্থিত হন। তাঁরা উপস্থিত জনতাকে শান্ত করে যার যার বাসায় ফিরে যেতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে সেখানে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপস্থিত হয়ে পরিতোষ রায়কে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেন।

চেয়ারম্যান ছাদেকুল ইসলাম সাদেক বলেন, আগুন দেওয়ার সময় জেলেপল্লির মানুষ দুজনকে আটক করেছিল। তাঁদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘উত্তর জেলেপল্লির সবাই নিরীহ। তাঁদের কোনো দোষ ছিল না। ঘটনা তাঁদের গ্রামেরও নয়। কিন্তু তাঁদের গ্রামে আগুন দেওয়া হলো। তাঁদের বাড়ি লুট করা হলো।’

এ ঘটনাকে ঘিরে দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীদের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তা দূর করাই স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসহ সবার প্রধান কাজ। কিন্তু কাজটা অনেক কঠিন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত