Ajker Patrika

তিন সন্তানের জন্য আদালতে একাই লড়ছেন মা

এসএম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা
Thumbnail image

আট ভাইবোনের সংসারে ভালোই ছিলেন রুমা খানম। ১৯৯৩ সালে হঠাৎ করেই মারা যান বাবা। সংসারের দায়িত্ব পড়ে মায়ের কাঁধে। বেশ সুন্দরী হওয়ায় বিয়ের প্রস্তাব আসত প্রচুর। ১৯৯৬ সালে রুমা এইচএসসি পাস করেন। মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মা। বিয়ে দেন চট্টগ্রামের আনোয়ারার বরুমচড়া গ্রামের মোসলেম আহমেদের ছেলে পুলিশ সার্জেন্ট আব্দুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে। মতিন পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হয়েছেন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রামের দামাপাড়া পুলিশ লাইনে কর্মরত। 

পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ে হলেও সুখের মুখ দেখেননি রুমা। পান থেকে চুন খসলেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন বলে রুমার অভিযোগ। স্বামীর সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ১৫ বছরের। সব সময় ভয়ে চুপসে থাকতেন। এর মধ্যেও রুমা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এতেও বাধা দিতেন স্বামী। বই দেখলেই ছিঁড়ে ফেলতেন। এমনকি পুড়িয়েও দিয়েছেন একবার। অদম্য স্পৃহার জোরে গোপনে স্নাতক সম্পন্ন করেন রুমা। মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বাবার বাড়ি থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। সংসারে জন্ম হয়েছে তিন সন্তানের। 

রুমার অভিযোগ, সন্তানদের কথা ভেবে শত নির্যাতন সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ২০১০ সালে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন স্বামী। তিন সন্তান নিয়ে ওঠেন মায়ের কাছে। আর সেখানে গিয়ে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেন। ওই মামলার কারণে মতিন চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। চাকরি ফিরে পেতে কূটকৌশলের আশ্রয় নেন মতিন। রুমাকে সংসারে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দেনদরবার করতে থাকেন। একপর্যায়ে কোরআন ছুঁয়ে নির্যাতন না করার শপথ করেন। 

সন্তানদের কথা ভেবে পরিবারের অমতে স্বামীর ঘরে ফেরেন রুমা। স্বামীর চাকরি ফিরিয়ে দিতে দপ্তরে দপ্তরে আবেদন করেন। মামলা প্রত্যাহারেরও আবেদন করেন। এসবের পর মতিন চাকরিতে পুনর্বহাল হন। কিন্তু সব ঠিক হয়ে গেলে আগের রূপে ফেরেন মতিন। অবশেষে ২০১৩ সালে তালাক দেন রুমাকে। 

এবারও সন্তানদের নিয়ে মায়ের কাছে ওঠেন রুমা। তবে কারও বোঝা না হয়ে এবার তিন সন্তানের জন্য জীবনসংগ্রামে নেমে পড়েন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। বড় মেয়ে এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। আর ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে। আর ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে। সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে একদিন মায়ের কষ্ট লাঘব করবে এমনটাই আশা রুমার। 

তিন সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামের পাশাপাশি স্বামীর বিরুদ্ধে আবার মামলা চালানোর চেষ্টা করেন রুমা। কিন্তু কাজ হয়নি। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর নির্যাতনের ওই মামলায় আদালতের রায়ে খালাস পান মতিন। 

এমন পরিস্থিতিতে সন্তানদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজের দেনমোহর ও সন্তানদের ভরণপোষণ চেয়ে ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট আদালতে মামলা করেন রুমা। এ মামলায় ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর রায় দেন আদালত। রায়ে দেনমোহর ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য রুমাকে ২৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মতিন আপিল করলেও চলতি বছরের ৭ এপ্রিল তা খারিজ করে আগের রায় বহাল রাখা হয়। এরপর ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন মতিন, যা বিচারাধীন। 

এদিকে পুলিশ কর্মকর্তা সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে লড়তে সরকারি আইনি সহযোগিতা পেতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের সাহায্য চেয়েছেন রুমা। 

রুমা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ লাখ টাকা। এর এক টাকাও পরিশোধ করেনি মতিন। বিয়ের পর স্বামীর ভিন্ন এক রূপ চোখে পড়ে। অন্য নারীর প্রতি মতিনের আসক্তি নিয়ে কথা বলার কারণেই নির্যাতন করা হতো। অনেকবার পারিবারিকভাবে বসেও এর সমাধান হয়নি।’ 

রুমা বলেন, ‘বিচ্ছেদের পর থেকে সন্তানদের এক টাকাও দেয়নি তাদের বাবা। কোনো দিন খোঁজও নেয় না। বিয়ের প্রস্তাব থাকলেও সন্তানদের কথা ভেবে রাজি হইনি। স্বামী ছাড়া তিনজন সন্তানকে বড় করা, তাদের মানুষ করা কত কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। ছোট মেয়েটা কেবল নাইনে পড়ে। টাকা পেলে তাদের নামে এফডিআর করে রাখার ইচ্ছা। আর বায়িং হাউসে দীর্ঘদিন চাকরি করেছি, সেটি এখন নেই। চাকরি খুঁজছি।’ 

রুমার অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মতিনের বক্তব্য জানতে চেয়ে ফোন কল করলে তিনি বলেন, ‘এটি বিচারাধীন বিষয়।’ আর প্রতিবেদক কেন এসব জানতে চাচ্ছেন—এমন প্রশ্ন রেখে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। 

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী কুমার দেবুল দে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পরকীয়ার কারণে এখন হাজারো পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। পরিবার ভেঙে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা। আর একজন পুলিশ কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণ সত্যিই দুঃখজনক।’ 

তিনি বলেন, ‘সরকার নারীবান্ধব বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করার পরও এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলছে। কেবল আইন দিয়ে এসব নিরসন করা যাবে না।’ তাই সন্তানদের কথা চিন্তা করে বাবা-মাকে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পরামর্শ দেন এই আইনজীবী। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত