Ajker Patrika

হেমিলটনের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বিএনপির ২ নেতার নামে, আদালতে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
Thumbnail image

খতিয়ানে জমির মালিকের নাম ছিল মিস্টার হেমিলটন। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ এই জমির রেকর্ড সংশোধন করা হয় চার্চ অব বাংলাদেশের নামে। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষে সভাপতি রেভা. সুনীল মানখিন দুই বিএনপি নেতার কাছে ওই জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। সম্প্রতি বিএনপির দুই নেতা জমিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন। 

রাজশাহীতে দীর্ঘদিন এই জমিতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম চলেছে। জমিটি শহরের প্রাণকেন্দ্র ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বোয়ালিয়া মৌজায়। মোট জমির পরিমাণ ছয় কাঠা। এর মধ্যে সাড়ে চার কাঠা বিএনপির দুই নেতা কিনেছেন বলে দাবি করছেন। তবে ওই জমি নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে দাবি করে আদালতে মামলা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই জমিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন।

যে দুজন ওই জমি কেনার দাবি করছেন, তাঁরা হলেন মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা ও রাজপাড়া থানা বিএনপির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান। মিনুর মামলায় এ দুজন ছাড়াও বিক্রেতা হিসেবে রেভা. সুনীল মানখিনকে বিবাদী করা হয়েছে। এ ছাড়া মোকাবিলা বিবাদী করা হয়েছে জেলা প্রশাসককে। তাঁদের মধ্যে মিজানুর রহমান জমি কেনাবেচার ব্যবসা করেন। রেভা. সুনীল মানখিনের ঠিকানা ৩৯১ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা। মিজানুর হড়গ্রাম পূর্বপাড়া ও নজরুল হুদা রাজারহাতা মহল্লার বাসিন্দা।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, সিএস ও এসএ খতিয়ানে জমির মালিকের স্থানে লেখা আছে ‘মিস্টার হেমিলটন সাহেব, সাং মহিষবাথান’। আরএস খতিয়ানে জমির মালিক হিসেবে লেখা আছে, ‘মিস্টার হেলীটন সাহেব, সাং মহিষবাথান।’ ২০২০ সালে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য এই জমির কিছু অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে। এই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ওই বছর ২৫ আগস্ট মিস্টার হেমিলটন সাহেবের মহিষবাথানের ঠিকানায় চিঠি ইস্যু করা হয়। পরের বছরই ‘চার্চ অব বাংলাদেশ’ আরএস রেকর্ডে প্রজার নাম ভুল রয়েছে বলে সংশোধনের জন্য আবেদন করা হয়।

আবেদনে বলা হয়, মিস্টার হেমিলটন বা হলীটন সাহেব ওই সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য চার্চ অব বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। খতিয়ানে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা করণিক ভুল।

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন বোয়ালিয়া ভূমি অফিসের সহকরী কমিশনার আবুল হায়াত চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষে সংশোধন করে নামজারি খতিয়ান সৃজন করেন। তবে মামলার বাদী মিজানুর রহমান মিনুর আইনজীবী জমশেদ আলী বলেন, ‘জমির মালিক হিসেবে তিনটি রেকর্ডে এক ব্যক্তির নাম রয়েছে। এটি নিতান্তই করণিক ভুল বলে এসিল্যান্ড তা সংশোধন করতে পারেন না। এটি একমাত্র দেওয়ানি আদালত অথবা কোর্টের এখতিয়ারভুক্ত।’

জানতে চাইলে তৎকালীন এসিল্যান্ড আবুল হায়াত বলেন, ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি সরকারি হয়ে গেলে সরকারকে সেটা বুঝে নিতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সরকার সেটা করেনি। আবার ব্রিটিশ কাউন্সিলও দীর্ঘদিন মালিকানা দাবি করেনি। চার্চ অব বাংলাদেশ যেহেতু ভুল সংশোধনের আবেদন করে, তাই সবকিছু দেখেই জমিটা তাদের নামে রেকর্ড সংশোধন করে দেওয়া হয়। আমার আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আদালতে যেতে পারে।’ 

হেমিলটনের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বিএনপির ২ নেতার নামে। ছবি: আজকের পত্রিকাজানা গেছে, জমিতে নির্মিত ভবনে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর হাফিজুল ইসলাম সোহেল নামের একজন ব্যবসায়ী ভাড়া নিয়েছিলেন। চার্চ অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভাড়ার টাকা নিত। ২০১০ সালে চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সম্পত্তি তাঁর কাছে বিক্রির প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারে না। হাফিজুল ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এটা চার্চ অব বাংলাদেশের সম্পত্তি নয়। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মিস্টার হেমিলটন সাহেবের নামে জমির রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে তাঁর কোনো ওয়ারিশ না থাকায় এটি সরকারি সম্পত্তি হয়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরদিন ভবনের নিচতলায় হাফিজুলের অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। দোতলায় তাঁর পরিবার ছিল। জোর করে তাঁদের উচ্ছেদ করে নজরুল হুদা ও মিজানুর রহমান এর দখল নেন।

৭ আগস্ট ওই জমিতে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। তাতে লেখা রয়েছে, ‘জমিদাতা চার্চ অব বাংলাদেশ। খরিদ, ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক নজরুল হুদা দিং। মৌজা বোয়ালিয়া, জেএল নম্বর ০৯। দলিল নম্বর ৯০১৬। প্রস্তাবিত খতিয়ান নম্বর ১৪২৬৯। হোল্ডিং নম্বর ১৪৫৩৩। দাম নম্বর ১৯৪৩,১৯৪৪ ও ১৯৬৩। ১১৩৫-এর দশমিক ০৯৯০ একর। বাংলা মাপে ৬ কাঠা।’ সাইনবোর্ড লাগানোর পরদিন মিজানুর রহমান মিনু রাজশাহী সদরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে নালিশি মামলা করেন। মামলা নম্বর ২০২/২০২৪।

মিজানুর রহমান মিনু আরজিতে উল্লেখ করেছেন, এই জমির মূল মালিক ছিলেন মিস্টার হেমিলটন সাহেব ওরফে হেলিটন সাহেব। তাঁর ঠিকানা দেওয়া রয়েছে নগরের মহিষবাথান এলাকা। বিগত সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ড মূলে নালিশি সম্পত্তি মিস্টার হেমিলটন সাহেব ওরফে হেলিটন সাহেবের নামে রেকর্ড হয়ে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আরএস রেকর্ডে মন্তব্য কলামে দখল ব্রিটিশ কাউন্সিল লেখা রয়েছে। গত ৭ আগস্ট সর্বপ্রথম মামলার বিবাদী নজরুল হুদা ও মিজানুর রহমান নালিশি সম্পত্তিতে উপস্থিত হয়ে দলিল মূলে স্বত্ব দাবি করেন এবং সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন যে, মিস্টার হেমিলটন সাহেব নালিশি সম্পত্তি হস্তান্তর না করলেও চার্চ অব বাংলাদেশের ভুয়া সভাপতি সেজে রেভা. সুনীল মানখিন জাল কাগজপত্র সৃষ্টি করে বেআইনি ও জালিয়াতির মাধ্যমে এই জমি বিক্রি করেছেন। নজরুল হুদা ও মিজানুর রহমান জালিয়াতি ও কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং ভুল বুঝিয়ে যোগসাজশ করে নিজেদের নামে খারিজ করেছেন।

জানতে চাইলে মিজানুর রহমান মিনু বলেন, এটি মূলত মালিকবিহীন সরকারি সম্পত্তি। সে কারণে বাংলাদেশ সরকারকে চার নম্বর বিবাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি রাজশাহীর মেয়র ও সংসদ সদস্য ছিলেন। জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে তিনি জনস্বার্থে এই মামলা করেছেন।

মিজানুর রহমান মিনু এই জমিতে কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন না করার জন্য রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। দুই নেতার বিরুদ্ধে দলের হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবনটি পুরাকীর্তি ঘোষণা, বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছেও আবেদন করেছেন। গত ১ সেপ্টেম্বর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদা সুলতানার নেতৃত্বে একটি দল সেখানকার ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবন পরিদর্শন করেন।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আজ দুপুরে জমির ক্রেতা বিএনপি নেতা নজরুল হুদার মোবাইলে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জমির আরেক ক্রেতা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, সেখানে ছয় কাঠা জমির মধ্যে তাঁরা দুজন সোয়া দুই কাঠা করে সাড়ে চার কাঠা কিনেছেন। জমির দাম ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি টাকা তাঁরা দুজন পরিশোধ করেছেন।

তবে দলিলে দেখা গেছে, জমির দলিলে মূল্য লেখা হয়েছে ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। দলিলে কম মূল্য দেখিয়ে সরকারকে বিপুল টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘শতভাগ দলিলেই রাজস্ব ফাঁকি দিতে বাজারমূল্য উল্লেখ না করে মৌজা রেট দেখিয়ে জমি কেনাবেচা হয়। আমরাও কিছু টাকা বাঁচাতে কম মূল্য দেখিয়ে জমি কিনেছি।’

মিজানুর দাবি করেন, ইংল্যান্ডের নাগরিক মিস্টার হেমিলটন চার্চ অব বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। জমিটি ভুল করে তাঁর নামেই রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। চার্চ অব বাংলাদেশ রেকর্ড সংশোধন করে তাঁদের কাছে বিক্রি করেছে। তাঁরা নির্ভেজাল জমি কিনেছেন।

মামলার বাদী বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনুর আইনজীবী জমশেদ আলী বলেন, মামলার পর আদালতের বিচারক বিবাদী নজরুল হুদা ও মিজানুর রহমানকে কেন নালিশি সম্পত্তিতে বহুতল ভবন নির্মাণ বা জবরদখল থেকে বিরত থাকার আদেশ দেওয়া হবে না মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। তা ছাড়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার শুনানি না হওয়া পর্যন্ত ওই সম্পত্তিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত